মিয়ানমার -২০০১

পঞ্চপর্যটকের প্রথম সফরের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি

ইয়াঙ্গুন, এপ্রিল ২০০১ ।

বিমানের ফ্লাইট এ্যাটেন্ডেন্টদের অশুদ্ধ বাংলা ও অতি দুর্বল ইংরেজি উচ্চারণের যন্ত্রনায় বেশি দূর ক্লান্ত হতে হয় নি। ঢাকা থেকে ইয়াঙ্গু। দেড় ঘণ্টার পথ।

ইয়াঙ্গুন বিমান বন্দরে উড়ো জাহাজটি নামতেই সোনালী রং-এর একটা প্যাগোডার ফাসাদ চোখে পড়ে। তবে কি বার্মা প্যাগোডার দেশ !

এমন কিছু চিন্তা করার আগেই বাসে ওঠা এবং বাস থেকে নেমে সরাসরি এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কাউন্টারের মুখোমুখী হওয়া। কিন্তু দেড় ঘণ্টার এই দূরত্ব মন থেকে বাংলাদেশকে খুব সহজে সরাতে পারছে না। এয়ারপোর্টের দৈন্যদশা দেখে মনে হচ্ছে না যে ঢাকার বাইরে ভিন দেশে চলে এসেছি। পঞ্চাশ বছর আগে বিমান বন্দরটি যেখানে বানানো হয়েছিল, এখনও তাই আছে। ভাষার পরিবর্তন হয়নি কিছুই। তবে কি বার্মা দ্রুত পরিবর্তনশীল কোনো দেশ নয় ?

এতো কিছু ভাবার সময় নাই। বুকে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি পাশ ট্যাগ লাগানো, বাঙালী বাঙালী চেহারার এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন। আমরা ৫ জন এক সাথে জটলা পাকানো। পাঁচজনের পাসপোর্ট টিকেট ভিসার কাগজ একজনের কাছে। ঐ ভদ্রলোক কাছে এসে বললেন- আমি রেজাউল, বাংলাদেশ দুতাবাসের প্রটোকল অফিসার, আপনাদের পাসপোর্টগুলো আমার কাছে দেন, আপনারা ওখানে বসুন।

কাউন্টারের ভেতর পকেটে হাত পুরে দাঁড়িয়ে আছেন মাহফুজ ভাই। তার চোখে চশমা, গলায় টাই, বুকের কাছে  আরেকটি ট্যাগ। চোখাচোখি হতেই হাত নাড়লেন। বুঝলাম নিজেও এসেছেন। যাক এয়ারপোর্টের ঝামেলা নাই। মাহফুজ ভাই আমাদের সাথে আর্কিটেকচার পড়তেন। উনি আমার দুই কী তিন কী চার ব্যাচ সিনিয়র হবেন, এখন আর মনে নাই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যতোটা না লেখাপড়ায় সিরিয়াস ছিলেন, তার চেয়ে অকে বেশি ছিলন রাজনীতিতে। ১৯৮৬ সালে আমরা যখন বুয়েট ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হই তখন দেখি উনি মিছিল মিটিং করতেন। কোন ক্লাসে বসতেন, তা মনে নাই। আদৌ কোনো ক্লাসে বসতেন বলেও মনে হতো না। কারণ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অনেক জ্বালাও পোড়াও কান্ডকারখানা করার দায়ে এক দুই বছরের জন্য তিনি বহিস্কৃত ছিলেন বলে শুনেছি। জেলের অভিজ্ঞতাও নাকি আছে ।

লেখাপড়ায় তিনি কখনোই মনোযোগি ছিলেন না, কিন্তু পরীক্ষায় কখনো ফেল করা দূরের কথা, খারাপ করার খবরও কেউ শুনেনি। তার বন্ধুরা তাঁর অসাধারণ  মেধার প্রশংসা করতো। বন্ধুরা রুমের ভেতর দলবেঁধে পড়তো। পাশের বিছানায় গল্পের বা রাজনীতির বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তিনি যা শুনতেন তা দিয়েই রেফার্ড ছাড়া তিনি বুয়েট পরীক্ষায় পার পেয়ে যেতেন।

কয়েক বছর পরপর নতুন নতুন ব্যাচমেট জুটতো তার। এ কারণে কারা তার অরিজিনাল ব্যাচ, কারা তার বন্ধু, এটা তার নিজেরও মনে আছে বলে মনে হয় না।

বহিস্কার আদেশে রহিত হবার পর যখন পরীক্ষা পাশ করে মাহফুজ ভাই বেরুলন, শোনা গেলো তিনি বিসিএস পরীক্ষাও দিয়ে দিচ্ছেন। সে ঘটনা একটু অন্য রকম।

পাশ করার পর চাকরী লেন কনকর্ড ইনটেরিয়ার নামক এক ফার্মে। থাকেন বন্ধুদের সাথে এক মেসে। সেই মেসের বন্ধুরা বিসিএস পরীক্ষা দেবে তারা তার জন্য একটা ফরমও নিয়ে এলো । ওদের উদ্দেশ্য ছিল প্রিলিমিনারী পরীক্ষার একজন পার্টনার বড়ালো, পড়াশুনায় তাদের সঙ্গ দেয়া। মাহফুজ ভাই বলেন, আমি আসলে ওদের ভয় কাটানোর জন্য ওদের সাথে পরীক্ষা দেই। কিন্তু ট্যাজেডি হচ্ছে- ঐ পরীক্ষায় ওরা কেউই পাশ করতে পারলো না।

তিনি প্রিলিমিনারীতে পাশ করলেন, লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলেন, পাশ করে গেলেন মৌখিক ও মনস্তাত্বিক পরীক্ষাও। সারাদেশে ৬৬ হাজার ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিলো। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায় মাহফুজ ভাই চতুর্থ স্থান পেয়ে বসে আছেন। চাকরীতে যোগ দিলেন বটে, কিন্তু আবার কী সব ছুটি নিয়ে চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়। অন্য কী একটা বিষয়ে পড়তে শুরু করলেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে প্রথম বিদেশ পোস্টিং মায়ানমার। বাংলাদেশ দুতাবাসের প্রথম সচিব। রাষ্ট্রদূতের পরেই তাঁর অবস্থান। এই লোকটিকে এভাবে পকেটে হাত দিয়ে ভদ্রলোকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হচ্ছিলাম। কোথায় যেন মিলানোর চেষ্টা করছিলাম ৮৭-৮৮’র হকিস্টিকার মাহফুজ ভাইকে। এই কুটনীতির আমলার মধ্যে তার লেশমাত্র নাই।

ইমিগ্রেশন, কাস্টমস এর ঝামেলা কোন দিকে মিটলো বুঝতে পারলাম না। প্রটোকল অফিসার রেজাউল সাহেব পাসপোর্ট হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলেন- এটা বড় অদ্ভত দেশ, একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।

দেশ কতোটা অদ্ভত তা বোঝার আগেই এ দেশের মানুষজন দেখে ভিমরি খাবার অবস্থা। রেঙ্গুন সম্পর্কে আমার মনের ভেতর যে ছবি আঁকা আছে তা ঐ শরৎচন্দ্রের উপন্যাস আর ভ্রমণ কাহিনীর চিত্র। মাঝে মাঝে সেই সব কাহিনী চলচ্চিত্ররূপ দেখতে গিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর রেঙ্গুনের যে চিত্র দেখেছি, এর বাইরে এর ভূগোল সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা নেই। কাস্টমস ক্লিয়ারিং করে বেরোতেই এয়ারপোর্টের ভেতরের লোকজন চোখে পড়ে। ওরে বাবা! এ কোথায় এলাম। আমাদের গাও গেরামের পোস্টাপিস-ব্যাংকে যেমন লোকজন দেখা যায়, এ দেখি তার চেয়েও ভয়াবহ। শার্টের সাথে লুঙ্গি তো পরেছেই, তার উপর লুঙ্গির কোচা শার্টের উপরে। মাঝে মাঝে গাও গেরামের মাস্তানদের এমন দেখেছি। শার্টের উপর লুঙ্গি চরিয়ে মুখে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সিনেমার গান গাইতে গাইতে কেউ কেউ মাঠের মধ্যে গরু আনতে যাইতো। এখানে যাকে দেখি তাকেই সে রকম মনে হয়।

এর মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ দুই লুঙ্গিওয়ালা এসে রীতিমত ইংরেজিতে জানতে চাইলো- বিলেত থেকে ঢাকা হয়ে তার দুই আত্মীয় আসার কথা ছিলো, আমার ওদের দেখেছি কি না।

সহজ সরল মানুষ। কথা বলে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে। ক্ষেপে গেলেও রাগে না। এ বিমানে যখন আসে নি, পরের বিমানের জন্য তারা অপেক্ষা করবে বিমান বন্দরে। কিন্তু যখন তাদের জানানো হয়, বাংলাদেশ বিমান সপ্তাহে কেবলমাত্র একদিন রেঙ্গুন সফরে আসে ব্যাংককে যাবার পথে, তখন তারা একটু চিন্তিত হলো।

অলস বিমান বন্দর পেছনে ফেলে বাইরে আসতেই মনে হলো, এ অঞ্চলটা একটু অন্যরকম। বাংলাদেশের সাথে খুব লাগোয়া হলেও ওদের ভাষা, ওদের সংস্কৃতি, ওদের বলন চলনের থেকে আমরা অনেক দূরে। আমরা যে, হোটেলে উঠেছি, এটাকে ঠিক হোটেল বলে না, বলে সার্ভিস এপার্টমেন্ট জাপানি মালিকানায় আমেরিকান ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে চেইন সার্ভিস এপার্টমেন্টগুলো আছো তাদের একটি এই সাকুরা এপার্টমেন্ট। দূর থেকে দেখতে ৫ তলা হোটেল কমপ্লেক্স মনে হলেও এর ভেতরের আয়োজন একেবারেই এপার্টমেন্টের মতো। ১,২ ও ৩ বেডের এপার্টমেন্ট। প্রতিটিতে বেডরুম গুলো ছাড়াও আছে ড্রয়িং-ডাইনিং স্পেস, একেবারে ফার্নিস্ড রান্নাঘর। রান্নাঘরে যাবতীয় হাড়ি পাতিল, চামচ প্লেট, কুকার, মাইক্রোওভেন ফ্রিজ, টোস্টার। পাশের ইউটিলিটি রুমে ওয়াশিং মেশিন, ড্রায়ার। শুধু বাজার করো, রান্না করো, খাও, ঘুমাও ফুর্তি করো, সাঁতার কাটো, শরীর চর্চা করো, খেলাধূলা করো, এসবের চ‚ড়ান্ত আয়োজন।

(এই পর্যন্ত লেখা হয়েছিল। বাকি অংশ ছবিতে )

গোপন কথা ঃ

প্রায় ৫ মাস ধরে অফিসের দেখা নাই। আমার প্রাণপ্রিয় সহকর্মি এভিশন পাতংকে দিয়ে অফিসের জিনিসপত্র আনাই নেয়াই। হঠাত কিছু পুরনো কাগজ আনার দরকার পড়লো, আমাকে ফোন করে । আমি বলি, সে বুঝে না।

এক সময় বললাম, পুরা বান্ডিল নিয়া আসো।

সে বান্ডিলের মধ্যে দরকারি সেই কাগজটি খুঁজতে যেয়ে দেখি, ২০০১ সালে পঞ্চপর্যটকের প্রথম সফরের উপর একটা লেখা শুরু করেছিলাম, ৪ পাতা লিখে বন্ধ রেখেছিলাম, আর লিখিনি,। এই অংশটি কোথাও ছাপেওনি। মনে পড়ে এই সফরের আগে আগে আমেরিকা সফর করে এসেছিলাম এবং সে বই (কাছের মানুষ, দূরের মানুষ) লিখাতে মনযোগ দেয়ার কারনের পঞ্চপর্যটকের সূচনাভ্রমণের কাহিনীটুকু লেখা হলো না।

এই লেখার মাধ্যমে আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম, আমাদের অপর সহপর্যটকের লাভ্লু ভাই বা আরিফ ভাই তাঁদের স্মৃতি থেকে বাকিটুকু লিখে দিতে । আর সেদিদের হোস্ট মাহফুজ ভাই এখন পোলান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাস্ট্রদূত। তাঁর লেখার হাত দুর্দান্ত। ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন তিনি। চাইলে তিনিও কিছু সা’দিতে পারেন। ওপেন চ্যালঞ্জ টু অল পিপি

 

মন্তব্য
Loading...