টোকিও ট্যুর

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৫ রাতের টোকিও সফরের কাহিনী

জাপান যাবি ? চল

কথা নাই বার্তা নাই, একদিন আরিফ ভাই আমাকে তাঁর অফিসে ডাকে । এই কথা সেই কথার পর – বলে, জাপান যাবি ? চল ।

বলেন কী !

কার্ড আছে, সাথে ?

আছে।

বের কর। রেজিস্ট্রেশন করে দিচ্ছি। সাড়ে চারশো ডলার কিন্তু চলে যাবে ।

আমি তাঁর হাতে কার্ডটা দিয়ে ভ্যা করে চেয়ে থাকি তাঁর কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে।

জাপান আমার অনেক বড় কৌতুহলের একটা দেশ। দেশটি সম্পর্কে বেশি কিছু জানিনা। ভাষাভাষা যে জ্ঞান- তা কতোগুলো সিনেমা দেখে। আকিরা কুরোসাওয়ার অনেকগুলো সিনেমা আমার দেখা। তা দেখে মনে হয়েছিল জাপান বুঝি সামুরাইদের দেশ, সেখানে গেলে সামুরাইদের দেখা মিলবে। আবার ‘দা লাস্ট সামুরাই’ দেখে এটা মনেও হয়েছিলো যে জাপানে সামুরাইদের জীবন-যাপন আরো দেড়শো বছর আগে শেষ হয়ে গেছে,  এখন আর সামুরাই পাওয়া যাবে না ।

তাহলে কী আছে ?

জাপানে রোবট আছে। ইলেক্ট্রনিক্সের কিছু কেনাকাটায় আমরা চোখ বন্ধ করেবেশি দাম দিয়ে হলেও জাপানি জিনিস কিনে ফেলি। আমাদের প্রথম রেডিও ছিলো ন্যাশনাল প্যানাসনিক, জাপনি রেডিও। অনেক আছাড়বিছাড়ের পরও কী সুন্দর গান বাজতো! জাপানের প্রতি তখন থেকেই আমার অগাধ আস্থা।এর পরেও জাপান নিয়ে আমাকে কৌতুহলী করে ছিলেন আরো দুইজন। একজন বক্সার-কাম-আর্কিটেক্ট তাদাও আন্দো, আর আরেকজন ম্যারাথন রানার-কাম-রাইটার হারুকি মুরাকামি। এঁদের চেনার আগেও জাপান আমাকে চিনিয়েছিল একটা টেলিভিশন সিরিয়্যাল- ‘ওশিন’।

এক আদর্শ সংগ্রামী তরুনী ওশিনকে কেন্দ্র করে জাপানের মানুষের যেসকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কাহিনী দেখেছিলাম প্রায় দুই যুগ আগে তা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এর বাইরে জাপান আমার ভালো জানা নেই। কিন্তু জাপান নিয়ে আমার আগ্রহও প্রচুর। এই জাতি যোদ্ধা ছিল। তাঁদের সামুরাই বাহিনী ছিলো। আবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মরনপণ লড়েছিলো তারা। হিরোসিমা নাগাসাকিতে এটম বোমা ফেলেছিল আমেরিকা। কী বীভৎস সেসব কাহিনী!

এর বাইরে আর যা জানি তা হলো, এরা এমনই এক জাতি যারা কখনো কোন বিদেশী দ্বারা শাসিত হয়নি। সুতরাং ঐতিহ্যের যাকিছু আছে সবই তাঁদের নিজের, কারো কাছ থেকে ধার করা নয়। আবার এখন যদি টোকিও শহরের ছবি দেখি, যেকোন কসমোপলিটান শহরের মতো আভিজাত্য আর আড়ম্বর নিয়ে তার থাকা। এর রহস্যটা কী- এমন কিছু জানার জন্যেই মূলত মত দিলাম টোকিওতে অনুষ্ঠিতব্য এশীয় দেশগুলোর স্থপতিদের সম্মেলন (আর্ক-এশিয়া)-এ বাংলাদেশ স্থপতি ইনষ্টিটিউটের ডেলিগেট হিসেবে ব্যায়বহুল এই ট্যুরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে।

জাপান যেতে আমাদের ভিসা লাগে এবং এই ভিসাটা পাওয়াও খুব সহজ নয়। এটা সহজ করার জন্য আমাদের সেমিনারের রেজিস্ট্রেশন ফী সাড়ে চারশো ডলার আগে দিয়ে আমন্ত্রণপত্র আনিয়ে, হোটেলের অগ্রীম বুকিং করে, জাপানি ভাষায় আসা কাগজপত্রসহ জমা দেয়ার এক সপ্তাহ পর ভিসা পাওয়া গেল।

ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই শুরু হয়ে যায় আমাদের ফটো সেশন

আমাদের প্রায় একশো জনের দলের দুই জনের ভিসা হলো না। কেন হলো না তার কারণ দেখানো নাই। তাদেরকে বলে দেয়া হলো- ভিসা না দেয়ার কারণ জাপান কখনো জানায় না।

এ থেকেই বুঝে নিলাম, এরা খানিক অহংকারিও। আবার যাদের যথাযথ কাগজপত্র জমা হয়েছিল তাদের ভিসা হয়ে গেল, তারা সবাই চুপচাপই ভিসা পেল, তাদের কোন প্রশ্নও জিজ্ঞাসা করে নাই। ভিসার ইন্টারভিউতে শুধু নানা রকমের কাগজ চেয়েছে তাঁরা। কাগজ নিয়ে একটা জমা রসিদ দিয়ে ভিসা ইন্টারভিউ শেষ। এই রসিদে শুধু লেখা থাকে কবে এসে পাসপোর্ট ফেরত নেবে। এই ফেরত নেবার সময় সবাইকে তাঁর পাসপোর্ট আর জমা দেয়া সব মূল কাগজ ফিরেয়ে দেয়, কারো পাসপোর্টে থাকে ভিসার সীল, কারোটা ফাঁকা।

এর আগে যারা জাপান গিয়েছে বা জাপানের বা জাপানির সাথে যাদের ওঠা বসা বা যোগাযোগ- তাঁদের মুখেও শুনেছি- এরা খুবই নিয়মমানা জাতি। নিয়মের মধ্যে পড়ে গেলে হয়ে যাবে, না পড়লে হবে না। না, মানে-না। অনুরোধ, বিবেচনা, এসব তাঁদের ডিকশনারিতে নাই।

জাপান যাওয়াটাও বেশ জঞ্জালের। ঢাকা থেকে ব্যাংকক/ কুয়ালালামপুর বা সিংগাপুর, সেখান থেকে টোকিও। সেমিনার শরু হবে ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে। আমরা তার দুদিন আগে নানাভাবে রওয়ানা দিয়েছি। ৭/৮জন, যাদের ব্যাংকক-মালয়েশিয়া কোন কাজ আছে, তারা ছাড়া বাকী সবাই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের দুই- তিন ফ্লাইটে যাবে, এমনটাই ঠিক হলো। মাঝরাতে যে ফ্লাইটে আমি যাবো, সে ফ্লাইটে আরো ৩৪জন বাংলাদেশি স্থপতি। ইনষ্টিটিউটের বড় নেতারা আমাদের দলে, সুতরাং সবচেয়ে বড় আর গুরুত্বপূর্ণ বহরেই আমার জায়গা হয়ে গেলো।

ঢাকার ডিপার্চার লাউঞ্জে উল্লসিত বাংলাদেশী স্তপতিকূল । ছবিগুলো স্থপতি অহোনার ফেইসবুক থেকে নেয়া

গত ১৮ বছর ধরে নানা দেশ ঘুরে ঘুরে আমি এখন অনেক ক্লান্ত। আমার শরীরে মধ্য তিরিশের সে জেল্লা আর এখন নাই যে, দুই ক্যামেরা ট্রাইপড আর হ্যাভারসেক পিঠে ঝুলিয়ে দিনমান তাফালিং করে করে ছবি তুলে বেড়াতে পারব। এই তেজ হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে দল ছাড়া আর বিদেশ বেরুই না। কিন্তু দল যতো বড়ই হোক না কেন, বেড়াতে গিয়ে মনে হয় ট্র্যাভেলার হিসাবে আমরা সবাই বড় একা। অনেকের সাথে বেড়ালেও প্রত্যেকেই আসলে একা একা বেড়াই, একা একা দেখি।

এর মধ্যে আমার শরীর আছে বিগড়ে। গত বছর এক সড়ক দূর্ঘটনায় মরতে মরতে কোন মতে বেঁচে যদিও গিয়েছি, আমার ভাঙ্গা বাম হাতটি এখনো পুরোপুরি জোড়া লাগেনি। কোন ভারী জিনিস, এমনকি দুই কেজি ওজনের আমার ডিএসএলআর ক্যামেরাটাও বইতে পারিনা। মেরুদন্ডে পুরনো সমস্যা- সব মিলিয়ে আমি যে মনের মতো ঘুরে বেড়াবো, সেই অবস্থা নেই। মনে জোর আছে এই নিয়ে যে- আমার পুরনো ট্র্যাভেলটিম পঞ্চ-পর্যটকের তিনজন স্থপতিই এখানে, এই দলে আছেন। বড় ভাইদের মধ্যে যারা আছেন, খোদ দলনেতা নাসির ভাই বা দীলু ভাই, তারাও প্রাণ দিয়ে আমাকে দেখে রাখছেন। কনভেয়ার বেল্ট থেকে আমার ব্যাগ উঠিয়ে রাখছেন হয়তো দিলু ভাই, নাসির ভাই কেড়ে নিয়েছেন আমার হাত ব্যাগ তাঁর নিজের হাতে। এর বাইরে রেগুলার অত্যাচার সহ্য করার মতো আরিফ ভাই আর লাভলু ভাই আছেন আমার পাহারায়। এটা ছাড়াও জুনিয়ার ভাইদের তো তুলনাই নাই। এই সব বিবেচনায়, আমার সফরের শুরুটা খুবই ভালো শুরু হয়ে যায়।

সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জ। টোকিও গামী বিমানের দিকে যাত্রা, দুই ‘কাজী’ একসাথে

আমরা সাড়ে চার ঘন্টা উড়ে সিঙ্গাপুর নেমে সাড়ে তিন ঘন্টা আরাম করি প্রায়োরিটি লাউঞ্জে। সেখান থেকে আবার তৈরি হই আরো সাত ঘন্টার ফ্লাইটের জন্য। এ সময় বিমানবন্দরের ট্রাঞ্জিট লাউঞ্জেই দেখা হয়ে যায় আমাদের পশ্চিম বঙ্গের মিত্রবাহিনী, স্থপতিকূলের কয়েকজনের সাথে । সে এক দৃশ্য।

আমাদের দুই কাজের কাজীকে (কাজী গোলাম নাসির- প্রধান স্থপতি, স্থাপত্য অধিদপ্তর এবং স্থপতি কাজী এম আরিফ, সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট) দেখি ট্যুর নিয়ে নানা পরামর্শে ব্যস্ত। এমনি করে করে এক সময় আমরা আবার প্লেনে উঠি এবং হিসাব করে দেখি যে প্রায় ১৬ ঘন্টা জার্নির পর বিকাল পাঁচটায় আমাদের বয়ে নেয়া সিঙ্গাপুরি বিমান এসে নামে জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে ৮৬ মাইল দূরের নারিতা বিমান বন্দরে।

জাপান  স্পর্শ করেই মনে পড়লো বহু আগে পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জাপান যাত্রী’র কাহিনী। একশো বছর আগে কলকাতার খিদিরপুর থেকে এই টোকিও বন্দরে রবীন্দ্রনাথকে ঘাটে ঘাটে সময় ব্যয় করতে করতে দুই দুইটা সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল ২৪ দিন। কলকাতা থেকে মুম্বাই, সেখান থেকে বার্মার রেক্সগুন, মালয়েশিয়ার পেনাং, সিঙ্গাপুর, চীনের সাংহাই, হংকং হয়েই তাঁর আসা হয়েছিলো এই জাপানের টোকিওতে। অথচ কলকাতা থেকে আমাদের দিলীপদার দল এলো আমাদেরই মতো প্রায় ১৬ ঘন্টার জার্নিতে।

বিংশ-শতাব্দীর-দ্বিতীয়-দশকের-টোকিও।-রবীন্দ্রনাথ-যে-সময়ে-টোকিও-সফর-করেছিলেন

রবিবাবুদের আমলে এসব ভ্রমণের যাত্রাপথে যতো ঘটনা ঘটতো তার কিছুই এখন আমাদের হয় না। জাহাজে বসে বসে রবীন্দ্রনাথ ৯ অধ্যায় ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলেন কলকাতার খিদিরপুর থেকে জাপানের ‘কোবে’ বন্দরে পৌঁছাতেই। আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলীও কতো রসের কাহিনী আমাদের শুনিয়েছিলেন জাহাজের ডেকে পাওয়া মানুষদের নিয়ে। আর আমরা এখন প্লেনে পাই কমার্শিয়াল হাসি ছড়ানো আসমানী বুয়া। আর পথঘাট যেহেতু সবই ডিজিটাল সাইনেজে চেনানো, খোঁজাখুঁজি উপলক্ষে বাড়তি কথা বলেও যে ভিন জাতির একজনের সাথে ভাব বিনিময় করবো, আমাদের সেই সুযোগও কম। আবার আমরা নিজেরাই আছি বড় দলে। নিজের দেশের যে মানুষগুলোর সাথে বছরের পর বছর দেখা সাক্ষাত হয় না, তাদের সাথে আড্ডাতেই আমাদের অর্ধেক সময় চলে যায়, সেখানে বিদেশের গন্ধ একান্তে ভোগ করবো সে ফুরসত কোথায় আমাদের ?

টোকিওর নারিতা বিমানবন্দরের ৪কিলোমিটার দীর্ঘ রানওয়ে মাড়াতে মাড়াতে যেটুকু দেখেছিলাম, ইমিগ্রেশনে-কাস্টমের দরজা পেরুতে পেরুতেও প্রায় একই জিনিস চোখেপড়লো। এমন বাণিজ্য লক্ষ্মীর বসত যার ঘরে, সে এতো আড়ম্বরহীন হয় কী করে !

কোন দেশের বিমানবন্দর হচ্ছে যেন কোন বাড়ির সদর দরোজা। একটা সদর দরোজা ও তার পাহারাদার দেখলেই যেমন বাড়ির ভেতরে কে আছে, কিভাবে আছেন তার ধারনা পাওয়া যায়, বিমানবন্দরে এসেই আমার সেরকম কিছু মনে হয়। সে নিউ ইয়র্ক হোক বা নারিতা। তার অভ্যর্থণাকারির জেসচার দেখেই তার দেশে মানুষের চরিত্র চেনা যায়।

নারিতা বিমানবন্দরে নেমেই টের পাই , দেশটা অন্যরকম কিছু হবে

আমরা একটা প্রশস্থ করিডোর দিয়ে হেঁটে যাই। ডানে-বামে-উপর-নিচে যেদিকেই তাকাই- নেই কোন বাড়তি অলংকরণ, না আছে কোন চটকদার বিজ্ঞাপনের আবাহন। বিমান থেকে নেমেই ইমিগ্রেশনে যেতে যেতে শেষ মাথায়, কতোগুলো ফালির উপর একপাশে একটা কোম্পানির নাম ছোটকরে, আর মাঝখানে ইংরেজিও জাপানি ভাষায় লেখা

– Future meets the past

– Art meets function

– Science meets fiction

– Perfection meets imperfection

– Revolution meets revolution

– Technology meets empathy

– The bold meets the minimal

– Nature meets innovation

তাকিয়ে দেখি, যাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশণা ছাড়া আর কিছুই কোন দেয়ালে লেখানেই। উপরে যেটুকু লেখা আছে, কেনো যেন মনে হলো, জাপান মানেই তাই। এমনটিই এই দেশ সম্পর্কে শুনে এসেছি। এখন দেখার পালা।

ইমিগ্রেশন, নিরাপত্তা তল্লাশি, কাস্টম, এসবে যে কয়টা জাপানির সাথে কথা বলেছি, মনে হলো সবগুলো কথাই তাদের প্রোগ্রাম করা। প্রয়োজনের বাইরে  একটি প্রশ্নও নয়। আর যিনি কিছু জানতে চাইছেন, তিনি হাসিমুখে চোখের একটু নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে কথা বলছেন। ইমিগ্রেশন কর্তা বা পুলিশকে দেখে মনে হলো, তাঁদের শরীর আর চোখের ভাষা থেকে আমাদের শিষ্ঠ্যতার অনেক কিছু শেখার আছে। কথা বলে নিচুস্বরে, সরাসরি চোখের দিকে না তাকিয়ে একটু নিচু করে, হাসিমুখে প্রশ্ন করে মনোপুত হওয়া উত্তরটি পেয়ে খুব খুশি হয়ে যখন বলে ‘সরি টু কিপ ইউ ওয়েটিং, ওয়েল কাম টু জাপান’ তখন জাপানের প্রতি ভালো লাগাটা বেড়ে যায়।

খানিক পরেই মনে হলো- ঢাকার ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে দাঁড়াতে আমরা যে শৃংঙ্খলাটুকু দেখাই, যে অভিব্যক্তি করি, সেটাও বদলে গেছে।আমরা সোজা লাইনে দাঁড়িয়েছি কোন বিরক্তি ছাড়াই। কেউ কারো লাইন ডিঙ্গানোর জন্য তাড়াও বোধ করছি না। কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, এক্সকিউজমিও বলছি। সামান্য এই পরশ আমাদের বদলে দিলো এই নারিতা বিমানবন্দরের কয়েকজন জাপানি। আর তখনই মনে হলো মানুষকে তার পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতাই সবচে বেশি শেখায়। আর মানুষের চরিত্রও ঠিক করে দেয় তার পরিবেশ।

এসব ভাবতে ভাবতেই ইমিগ্রেশিন, কাস্টম পার হই। এবার আমাদের হোটেলে যাবার পালা।

দেশে যখন এ রকম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আমরা আয়োজন করি, বিদেশী ডেলিগেটদের এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নেয়ার যে ব্যবস্থা রাখি, কিংবা নিকট অতীতে ভারতের জয়পুর, নেপালের কাঠমান্ডু বা মালোয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নেয়ার যে ব্যবস্থা আমরা পেয়ে এসেছি , সেরকম কিছু পাবো বলেই তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে আসি।

বাহির গেটে এসেও যখন কাওকে পাওয়া গেল না, মনে হলো- তারা কাছাকাছি কোথাও আছে, পাওয়া যাবে, একটু অপেক্ষা করি ।

এ সময়ে লাভলু ভাই’র ইচ্ছা হলো তিনি কিছু ডলার এখান থেকে ভাঙ্গিয়ে নেবেন।

আমার বেরিয়ে যেতেই মন চাইলো। তখনো টোকিওর আকাশে বেশ আলো। বিকাল ৫টায় বিমান নেমেছে। এখন ছ’টাও বাজেনি। একটু বাইরের আকাশ দেখার জন্য, যেই না বেরুতে গেলাম, আমাকে ঠেকান আরিফ ভাই। তাঁর কথা- কনফারেন্সের সব ডেলিগেট একসাথে হবে এখানে, জেআইএ (জাপান ইনষ্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস)-এর লোকজন থাকবে, তারা নিয়ে যাবে।

আমি বলি- এখানে বিক ক্যামেরার দোকান আছে, আমি ডাটা সিম নেব।

তিনি একশো আশি ডিগ্রিতে মাথা ঘুরিয়ে বলেন- এখানে কোন ক্যামেরার দোকান নাই।

আমি বলি- বিক ক্যামেরা আসলে খুচরা ইলেক্ট্রনিক মার্কেট। এর খবর দিয়েছে আমাকে প্রসেঞ্জিত। জাপান তার শ্বশুর বাড়ি। তার প্রেসক্রিপশন হলো- বিক ক্যামেরার দোকান থেকে সস্তায় দুই-তিন হাজার টাকায় ডাটা সিম নেয়া। অন্য জায়গায় গলাকাটা দাম।

ওয়েট। ওরা সিমও দিতে পারে।

আমি ঠান্ডা হয়ে ওয়েট করতে থাকি। এর আগে শ্রীলংকার সেমিনারে কলম্বোর বিমান বন্দরেই শ্রীলংকান ইনষ্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট সবার হাতে সিম কার্ডের প্যাকেট দিয়ে দিয়েছিলেন। অন্য জায়গায় সহজে কেনার জন্য এজেন্ট ঠিক করে দিয়েছেন আয়োজকেরা। এখানেও হবে নিশ্চয়।

এসব ট্যুরে আমি  এন্ড-ইউজারের মতো আচরণ করি। কেনাকাটায় যিনি ভালো থাকেন, তাকে বলি, যা কিনবেন আরেক কপি এক্সট্রা রাইখেন আমার জন্য।

আরিফ ভাই মুখ শুকনা করে খুজতে থাকেন ACA-18 (Asian Council of Architects ACA-18) অফিশিয়ালদের। বাকিরা ব্যস্ত হয়ে আছে সিম কেনার জন্য।

আমি নিশ্চিন্তে আপন মনে বসে থাকি। বসে থাকার জন্য কেউ আমার জন্য সোফা পেতে রাখেনি সেখানে। আমারই ঠেলে নেয়া ট্রলির এক কোনায় বসে পড়ি। জাপান নিয়ে তেমন পড়াশুনা করে আসিনি। কিছু বুঝতেও পারছিনা। আমার সামনে অনেক্ষণ ধরে একটা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছেন লাভলু ভাই। তিনি অনেকক্ষণ ধরে টাকা বদল করছেন। কিন্তু টাকা বদল করতে এতো সমস্যা কেন ? আমি কাছে গিয়ে দেখার  চেষ্টা করতেই আমাকে থামানো হয়। পেছনে একটা হলুদ দাগ দেখিয়ে বলা হয়, এই দাগের বাইরে যেন আমি দাঁড়াই, তিনি গেলে আমি আসতে পারবো।

আমি বোঝাতে চাইলাম, আমরা এক দলের।

কাজ হলো না।

আমি দাঁড়িয়ে থাকি আরো ১০ মিনিট। এক সময় লাভলু ভাই এলেন। এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে টাকা ভাঙ্গানোর কাহিনী শোনান। খুব রসিয়ে রসিয়ে বলেন – লম্বা এক্সচেঞ্জের সামনে জানালা ঘেঁষে চারটা কাউন্টারে চারজন বসার ব্যবস্থা। সামনেরজন চিরাচরিত অমায়িক জাপানি হাসি দিয়ে ডলারগুলি নিলেন। তারপর দুবার করে ধীরে ধীরে বেশ সময় নিয়ে গুনলেন। এরপর একটা স্লিপে পেন্সিলে এক, পাঁচ, দশ, বিশ,পঞ্চাশ ইত্যাদি কোনটা কত সংখ্যায় আছে, লিখলেন। এরপর যা করলেন, সেটা আমার এই কুড়ি বছরের বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতায় একেবারেই অনুপস্থিত। পিছনের তাক থেকে একটা মোটা ক্যাটালগের মত নিলেন। তাতে বিভিন্ন  দেশের  নোট আঠা দিয়ে সাঁটানো। তার ভিতর থেকে ডলারের চ্যাপ্টার বের করে প্রতিটা নোট একটা একটা করে তার সাথে মিলিয়ে ইয়েন গুণে দিলেন।

প্রায় সত্তর বছর বয়েসি এই কর্মচারির টাকাগুনার কসরতে কথা শুনে আমরা অবাক। এসময় আরেক তথ্য পেলাম, মুদ্রা বিনিময়ের রেইট জাপানের সব জায়গায় একই, সেটা হোটেল বা এয়ারপোর্ট বা মানি এক্সচেঞ্জের দোকন যা-ই হোক। ব্যাংকে যে রেইট দেবে, যেটা পত্রিকায় ছাপা হবে জাপানের প্রত্যেক জায়গায়- সেটা থাকবে ।  বাহ! এই নাহলে জাপান!

আমি কাউন্টারের দিকে আরেকবার তাকালাম। দেখি ষাট থেকে সত্তর বছর বয়েসী ৪ জন বৃদ্ধ এখানে বসে আছেন। ডানে বামে তাকিয়ে দেখি এই বিমানবন্দরের যতগুলো দোকানপাট তার সব বিক্রেতা, সব স্টাফ ষাট-সত্তর উর্ধ । বিষয় কী ! তরুনদের চাকরি কি এখানে নাই ? নাকি সবাই ডিজিটাল মার্কেটে জব করে আর এ জন্যই এসব বুড়োদের দিয়ে ম্যানুয়েল কাজ কারবার করাচ্ছে এখানে !

বিমান বন্দরের এরাইভাল লাউঞ্জে ‘ACA-18’ লেখা একটা টেবিলে একজন প্রায়সত্তর বছর বয়েসী বসে আছেন, তিনি  ইংরেজী জানেন না। তার সাথে আওয়ার বাস,  হোটেল গো- এই টাইপের কথা বলা হচ্ছে এবং কেউ কোন ভালো জবাব পাচ্ছেন না দেখে আমি খুব মজা পাই। বুঝতে পারি, একটা ভজঘটের মধ্যে পড়ে গেছি সবাই। যেহেতু আমি এন্ড ইউজার হিসাবে শুধু ফলটাই উপভোগ করবো, সুতরাং হোটেলে যাওয়া নিয়ে আমার চিন্তা নাই। আমি মজা পাচ্ছি এই ভেবে যে কীভাবে এই ক্ষণিকের দুর্ভোগ সবাই রেহাই পান, তা দেখতে। সুতরাং হোটেল গোর চিন্তা মাথা না নিয়ে আমি ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে ব্রত হই। ফোনে নেট পেয়ে গেলে আমার জন্য সব জায়গাই সমান।

আমার প্রথম কাজ হচ্ছে একটা সেল্ফিসহ স্ট্যাটাস দিয়ে দুনিয়াকে জানানো যে, আমি এখন টোকিওতে পৌঁছে গেছি। বাংলাদেশের ঘড়িতে যদিও এখন বেলা পৌনে চারটা, টোকিওতে এখন তিন ঘণ্টা পিছিয়ে পৌনে সাতটায় গড়িয়েছে। ঢাকা থেকে বেরুনোর কুড়ি ঘণ্টা পার হয়ে গেছে এরমধ্যে। এখনকত দ্রæত হোটেলে যেতেপারি, সেই চিন্তায় আছি।

আমি বড় দলের কাছে যাই।

দেখি- বড়বড় দলনেতারা সবাই বাইন মাছের মতো মুখ চোকা করে এ-ওরদিকে তাকাচ্ছেন।

আমি বলি, জাপান ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস এর লোকজনকই ?

কেউ কথা বলেনা।

একজন দূরে আংগুল দেখিয়ে বলেন- ঐযে।

আমি দেখি এক দোকানের ডেস্কের উপর অঈঅ-১৮ (অংরধহ ঈড়হমৎবংং ড়ভ অৎপযরঃবপঃ’ং ২০১৮) লেখা একটা সাইনবোর্ড সামনে রেখে সেই দুই বৃদ্ধ বসে আছেন। তাদের সামনে কেউ নাই। নেতারা গিয়ে কথা বলে এসেছেন। কোন অনুরোধ, আবদারে কাজ হচ্ছে না। মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের লেখা ।

১০৩ বছর আগে জাপানিদের সম্পর্কে লিখতে রবীন্দ্রনাথ প্রথম কথা লিখেছিলেন তাঁর জাপানি জাহাজের কাপ্তানকে নিয়ে। খিদিরপুর ডক থেকে জাহাজ ছাড়ার পরের দিন সকাল বেলার কাহিনী। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-

“আমাদের এই জাপানি কাপ্তেনের একটু বিশেষ্যত্ব আছে। মেলামেশায় ভালো মানুষিতে হঠাৎ মনে হয় ঘোরো লোকের মতো। মনে হয়, এঁকে অনুরোধ করে যা-খুশি তাই করা যেতে পারে; কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যায় নিয়মের লেশমাত্র নড়চড় হবার জো নেই। আমাদের সহযাত্রী ইংরেজ বন্ধু ডেকের উপরে তাঁর ক্যাবিনের গদি আনবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের ঘাড় নড়ল, সে ঘটে উঠল না। সকালে ব্রেকফাস্টের সময় তিনি যে- টেবিলে বসেছিলেন সেখানে পাখা ছিল না ; আমাদের টেবিলে জায়গা ছিল, সেই দেখে তিনি আমাদের টেবিলে বসবার ইচ্ছা জানালেন। অনুরোধটা সামান্য, কিন্তু কাপ্তেন বললেন, এ বেলাকার মতো বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, ডিনারের সময় দেখা যাবে। আমাদের টেবিলে চৌকি খালি রইল, কিন্তু তবু নিয়মের ব্যত্যয় হল না। বেশ বোঝা যাচ্ছে অতি অল্পমাত্রও ঢিলেঢালা কিছু হতে পারবে না।“

এখানেও তাই । একসময় সবাই বুঝে ফেলি যে, এখানে কিছুই এমনি এমনি পাওয়া যাবে না। সবই নিজের করে নিতে হবে। এতোক্ষণে ফোনের সিমকার্ড নেয়ার লাইন ছোট হয়ে এসেছে। আমি দোকানের সামনে লাইনে দাড়াই। জিনিসপত্রের দামের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলি- জাপান বেশ ব্যয় বহুলই হবে। ৭হাজারইয়েন (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টাকা) দিয়ে ১০ দিনের আনলিমিটেড ইন্টারনেট সিম কার্ড বিকোচ্ছে। দেশে হলে দেড়শো টাকার সিম আর ৫০০ তাকার প্যাকেজ নিলে সারামাস আরামে নেটানেটি করা যায়। এখানে এটা দশগুণ বেশি। সিমকার্ড কিনে এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে দেখি একটা বেঞ্চির মধ্যে শুকনো মুখে বসে আছেন আমাদের দলনেতা, স্থপতি ইনষ্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট নাসির ভাই, সাবেক তিনবারের প্রেসিডেন্ট মোবাশ্বের ভাই। তাদেরকে নাকি আয়োজকদের দায়িত্বে হোটেলে নেবে।

নিশ্চয়ই মার্সিডিজ বেঞ্চে করে নিয়ে যাবে আপনাদের। তাই না ?

নারিতা বিমানবন্দরে আমাদের প্রথম জাপান পরশ

আরে না। হাসতে হাসতে নাসির ভাই বলেন- আলাদা একটা বাসে করে টোকিও স্টেশনে নিয়ে যাবে,সেখান  থেকে ট্যাক্সি করে হোটেলে পৌঁছাবে তাঁদের খরচে। আর বাকীদের জন্য আকা-১৮র দুই বৃদ্ধ পরামর্শ দিয়েছেন, বাসে করে টোকিও স্টেশনে চলে যেতে, খরচ পড়বে জনপ্রতি ১০০০ ইয়েন। সেখান থেকে ৭-৮০০ ইয়েনে হোটেলে যেতে পারবে ট্যাক্সিতে ৪ জন। ১২০০ ইয়েনের মধ্যে হয়ে যাবে। এটাই সব চেয়ে সস্তা।

আমাদের কেউ কেউ ট্যাক্সি খোঁজার চেষ্টা করলো। ট্যাক্সির ভাড়া নির্ধারণ করা নেই। মিটারে যা আসবে তা। তবে কাউন্টার থেকে বলা হলো- ২৬০ ডলারের মতো ভাড়া পড়বে ট্যাক্সিতে।

ভাড়ার কথা শুনে ট্যাক্সির খায়েশ মিটে যায়।

জানা গেলো আমাদের জন্য বুক করা হোটেলটির একটা শাটল বাস আছে একঘণ্টা পর, সাড়ে আটটায় সেটাতে আমরা যেতে পারি, তবে এজন্য বাস ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ৩১০০ ইয়েন। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৫০০ টাকা !

পাঁচতারা হোটেলেও অগ্রিম ৫ রাতের কনফার্ম বুকিং এর পরেও ফ্রি শাটল নাই ! কী কনজুসরে বাবা !

জাপানে ঢুকেই দেখি খালি ইয়েন আর ইয়েনের বেসাতি। বুঝে ফেলি-বেশ ব্যয় বহুল একটা শহরে এসে ঢুকে পড়েছি। মাথা যখন ঢুকেই গেছে, শরীরটা আর দিতে বাকী কেন ? আমরা বাসে উঠে পড়ি।

ইন্টারনেট চালু হয়ে গেছে আমাদের ফোনে। গুগল ম্যাপ বলেছে এখান থেকে টোকিও নিউ ওটানি হোটেল ৮৭ মাইল। যেতে সময় লাগবে ১ঘণ্টা ৩৫মিনিট।আমাদের বাস ছুটে চলে। আমরা খুব ক্ষুধার্থ।

এমন সময় আমার ইনবক্সে একজন নক করে। নাম দাশ নিরুপম। লিখেছে- – Tokyo te kothay achen? Koto din thakben?

আমি নামের উপর চাপ দিয়ে দেখি- এডফ্রেন্ড। তারপর দেখি তার অবস্থান- টোকিও। আমি প্রথমেই একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে তার কথার জবাব দেই।

– এখনো টোকিও যাইনি। পথে আছি। হোটেল ওটানিতে উঠবো। ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টোকিও আছি।

– Ami dekha korbo hotel e. .amar number………

– টোকিও এসে হোটেল থেকে ফোন দিব। এই সিম থেকে ফোন দেয়া যায়না

– Sure. Amr office apnar hotel er kacha kachi

– ঠিক আছে। দেখা হবে।

আমাদের কথা চালাচালি বন্ধ। আমরা সিটবেল্ট বাঁধা বাসের সিটে বসে প্রায় হইচই শুরু করে দেই। কারণ এই বাসে আমাদের গোটা তিরিশেক ছাড়া আর ভিন্দেশি আর কোন যাত্রী নেই। বাস ছুটে চলে। এর মধ্যে আবার ফোনে শব্দ হয়। দেখি নিরুপম ইনবক্সে লিখেছে

– Afnara khaisoinni

– (আরে ! এ দেখি সিলেটী মাতে ! আমি লিখি) না।

আমাদের বাসে এখন আলোচনা একটাই। রাতের খাবার কোথায় হবে ? আমি জানাই আমার নতুন ফেইসবুক বন্ধুর কথা। পেছন থেকে আরিফ ভাই আওয়াজ দেন- তারে দিয়া খবর লাগাও, ফার্স্টক্লাস একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিতে। নেমেই খাবো আগে তারপর রুমে যাওয়া।

আমি নিরুপমকে বলি- আমরা খুব ক্ষুধার্থ। আমাদের হোটেলের আশেপাশে কোন হোটেলে কি খেতেপারি?

নিরুপম জানায়- টোকিওতে রাত ৯ টার পর কোন রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে না। সে জানতে চায় আমরা যা খেতে চাই তাকে জানালে সে হোটেলে নিয়ে আসবে।

আমি লিখি- নিঊ ওটানিতে আমরা ৮ জন থাকবো। কিন্তু কোথায় খাবো এটা তুমি ঠিক করে দিও।

– ঠিক আছে ।

নারিতাতে যখন গুগল ম্যাপের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমাদের হোটেল নিউ ওটানিতে কখন পৌঁছাবো, সে জানিয়েছিল পৌঁছার সম্ভাব্য সময় রাত ১০টা ১৫ মিনিট। পথে আরো তিন হোটেলের মুখে আমাদের আরো লোকজনকে নামিয়ে এই হোটেলের সামনে যখন শেষ যাত্রীদের নামাতে বাস এসে থামলো তখন ফোনের দিকে চেয়ে দেখি ১০টা ১৬ মিনিট বাজে। এবার আর অবাক হলাম না। বুঝলাম, জাপানকে আরো মনোযোগ দিয়ে বুঝতে হবে আমাদের।

এস্কেলেটর দিয়ে উপরে উঠে রিসিপশন লাউঞ্জ। বিশাল লাউঞ্জ । আমি একটা সোফায় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি। আমার পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে হোটেল রিসিপশনের কাউন্টারে। মজার মজার এক্সেন্টে ইংরেজি বলা হচ্ছে, আমি শুনি।

এরমধ্যে দেখি বাঙালী চেহারার এক যুবা এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। তার হাতে দুইটা ব্যাগ। আমার দিকে চোখাচোখি হতেই খাস সিলটি ভাষায় কথা বলে- আমি নিরুপম । এরপর হাত বাড়িয়ে দুই ব্যাগ আমার কাছে দিয়ে বলে এখানে ৮ প্যাকেট বিরিয়ানী আছে। এটা ছাড়া আর কোন খাবার আজ রাতে কোথাও পাওয়া যাবে না।

আমি কী করে তাকে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারি না। ধন্যবাদ দেয়ার আগে পেছন পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগ বের করার চেষ্টা করতেই আমাকে আটকে দেই নিরুপম।

নিরুপম দুই হাত জোড় করে আমাকে দেখায়। আমি বুঝে ফেলি। এটা আমাদের সিলেটী বিষয়-আশয়। এখানে এভাবে দিতে চাওয়াও আপ্যায়কের জন্য অপমানের।

খানিক পরে নিরুপমের সাথে দলের লোকজনের পরিচয় হয়। সে বলে- আপনারা এখন ক্লান্ত। কাল সাড়ে পাঁচটা থেকে আমি ফ্রি আছি। আমাকে ফোন করলেই চলে আসবো। নিরুপম চলে যায়। আমরা রুমে যাবার জন্য লিফট খুঁজি। জাপানকে বুঝে ওঠার অনেক কিছুই বাকী।

ওটানি বেশ নাম করা হোটেল টোকিওর। আয়তনে বেশ বড়। ৩-৪ একর জায়গা নিয়ে হবে। নেটে এই হোটেলের খবর নিয়েছি। টিকেট কেটে পর্যটক আসে এই হোটেলের আশপাশের পরিবেশ দেখতে। হোটেলটিতে সারাদিন কাটিয়ে দেয়ার মতো নানা বন্দোবস্ত আছে। ৪০০ বছরের পুরনো জাপানি বাগান এই হোটেলের প্রাণ। স্থাপত্য কংগ্রেসের অফিশিয়াল এই হোটেল। ভাড়া কমিয়ে যা রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশি টাকায় রাত প্রতি  ২৪ হাজার টাকা। ৫ রাতের জন্য বুক করা এই হোটেলে এসেছি আমরা বাংলাদেশি ১২ জন। অন্যরা আছে অন্য হোটেলে।

আমরা রুমে যাবার পথ খুজি। করিডোর মাড়াতে মাড়াতেই খাস অভিজাত জাপানি গন্ধ পেয়ে যাই। মখমলি কার্পেট, যেনো তাজা ফুলের পাপড়ি ছিটানো। দীর্ধ করিডোর মাড়িয়ে আরেকটা ৫৬ তালা টাওয়ারের ২৮ তলায় পড়লো আমাদের ঘর ।

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে টোকিওর প্রথম রাতের আস্বাদন। হোটেল থেকে দেখা রূপ

ঘরে ঢুকেই আরিফ ভাই জানালার টানা পর্দা সরিয়ে দিলে ২৮ তলার উপর থেকে দেখা হয় টোকিও ডাউন টাউনের আকাশ রেখা। বেশ শিহরণ লাগে এটা দেখতে। কল্পকাহিনীর মতো যে জাপানের কথা এতোদিন শুনেছি বা পড়েছি, কাল থেকে তাকে বোঝার জন্য বেরিয়ে পড়বো। বাকী রাত আমাদের ঢাকাইয়া আড্ডা চলবে এই ঘরেই। কাল আমাদের টোকিওর ঘ্রাণ নেবার দিন। পরশু থেকে কংগ্রেসের সেমিনার। কাল সকালে সাড়ে আটটায় শেষ বাস ছাড়বে এই হোটেল থেকে। এই বিবেচনায় মাঝ রাতের একটু পরে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।

টোকিওর ঘ্রাণ

অচেনা শহরে নেমেই প্রথম বন্ধুত্ব হয় এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে আসার পথের ট্যাক্সির ড্রাইভারের সাথে। এবার এখানে সেই সুযোগ ছিলো না, আমরা এসেছি বাসে। পরদিন সকালবেলা আরেকটি বাস আমাদের নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কনফারেন্সের ভেন্যুতে। সাড়ে সাতটা থেকে বাস চলেছে, শেষ বাস যখন ছাড়ে তখন জাপানের সময় সকাল সাড়ে আটটা। আমাদের শরীর ঘড়িতে তখনো বাংলাদেশের টাইম, ভোর সাড়ে পাঁচটা, সুতরাং আমাদের অনেকেই কোনমতে তাড়াহুড়ো করে দশটার পাঁচ মিনিট আগে রেস্টুরেন্টে পৌঁছে নাস্তাটা ধরেছিলো বটে, বাস পায়নি। দেরী যখন হয়েই গেলো, আমরা পাঁচ জন ঠিক করলাম ট্যাক্সি করেই যাই। হোটেল থেকে ৫ মাইল দূরের মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৫ মিনিটে আমাদের নিয়ে যাবে।

হোটেল ওটানি থেকে দেখা টোকিও প্রথম ঘ্রাণ

হোটেলের লবির বাইরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই একটা ট্যাক্সি এসে হাজির, ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে যাবার পর ওটোমেটিক বাম দিকের একটা দরোজা তার খুলে যায় এবং আমরা হুড়মুড় করে উঠে বসে পড়ি। সামনে আমিই বসি, আমার হাতে ক্যামেরা, পেছনে ৪ জন উঠে পড়ে। ট্যাক্সির দরোজা লাগানো যায় না। ট্যাক্সিওয়ালা কী যেন বলে,আমরা তাঁর ভাষা বুঝি না। ট্যাক্সিতে ৫ জন উঠে বসে আছি, পেছনের দরোজা লাগছে না, ট্যাক্সিও ছাড়ছে না। ট্যাক্সিওয়ালা যা বলছে টা বুঝতে না পারার কারনে হোটেলের এক স্টাফ আমাদেরকে এসে উদ্ধার করেন। বলেন- জাপানে ট্যাক্সিতে ৫ জনের বেশি বসা যাবে না। বাচ্চা শিশু হলেও না। ৫ জন মানে ৫ জন, এর নড়চড় নাই। সামনে ড্রাইভারের সাথে বসেছি আমি। পেছনে চাপাচাপি করে ৪ জন বসে গেছে। কিন্তু এটা নিয়মে নাই। জাপানে কাপকাপ করা চলেনা। সুতরাং আমাদের দুই জন নেমে গিয়ে অপর ট্যাক্সি ধরলে ওটোমেটিক দরোজা আবার বন্ধ হয়।

আমাদেরকে এবার ড্রাইভার জিজ্ঞাস করেন কিছু একটা।

অনুমান করে জবাব দেই – মেইজি ইউনিভার্সিটি।

এই প্রথম আমার কোন জাপানির সাথে কথা বলা।

আগেও বলেছি- কোন দেশে নামার পরে প্রথম বন্ধুত্ব হয় ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে। একদিন পরে সযোগ পেলাম সেই বন্ধুর সাথে কথা বলতে।

এই বন্ধুর বয়স আমার চেয়ে একটু বেশিই হবে। পোষাকে আশাকে আমার চেয়ে অনেক স্মার্ট। সাদা ধবধবে ইস্ত্রি করা ফুল হাতা শার্ট। কালো টাই। প্যান্ট আর জুতা দেখি নি। ফর্সা নাক বোচা চেহারা। চালাচ্ছেন বি এম ডবলিউ । আমি আলাপ শুরুর জন্য জিগ্যেস করি। এ জায়গার নাম কি হয় মহাশয় ?

তিনি নিশ্চুপ।

এবার তাঁর দিকে তাকি বলি- আপনি ইংরেজি জানেন ?

এ কথা মানে তিনি বুঝেছেন। আমার দিকে তাকিয়েই বলে বসেন – নো নো, নো ইংলিশ।

কপাল খারাপ আমার। এই লোকের কাছ থেকে আর কিছুই আমার জানা হবে না।

আমি চুপ চাপ সামনের সীটে বসে আমার ক্যামেরার দিকে মনোযোগ দেই।

এবার আমি ভিন্ন রকমের ক্যামেরা নিয়েছি। ২০০১ সাল থে ভিডিও ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার দিয়ে বিদেশ দেখা শুরু করেছিলাম। মিনি ডিভি ক্যাসেটে আমার দেখা দৃশ্য ভরে রাখতাম। ২০১৪ সাল থেকে ভারি ক্যামেরা খানিক সরিয়ে ডিএসএলআর-এ হাত দিয়েছে। গত বছর থেকে প্রেমে পড়েছি ওজমো প্লাস- এর । এটার অনেক সুইধা। ২৭০ ডিগ্রিতে তিন এক্সিসে এরে নিয়ে ছবি তোলা যায়। ওজনেও হালকা । আমার জন্য যুতসই। আর এই ক্যামেরা আমার সাথে থাকে বলেই দলের কনিষ্ঠ সদস্য হয়েও সামনের সীটে আমার জায়গা হয়ে যায়। আর আমি অনেকের চেয়ে অনেক বেশি আরাম করেই বিদেশ দেখি।

এখন আমার দেখার জন্য আছে সকাল বেলার টোকিও শহর আর আমার জাপানি শোফার। জাপানি শোফারের নাম জানি না। আমার সামনেই তাঁর লাইসেন্স বাধাই করে রাখা আছে। সেখানে তাঁর টাই পরা আরেকটু কম বয়সের একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি আছে, আছে একটা রেজিস্ট্রেশন মানবার আর একটা ফোন নাম্বার। আর আছে এই লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, সেটা ৩৪-০২-১২ । মানে ২০৩৪ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত । জাপানিরা বছর-দিন-মাস , এভাবে তারিখ লেখে। আমার দৌড় এ পর্যন্তই। আমি এর বেশি কিছু পরতে পারি না। বাকি সবকিছু জাপানি ভাষায় লেখা। আমি লাইসেন্স থেকে চোখ সরিয়ে টোকিও দেখি।

আমরা যে শহরকে টোকিও নামে ডাকি, জাপানিরা তাকে বলে তৌক্যৌ মানে – পূর্বদিকের রাজধানী। পূর্ব এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র জাপানের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী এই টোকিও। সরকারীভাবে এটি তৌকিও-তো  অর্থাৎ টোকিও মহানগরী নামে পরিচিত। জাপানের ৪৭টি জেলার একটি এই টোকিও বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলির একটি। আয়তনে ঢাকা থেকে প্রায় ৫০ বর্গমাইল কম। প্রায় ৪ হাজার বছর আগে থেকেই এখানে মানুষের বসতি ছিল। এর নাম ছিলো এদো। কিন্তু তখন ছিলো এটি নিখাদ একটি জেলে পাড়াই। রবীন্দ্রনাথে যখন ৭ বছর বয়স, ১৮৬৮ সালে কিয়োতো শহর থেকে তোকুগাওয়া রাজবংশ (১৬০৩-১৮৬৭) ক্ষমতাচ্যুত হয়, শোগুনাতের পতন ঘটে এবং সাম্রাজ্যের রাজধানীকে এদোতে সরিয়ে নেওয়া হয়। ঐ বছরেই শহরটির আদি নাম এদো থেকে বদলে টোকিও রাখা হয়। টোকিওতে নাম বদল হবার আগেই ১৭শ শতক থেকেই এদো জাপানের বৃহত্তম শহর ছিল। ১৯শ শতকের শেষে এসে শহরটির জনসংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। এখন এ শহরে ১ কোটি ৩০ লাখ লোকের বাস, যাদের অর্ধেক থাকে মাটির উপর, অর্ধেক মাটির নিচে। ঘন বসতির এই শহরে যে পরিমান লোকের মাটির উপরে থাকার কথা, সে পরিমান জায়গা নেই বলে এই ভর দুপুরেও রাস্থাঘাট যথেষ্ঠ ফাঁকা। ট্রাফিক সিগনাল খুব পড়ার সুযোগ নাই। যেখানেই রাস্তার ক্রসিং সেখানেই ফ্লাই ওভার। আমরা জানি মাটি ফুড়লে আমাদের শ’ খানেক ফুট নিচে গেলেই পাওয়া যাবে হাজার হাজার লোক চলাচল করছে।

আমাদের ট্যাক্সি ছুটে চলে এই যানজটহীন শহরের উচু উচু দালানের পাশ দিয়ে। মিনিট পাঁচেক গাড়ি চলার পর একটা খানদানী ট্যুরিস্ট স্পট আমাদের চোখে পড়ে । বেশ কিছু লোকজন দল বেঁধে হেঁটে যাচ্ছেন। সবার পোষাকে বেড়ানর ভাব। খোকন ভাই নিশ্চিত হয়ে বলেন- এটাই সেই রাজবাড়ী। জাপানের রাজা এই বাড়িতেই থাকেন। কিয়োতো থেকে এসে ১৮৬৮ সাল থেকে এখানেই রাজত্ব করছেন। চল, দেখে আসি রাজা কে।

খোকন ভাই এটা বলেও বুঝেছেন, তাঁর কথায় আমল দেবার সুযোগ কারোই নাই। তবে এই রাজবাড়িটি আমরা দেখবোই। যদিও স্বয়ং রাজা থাকেন বলে তাঁর অন্দর মহল পর্যন্ত যাওয়া যাবে না, তাও যতটুকু পারা যায়।

আমাদের মধ্যে থেকে একজন প্রশ্ন উঠলো- জাপানে কি তাহলে রাজাদের সামন্ত শাসন এখনো আছে?

এই প্রশ্ন করা যেত আমাদের ড্রাইভারকে। এরকম পর্যটনবান্ধব শহরের যেকোন ক্যাব ড্রাইভারই অর্ধেক ট্যুর গাউডের কাজ করে ফেলেন, কিন্তু এখানে তিনি নীরব। এক দুই কথা বলে বুঝে ফেলেছি, থাঙ্ক ইউ ছাড়া আর কোন ইংরেজি শব্দ তিনি জানেন না। তবে আমরা যতটুকু জানি, তা হলো জাপান সরকার একটি সংসদীয় রাজতন্ত্র, অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় সম্রাটের ক্ষমতা মূলত আনুষ্ঠানিক। ১৯৪৭ সাল থেকে এভাবেই জাপান শাসিত হচ্ছে। সরকার চালানোর প্রকৃত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অধীনস্থ মন্ত্রীদের দ্বারা পরিচালিত ক্যাবিনেটের হাতে অর্পিত। ক্যাবিনেট দেশের শাসন বিভাগের সমস্ত ক্ষমতার উৎস । জাতীয় সংসদ প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচন করে এবং তাঁকে তাঁর পদে নিয়োগ করেন সম্রাট।এই সম্রাটের ক্ষমতা নাই রাস্ট্র পরিচালনার, কিন্তু সম্মান আছে। জাপানের লোকেরা তাঁদের রাজাকে খুব মানে। বর্তমানে যে রাজা এই বাড়িতে থাকেন তাঁর বয়স হয়ে গেছে অনেক, এ ছাড়া তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। রাজকার্য তাঁর ভালো লাগছে না। তিনি রাজত্ব ছেড়ে দিতে চান। কিন্তু ছাড়ার উপায় নাই। রাজা হবার নিয়ম আছে কেতাবে, রাজাগিরি ছেড়ে দেবার নিয়ম লেখা হয়নি। যিনি প্রথম লিখিয়ে ছিলেন- তিনি লিখিয়েছেন যে, আমৃত্যু রাজা রাজাই থাকবেন। তিনি মরে গেলে তাঁর বড় ছেলে রাজা হবে এবং আমৃত্যু রাজা থাকবে। রাজার কোন মেয়ে রাজা হতে পারবে না। পুত্র সন্তান না থাকলে ভাইদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড় সে হবে রাজা। কিন্তু এই রাজার তাঁর ষাটোর্ধ পুত্রকে রাজা বানিয়ে নিজে অবসরে যেতে চান বলে সংসদে নতুন আইন পাশ করিয়েছেন, এটা পাশ হলে তিনি রাজমুকুট পরিয়ে দেবেন তাঁর পুত্রকে ।

আমার খুব ইচ্ছা করে ভেতরে গিয়ে এই রাজাকে দেখে আসি। শুনি, এই রাজবাড়ির একেবারে ভেতরে যাওয়া যাবে না, এখানে রাজা থাকেন। কিন্তু এর চেয়ে অভিজাত রাজবাড়ি, রাজার ঘর আছে কিয়োতোতে। সেখানে রাজা থাকেন না, দেড়শো বছর আগে সেই রাজবাড়ি শূণ্য হয়ে গিয়েছিল, কিয়োতোতে গিয়ে সেটা দেখে আসব।

আমাদের ট্যাক্সি চলে আসে মেইজি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছাকাছি।

মিটারে ভাড়া ওঠে ২০০০ ইয়েন। আমরা যেই নামতে যাবো, আমাদের একজন বলে ওঠেন, এটা এক্সিট গেইট, এন্ট্রি গেইট ঐ পরেরটা, অর্থাৎ একটা প্লটের এ মাথা থেকে সে মাথা। কয়েক গজ দূরে নিয়ে যখন ট্যাক্সি থামালো তখন ভাড়া হয়ে গেলো ২১০০ ইয়েন।

টোকিওর ট্যাক্সি ভাড়ার হিসাব জেনে গেছি। গাড়িতে উঠলেই ৪৮০ ইয়েন উঠে যায়, এটা প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া। এরপর প্রতি ২৫০ মিটারে ভাড়া উঠে ৯০ ইয়েন করে, তরতর করে বাড়তে থাকে মিটার। ট্রাফিক সিগনালে আটকা পড়লেও হালকা হয়ে মিটার বাড়ে। ভাড়া নিয়ে দরাদরি করার সুযোগ নাই। পকেটে ক্যাশ না থাকলে ক্রেডিট কার্ডে ভাড়া দেয়া যায়। এই হলো টোকিও ট্যাক্সির অবস্থা। তারপরও ৩৫ হাজার ট্যাক্সি এই শহরে প্রতিদিন চলে। নানা কো¤পানীর ট্যাক্সি আছে এখানে । একজন ট্যাক্সি চালক বছরে ৪০ হাজার ডলারের মতো বেতন পেয়ে থাকেন।

ট্যাক্সি থেকে নেমেই দেখি ACA-18 প্ল্যাকার্ড হাতে এক প্রৌঢ়া হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। কাল থেকে এশিয়ার ২১ টি দেশ থেকে আসা প্রায় আড়াইশো নিবন্ধিত স্থপতিদের তিন দিনের মেলা বসবে এই খানদানী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। আজ অনানুষ্ঠানিক পরিচয়পর্ব। আমরা মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ি।

মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। ট্যাক্সি থেকে নেমেই দেখি ACA 18 প্ল্যাকার্ড হাতে এক প্রৌঢ়া হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।

মেইজি বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণেই টোকিওর বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮৬৮তে মেইজি রাজবংশ এই টোকিওতে তাঁদের রাজত্ব শুরু করার বছর কয়েক পরেই, ১৮৮১ সালে এখানে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। আদিকালে এর কী রূপ ছিল তার ছবি দেখেছি। দুই পাশে কাঠের দুই পিলার, উপরে আড়াআড়ি আরেকটা কাঠ। এই নিয়ে ছিলো তার গেট, ভেতরে কাঠের একতলা ঘর, টালির ছাদ। সেই রূপ ভেংগে এখন এটা সু-উচ্চ দালান। ৪ টা টাওয়ার, লিফ্ট্ এস্কেলেটরে ছড়ানো তাঁর চত্বর। ৩২ হাজার ছাত্র-ছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু চলাচলের যে বন্দোবস্তো রাখা হয়েছে তাতে কোথাও ধাক্কাধাক্কির কোন সুযোগ নাই।

সেমিনারের স্যুভেনির আর কিট বিতরন করছে এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী। এখানে জাপান স্থপতি ইনষ্টিটিউটের কাওকে নাক গলাতে দেখি না। নিজের পাসপোর্ট দেখিয়ে দেয়ার পরই কোন কথা না বলে ভারি একটা কালো রঙ-এর ঝোলা ধরিয়ে দেন আমাদের হাতে। সেমিনারের যাবতীয় বিশয়-সহ জাপানের কোথায় কী আছে, কিভাবে যেতে হবে তার স্যুভেনিরও আছে এখানে।

এই বিশাল ঝোলা নিয়ে এখন কী করি ? বেলা দেড়টা থেকে তারা আমাদের বাস আর ফেরিতে করে সড়ক ও নদীপথে টোকিও দেখাবে। আমরা বসে থাকবো বাস আর ফেরিতে, তারা শহরের গল্প শোনাবে । আমরা বলি, এগুলো এখানে থাক, ফিরে এসে যাবার সময় নিয়ে যাব- এই বলে আবার তাঁদের কাছে রেখে হাওয়া খেতে বেরুই।

মেইজি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর

টোকিও ট্যুর

বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের হাতে  ৩০ মিনিটের মতো সময় আছে। ক্যাম্পাসের একটু বাইরে একটা সিড়ির উপর, গাছের তলায় এসে বসে পড়ি কয়েকজন। অনেকের সিগারেটের খুব তেষ্টা পেয়েছে। সিগারেট খাওয়ার মতো জায়গা পাচ্ছে না। খোলা জায়গা দেখে যেই না কেউ একজন সিগারেট ধরিয়ে বসলে, এমনি ভেতর থেকে সেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের এক তরুণী এসে বললেন- এখানে কি কেউ সিগারেট খাচ্ছেন ?

এর মধ্যে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে সিগারেট। তিনি বললেন, – না তো।

তরুণী বলল, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমাকে বলা হয়েছিলো এখানে কেউ সিগারেট খাচ্ছেন। যাই হোক, যদি কেউ সিগারেট খেতে চান, তাহলে ঐ বিল্ডিং এর নয় তালায় সিগারেট খাওয়ার ঘর আছে সেখানে চলে যেতে পারেন। এটুকু বলেই তরুনী চলে গেলো।

আমাদের মধ্যে যিনি আসলেই সিগারেট খাচ্ছিলেন তিনি এবার মনে মনে লজ্জ্বা পেয়ে গেলেন। লজ্জ্বা পেলেন এই ভেবে যে, মেয়েটিকে যে হালকা মিথ্যাটুকু বলা হয়েছিলো তা সে বিশ্বাস করে ফেলেছে। তাঁর কাছে মিথ্যা বলাটা ঠিক হয় নি।

আমাদের আলোচনা যখন এই পর্যায়ে, তখন আমাদের সামনে দিয়ে বাঙালী চেহারার এক ভদ্রলোককে চলে যেতে দেখে আমরা থামালাম। নাম বললেন, বাচ্চু ভাই। ৩২ বছর ধরে জাপানে আছেন, ব্যবসা করেন। তিনি আমাদের নাসির ভাইয়ের বন্ধু। দেখা করতে এসেছিলেন নাসির ভাইয়ের সাথে। চলে যাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে পথ ঘুরে এসে দাঁড়ালেন। আমরা তাকে নিয়ে আড্ডায় বসে পড়ি।

মেইজি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বাংলাদেশী স্থপতিকূলের আড্ডা

বাচ্চু ভাই বলেন, জাপানে ঘরের মধে সিগারেট খেতে হয়, বাইরে না। এখানে পাবলিক প্লেসে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। ধরা পড়লে ৫ হাজার ইয়েন তাৎক্ষণিক জরিমানা। ট্রেনে-বাসে দূরের কথা, রাস্তায় বা পার্কেও সিগারেট খাওয়া যাবে না। যেখানে সিগারেট বিক্রি হয় তাঁর কাছিকাছি জায়গায় সিগারেট খাওয়ার ছোট্ট জায়গা থাকে, সেখানে খেয়ে যেতে হবে। সিগারেটের এশট্রে আর কোথাও পাবেন না। জাপানের রাস্তা ঘাটে বা পার্কের কোথাও ডাস্টবিন দেখবেন না। ময়লা ফেলার কোন ঝুড়ি তারা কোথাও রাখে না, কারণ ময়লা কেউ কোথাও ক্যারি করে না- এই বলে নিজের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটের মতো একটা ছাইদানী বের করে দেখান। বলেন- এ রকম মোবাইল ডাস্টবিন আমরা ক্যারি করি। চিপাচাপা পেলে কোথাও দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়ে ফেলি আমি নিজেও, কিন্তু ছাই তো আর ঘাসের উপর ফেলতে পারি না। এজন্য এটা রাখি।

জিজ্ঞেস করি-  ভাই, আপনি তো জাপানে ব্যবসা করছেন- জাপানে বসে ব্যবসা করতে কেমন লাগে, জাপানিদের সাথে ?

মজা করে তাকালেন বাচ্চু ভাই। বলেন, এখানে ব্যবসার আরাম একটাই, এখানে ব্যবসা করতে মিথ্যা কথা বলা লাগে না, জাপানিরা মিথ্যা কথা কী জিনিস জানে না- সবচেয়ে আরাম এটা।

বাচ্চু ভাইর সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা হয় না। আমাদের ডাক আসে। বাস রেডি হয়ে আছে । এই বাসে করে আমাদের টোকিও শহর দেখানো হবে। আমরা উঠে পড়ি। কয়েক গজ হেঁটে প্লাজা পার হয়ে একটা বড় ফুটপাত আছে। তা পার হয়ে বৃক্ষায়ণের জায়গা আরো কয়েক ফুট, তারপর আবার পায়ে হাঁটা পথ। তারপর রাস্তা। আমি দাঁড়িয়ে থাকি, আমার হাতে নতুন কেনা অসমো প্লাস। এই ক্যামেরা আমার ফোন দিয়ে চলে, ওজনে হালকা। আমি এক হাতে এটা চালাতে পারি। ফোনের সাথে একটা সেলফি স্টিক লাগানো থাকলে যেমন ওজন হয়, এটা এর চেয়ে খুব বেশি ভারী নয়।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে একবারেই টের পেয়ে গেলাম, প্রায় একশো বছর আগেই যখন এ শহরের নগর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তখনই গাড়ি চলার পর দুই পাশে আরো দুই প্রশস্থ লেন রেখে দেয়া হয়েছিল, যেখানে মানুষ পায়ে হাঁটবে। পায়ে হাঁটার পথের সাথে লাগানো সাইকেলের পথ, আছে গাছপালার ছায়াও। সব মিলিয়ে গাড়ি চলার সমান গুরুত্ব দিয়ে পায়ে চলারও রাস্তা। এ রাস্তার কোন পাশ দিয়ে মানুষ পায়ে হাঁটবে আর কোন পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাবে তার নির্দেশিকা দেয়া। দুইপাশের মাঝখানে হলুদ দাগ। আর ফুটপাথ থেকে কেউ যাতে রাস্তায় নেমে যেতে না পারে তার জন্য আছে বেরিকেড। এই বেরিকেডের অংশ কোথাও সাধারন গ্রীল দিয়ে আটকানো, কোথাও বা গাছপালা দিয়ে আলাদা করা। দেখেই বোঝা যায়, জেব্রা ক্রসিং ছাড়া পায়ে হেঁটে সড়কের এপার ওপার হবার কোন সুযোগ দেয়াই হয়নি। রাস্তা দিয়ে অতি ঘনবসতির এই শহরে কেমন শান্তভাবে গাড়ি চলে, আবার ফুটপাত ধরে মানুষও হেঁটে যায়।

এ রকম শান্তশিষ্ঠ্য রাস্তা দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথও, ১৯১৬ সালে। লিখেছিলেন –

একটা জিনিস এখানে পথে ঘাটে চোখে পড়ে। রাস্তায় লোকের ভিড় আছে, কিন্তু গোলমাল একেবারে নেই। পথের মধ্যে হঠাৎ একটা বাইসাইকেল মোটরের উপরে এসে পড়বার উপক্রম করলে, আমাদের দেশের চালক এ অবস্থায় বাইসাকেল-আরোহীকে অনাবশ্যক গাল না দিয়ে থাকতে পারত না। এ লোকটা ভ্রƒক্ষেপমাত্র করলো না। এখানকার বাঙালিদের কাছে শুনতে পেলুম যে, রাস্তায় দুই বাইসাকেল, কিম্বা গাড়ির সঙ্গে বাইসাকেলের ঠোকাঠুকি হয়ে যখন রক্তপাত হয়ে যায়, তখনো উভয় পক্ষ চেঁচামেচি গালমন্দ না করে গায়ের ধুলো ঝেড়ে চলে যায়।

১৯১৬ থেকে ২০১৮। ১০২ বছর পরে এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ যদি আবার এই টোকিও শহে এসে পড়তেন, খুব কি পরিবর্তন দেখতেন ? নাহয় গাড়ির মডেল বদল দেখতেন, সাইকেলের মডেল বদল দেখতেন, সাইকেলে ইঞ্জিন লাগার বিষয়টা দেখতেন, চরিত্র বদলের কিছুই বোধ হয় তাঁর চোখেই পড়তো না। আদিকাল থেকে একই রকমের জাপানি রয়েই গেছে।

বাসের ভেতর উল্লসিত যাত্রীরা

আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আয়া নামক এক তরুণী আমাদের গাইড করছেন। বাস ছাড়ার আগে তিনি প্রথমে নিশ্চিত হলেন যে যাত্রীদের সবাই সিট বেল্ট লাগিয়েছে কী না। এ রকম ৩০ সিটের বাসে চড়ার সময় আমরা কেউ সিটবেল্ট বাঁধিনা। এটা শুধু বাংলাদেশেই না, ইউরোপ আমেরিকার কোন পাবলিক বাসে সিটবেল্ট বেঁধেছি বলে মনেও করতে পারি না, কিন্তু জাপানে নাকি সিটবেল্ট বাঁধা ফরজ। প্লেনের হোস্টেসের মতো একে একে সবার কোমর বন্ধনী পরীক্ষা করার পরই তবে গাড়ি ছাড়ার হুকুম পেল।

গাড়ি ছাড়তেই ক্রমাগত আমাদের সামনে দিয়ে, ডানে বামে দিয়ে শহর পার হয়ে যায়। গাইড আমাদের শহরের ইতিহাস শোনায়, নিয়ম কানুনের কথা বলে। জাপানের জনসংখ্যা নিয়ে বলতে গিয়ে গাইড শোনায় ভারি মন খারাপের কথা। সে আমাদে বেø যে জাপানে ২৫% এর বেশী হচ্ছে সিনিওয়র সিটিজেন, যাদেও বয়স ৬৫র বেশি। সে তুলনায় তরুণদের সংখ্যা অনেক কম। মাত্র পোনে তের কোটি লোকসংখ্যা নিয়ে চিন্তায় আছে এই দেশ। এই শহরের মানুষের গড় আয়ূ দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে, জন্মহার কমে যাচ্ছে। যেমন মানুষ মরছে তারচেয়ে কম মানুষের জন্ম হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে, এই হারে মানুষ কমতে থাকলে একদিন জাপান জনশূণ্য হয়ে যাবে, তাদের এই স¤পদ খাবে কে ?

 

এটা তো আর বলার বাকি নাই যে, বর্তমানের জাপান পৃথিবীর একটা অন্যতম বড় শক্তি। সে ধারেও কাটছে, ভারেও। এমন না যে সৌদীর মতো মাটির তলার খনি ভাঙ্গিয়ে বড় লোক হয়ে গেছে, নিজের কোন মেধা তাদের যোগ করতে হয় নি।

এই জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশ শুরু হয়েছিল এদো যুগে। এরপরে ১৮৬৮ সাল থেকে মেইজি যুগে জাপানের অর্থনীতি প্রসার লাভ করে। এই সময় জাপান বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করেছিল। সেই সময় থেকেই জাপান এশিয়ার সর্বাধিক সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত জাপানের সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশ শুরু হয় জিডিপির হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর জাপানই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের পর চতুর্থ বৃহত্তম জাতীয় অর্থনীতি।

টোকিও ২০১৮

২০১০ সালের হিসেব অনুসারে, জাপানে শ্রমিক সংখ্যা ৬৫.৯ মিলিয়ন। এ দেশে বেকার নাই বললেই চলে, মাত্র ৪%। মাথাপিছু আয় প্রায় ৪০ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশের চেয়ে ২০ গুনের বেশী। তারপরও জাপানের তরুণ-তরুণীরা বিবাহে খুব আগ্রহী না, যে কারণে শিশু জন্মের হার অনেক কম।

আয়া আমাদের এও শোনায় যে জাপানের ছেলেরা বিয়ে করতে চাচ্ছে না ইদানিং। সে কারনে জন্মহারও বাড়ছে না। এমন কথা শোনার পর হাসির রোল পড়ে যায় সারা বাস জুড়ে। কেউ কেউ বাংলাদেশ থেকে মাইগ্রেট কওে জাপানে এসে জনসংখ্যা বাড়ানোর কাজে জাপানকে স্বেচ্ছাশ্রম দেবার ইচ্ছার কথা শোনান। কেউ কেউ অনেক কথা বাংলাতেই বলেন।

আয়া খুব মজার উচ্চারনে ইংরেজি বলে । প্রথম বাক্যটা ছিলো, আই এম ইউর টুয়ার গাইড আয়া।

বুঝলাম, তাঁর ইংরেজি সামান্য কস্ট করে বুঝতে হবে। এটা জাপানি ইংলিশ হয়তো। আরব দেশে গিয়েও আরবী ইংরেজী বুঝতে খানিক কষ্ট হয়েছিল, পরে ঠিক হয়ে গেছে। মিশরী ইংরেজী বুঝা আরো কঠিন ছিল, চৈনিকরাও নিজেদের মত বলে, আমরাও আমাদের মতো বলি। আমি আসল ইংরেজদের কথাবুঝতে কষ্ট পেয়েছিলাম স্কটল্যান্ডে গিয়েও।

আমাদের বাসে সামান্য সংখ্যক ভিন ভাষী। তাঁরা এখানে সঙ্খ্যালঘু। আমাদের কথা কিছুই বোঝে না। তবে সবাই যখন হাসাহাসি শুরু করে, তার মাঝ পর্যায়ে গিয়ে তারাও হাসা হাসিতে যোগ দেয়।

আমরা আসলেই নিজেদের মধ্যেও এ নিয়ে আলাপ শুরু করে দেই । জাপানি কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি, যার ৪০ শতাংশই নারী। নারীদের এই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতাই কী তবে তাঁদের সংসারবিমুখ করে রেখেছে ?

এ নিয়ে ইন্টারনেটে কিছু মজার তথ্য পেলাম। জাপানের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশনে পরিবারহীন নারীদের দায়ী করেছেন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী তারো আসো। ১৯৭০ সাল থেকেই দেশটির জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছে। ২০১৭ সালে দেশটিতে ৯ লাখ ৫০ হাজার কম শিশুর জন্ম হয়েছে। বিপরীতে মৃত্যু হয়েছে ১৩ লাখ মানুষের। এর কারণ হিসাবে জাপানের তরুণরা ক্রমেই প্রেম বা যৌনতার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে বলে সা¤প্রতিক একটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। সরাসরি শারিরিক সম্ভোগে না গিয়ে অবিকল নারী বা পুরুষের মডেল বানিয়ে এসব প্রাণহীন নারী-পুরুষদের সাথে যৌনাচার করার লাভ হোটেল চালু হয়েছে জাপানে। এ রকম নারীহীন ব্রোথেল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হলেও, জাপানই তার প্রথম উদ্ভাবক। বিবিসির এক জরিপে দেখা গেছে যে জাপানের ১৮ থেকে ৩৪ বছরের তরুণদের ৪৫ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের কখনোই কোন শারীরিক স¤পর্ক হয়নি। ৬৪ শতাংশ বলছে, তারা কোন প্রেম বা স¤পর্কে নেই।

৪৫ বছরের একজন মহিলা শিল্পী বলছেন, একটি সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়তো একটি ছেলের জন্য খুব সহজ ব্যাপার নয়। এজন্য তাকে প্রথমে একটি মেয়েকে ডেটিংয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিতে হবে। এতোসব ব্যাপার হয়তো অনেক তরুণ করতে চায় না। বরং তারা ইন্টারনেটে পর্ণ দেখে যৌন তৃপ্তি পায়।

৩৪ বছর বয়েসি এক পুরুষ এক্সিকিউটিভ ¯পস্টই বলেছেন যে, আমার মতো অনেকেই নারীদের ব্যাপারে সংকোচ বোধ করেন, কারণ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার চেয়ে বরং অন্য কিছুতে মনোযোগ দেয়াই ভালো।

এ রকম স্বাবলম্বি একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তোলার জন্য যে পরিমান অর্থযোগের দরকার হয়, তা মিলাতে না পেরে তারা বিকল্প আয়োজনের দিকে যাচ্ছে। তাতে তার জৈবিক চাহিদাটুকু হয়তো মিটে যাচ্ছে, কিন্তু জাতি জনশূণ্য হবার দিকে এগুচ্ছে।

জাপানি তরুণরা না হয় ইন্টারনেট থেকে যৌন তৃপ্তি পেল, কিন্তু তরুণীরা?

হিসাব কর্মকর্তা ২৪ বছরের আনা একই সাক্ষাৎকারে বলছেন, যৌনতার চেয়েও তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভালো খাবারদাবার আর ঘুম। আনা বলছিলেন, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখনই আমি প্রথম আমার বাবা-মায়ের কঠোর শাসন থেকে বেরিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করলাম। আমি বন্ধুদের সঙ্গে রাত করে বাইরে থাকা বা পানীয় পান করার সুযোগ পেলাম। একজন প্রেমিক হয়তো আমার সেই স্বাধীনতা সীমিত করে ফেলবে, যা আমি চাই না।

ইন্টারনেট যৌনতা বা নিজেকে লুকিয়ে রাখা, কারণ যাই হোক না কেন, গবেষণায় জানা যাচ্ছে, তরুণ জাপানিদের অর্ধেকই কোন রকম প্রেম বা যৌন অভিজ্ঞতা ছাড়া তাদের ত্রিশ বছর বয়স পার করতে চলেছেন।

সক্ষম হওয়ার চেয়ে নারীর সুন্দর হওয়াতেই পুরুষরা বেশি জোর দেন- জাপানের নারীরা এ কারণেই পিছিয়ে রয়েছেন এমন কথা বলেছেন দেশটির ফার্স্টলেডি আকি আবে। তিনি বলেন, জাপানি পুরুষরা সক্ষম ও পরিশ্রমী নারীর চেয়ে সুন্দর নারীকেই বেশি পছন্দ করেন। এমনকি ভীষণ মেধাবী নারীকেও তারা পাশ কাটিয়ে যান।

জাপানে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা পুরুষের প্রায় সমান সমান হলেও কো¤পানিগুলোর বিভাগীয় প্রধান অথবা আরো উচ্চ পদে নারীর উপস্থিতি অনেক কম, মাত্র ৮ দশমিক ৩ শতাংশ।

তবে এই দুদিনের একটা জিনিস চোখে পরলো যে, আপাত ভাবে এই শহরে মেয়েরা অনেক বেশি সক্রিয়, কাজে এবং কর্মে। তবে তা তুলনামূলকভাবে ছোট কাজ।

আমাদের ট্যুর গাইড একজন তরুণী, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে যাদেরকে নেয়া হয়েছে, প্রায় সবাই তরুণী। গাড়ি চালাচ্ছেন এক পুরুষ, কিন্তু তাকে সহায়তা করছেন এক নারী। আরেকটা জিনিস খেয়াল হলো, রাস্তায় চলাচলের সময় কোন নারী কোন পুরুষের গায়ে ধাক্কা খেল নাকি কে কাকে ছুয়ে দিলো, এই নিয়ে কোন বিকার কারোই নাই, গায়ের সাথে গা লেগে বসে আছে, হেঁটে বেড়াচ্ছে, খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুরছে, যে দুই দলের মানুষ তাদের মধ্যে যে লিংগ ভেদ আছে, এটা এদের চালচলনের মধ্যে দেখা গেল না।

এটা আমি যখন দেখছি তখন ২০১৮ সাল, অথচ এর একশো বছর আগে, ১৯১৬ সালেই দেখি রবীন্দ্রনাথও প্রায় একই কথা লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর লেখায় ছিল –

 জাপানের শহরের রাস্তায় বেরুলেই প্রধানভাবে চোখে পড়ে জাপানের মেয়েরা। কারো কারো কাছে শুনতে পাই, জাপানের মেয়েরা এখানকার পুরুষের কাছ থেকে সম্মান পায় না। সে-কথা সত্য কি মিথ্যা জানি নে, কিন্তু একটা সম্মান আছে সেটা বাইরে থেকে দেওয়া নয়, সেটা নিজের ভিতরকার। এখানকার মেয়েরাই জাপানের বেশে জাপানের সম্মানরক্ষার ভার নিয়েছে। এখানে মেয়ে-পুরুষের সামীপ্যের মধ্যে কোনো গ্লানি দেখতে পাই নে; অন্যত্র মেয়ে-পুরুষের মাঝখানে যে একটা লজ্জা-সংকোচের আবিলতা আছে, এখানে তা নেই। মনে হয়, এদের মধ্যে মোহের একটা আবরণ যেন কম। তার প্রধান কারণ, জাপানে স্ত্রী-পুরুষেরা একত্রে বিবস্ত্র হয়ে স্নান করার প্রথা আছে। এই প্রথার মধ্যে যে লেশমাত্র কলুষ নেই তার প্রমাণ এই যে নিকটতম আত্মীয়েরাও এতে মনে কোনো বাঁধা অনুভব করে না। দেহ সম্বন্ধে উভয় পক্ষের মন খুব স্বাভাবিক। পৃথিবীতে যত সভ্য দেশ আছে তার মধ্যে কেবল জাপান মানুষের দেহ সম্বন্ধে যে মোহমুক্ত, এটা আমার কাছে খুব একটা বড়ো জিনিস বলে মনে হয়। অথচ আশ্চর্য এই যে, জাপানের ছবিতে উলঙ্গ স্ত্রী মূর্তি কোথাও দেখা যায় না। উলঙ্গতার গোপনীয়তা ওদের মনে রহস্যজাল বিস্তার করে নি বলেই এটা সম্ভবপর হয়েছে। এখানে মেয়েদের কাপড়ের মধ্যে নিজেকে স্ত্রীলোক বলে বিজ্ঞাপন দেবার কিছুমাত্র চেষ্টা নেই। এখানকার মেয়েদের কাপড় সুন্দর, কিন্তু সে কাপড়ে দেহের পরিচয়কে ইঙ্গিতের দ্বারা দেখাবার কোনো চেষ্টা নেই। জাপানিদের মধ্যে চরিত্র দৌর্বল্য যে কোথাও নেই তা আমি বলছি নে, কিন্তু স্ত্রী পুরুষের সম্বন্ধকে ঘিরে তুলে প্রায় সকল সভ্যদেশেই মানুষ যে একটা কৃত্রিম মোহপরিবেষ্টন রচনা করেছে জাপানির মধ্যে অন্তত তার একটা আয়োজন কম বলে মনে হল এবং অন্তত সেই পরিমাণে এখানে স্ত্রী পুরুষের সম্বন্ধ স্বাভাবিক এবং মোহমুক্ত।

গাড়িতে বসে বসে আমরা টোকিওর প্রায় সব গল্প শুনে ফেলি। এদের রেল লাইন, ট্রেন স্টেশন, বুলেট ট্রেন, এঁদের স্কাই ট্রি, টোকি টাওয়ার, দ্রততম লিফট, পুরনো প্যাগোডা, নতুন দালান, সব। সময় পেলে সেগুলো একে একে দেখা যাবে। আপাতত নেমে যাবো বাস থেকে।

আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে তাদের সদরঘাট, সেখান থকে রিভার ক্রুজে নদীর দুই পাড় দেখবো। কিন্তু সদরঘাটে না নামিয়ে আমাদের নামালো জনসন রোডের মাথায়। কারণ বাস থামার জায়গা ওটাই। যেখানে বাস থামার জায়গা নয় সেখানে বাস থামবে না, জায়গা খালি থাকলেও না। আমাদের বলা হলো এখান থেকে ৪০০ মিটার হেঁটে যেতে হবে নদীর পাড়ে, সেখানে কোন একটা ব্রিজের তলায় আমাদের ফেরি আছে, এখন থেকে ১৫ মিনিট পর ফেরি ছাড়বে।

আমরা লাইন ধরে হাঁটি, আবার সাইন দেখে থামি। ছোট একটা গলি পার হবার জন্য লাল বাতি জ্বলে আছে কিন্তু কোন গাড়ি চলছে না, আমরা তাওও সবাই দাঁড়িয়ে থাকি। সবাই দাঁড়ায়। আবার সবুজ বাতি জ্বললে হাঁটা শুরু করে। এই রাস্তায়ের মোড়ে একটা দৃশ্য দেখে অভিভ‚ত হয়ে গেলাম।

আমাদের রাস্তার ওপর পাশে বড় সড়ক। সে পথ পাড়ি দেবার জন্য লাঠি হাতে এক বৃদ্ধ হাঁটছেন, তাঁর এক হাত ধরে তাঁকে নিয়ে হাঁটিয়ে যাছেন এক তরুণী। এ তরুণী নিশ্চয় তাঁর কণ্যা না হয় নাতনি হবেন। আমি দলের ছবি তোলা বাদ দিয়ে ক্যামেরা নিয়ে তাঁদেরকে অনুসরণ করি। দেখি তরুণীটি বৃদ্ধকে একটা খুঁটির নিচে দাঁড় করিয়ে একটা সাইনেজের বোতামে চাপ দিয়ে তাঁকে সেখানে দাঁড় করিয়ে আবার চলে এলো আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি। এবং সবুজ সংকেত পাওয়ার পর তরুণী তাঁর পথে চলে গেলেন। ব্জহ্লাম, ঐ বৃদ্ধের সাথে তাঁর কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলো না। সম্পর্ক কেবল মানবিকই। মনে হলো, এই টোকিও শহরে আর কিছুদিন থাকলে আমরা মানুষকে আরো ভালবাসতে শিখে ফেলতে পারি, তাঁদের দেখে দেখে।

কিন্তু আমার দেরী করিয়ে দেয় কতোগুলো রিকশা। এখানে দেখি দুই তিনটা টানা রিকশার উপর দুজন দুজন করে কতোগুলো পশ্চিমা তরুণ-তরুণী বসে বসে ভিক্টোরী সাইন দেখাচ্ছে তাঁদের সামনে থাকা হাফ প্যান্ট পরা কতোগুলো জাপানি তরুণের দিকে যাদের হাতে একটা করে মোবাইল ফোন। এই ফোন দিয়ে তাঁদের ছবি তোলা হচ্ছে। আরব দেশে গেলে যেমন উঠের পিঠে চড়ে আমরা ছবি তুলি, এঁদের কাছে বিষয়টা তাই।

ছবি তোলা শেষ হলে টানা রিকশায় বসিয়ে এই দুই যুগলকে নিয়ে দুই স্মার্ট তরুণ রিকশাওয়ালা ছুটে চললো। তারা কোথায় যাবে জানি না, তবে যে অবশিষ্ট আরো দুইটা রিকশা সেখানে দাঁড়িয়ে তার এক মালিককে বললাম-রিকশা ?

চমকে উঠে তরুণ! খুশি হয়ে যায়। বলে- ইয়েস ইয়েস, রিকশা, ইউ গো ? কাম কাম, অয়ান থাউজ্যান্ড  ইয়েন – টুয়েন্টি মিনিটস, কাম এন্ড গো।

তারে বলি- ভাইরে, আমার সময় নাই। তবে এই জিনিসটা আমরা চিনি, এরে আমরাও রিকশা বলি। যদিও, আমাদের রিকশা তিন চাকার, এই ডিজাইনের রিকশা আমাদের পড়শি কলকাতায় আছে, একে টানা রিকশা বলে।

খুবই খুশি হয়ে যায় তরুণ।

রিকশা জাপানীদের প্রথম আবিস্কার ছিল

আসলেই বাংলা ‘রিকশা’ শব্দটি এসেছে জাপানি ‘জিনরিকিশা’ (জিন = মানুষ, রিকি = শক্তি, শা = বাহন) শব্দটি থেকে, যার আভিধানিক অর্থ হলো ‘মনুষ্যবাহিত বাহন’। পালকির বিকল্প হিসেবে জোনাথন স্কোবি নামে একজন মার্কিন মিশনারি ১৮৬৯ সালে রিকশা উদ্ভাবন করেন। স্কোবি থাকতেন জাপানে। ১৮৬৮ সালে এই টোকিওতে মেইজি বংশের রাজারা রাজত্ব শুরু করে নিশ্চয়ই এ ধরনের যানবাহনে চড়েছেন, তখন এটাই ছিলো তাঁদের কাছে মার্সিডিস বেঞ্চ। আমরা ঠেকায় পড়লে চড়ি, আমাদের গাও গেরামের লোকেরা চড়ে। অবশ্য আমাদের দেশে প্রথম রিকশা আসে চট্টগ্রামে, মিয়ানমার থেকে ১৯১৯ সালে, ঢাকায় আসে আরো পরে, কলকাতা থেকে।

রিকশাওয়ালার সাথে গল্প করতে করতে আর তার ছবি তুলতে তুলতে অবস্থা যা দাঁড়ালো যে আমি আমাদের পুরো দল থেকেই হারিয়ে যাই। আমাদেরকে বলেছিল কোন এক ব্রিজের তলায় জেটি থাকবে, এমন ব্রিজ এখানে অনেকগুলো। যে নদীটা টোকিও শহর দুই ভাগ করেছে তার উপর ২৬ খানা ব্রিজ। আমি বাম দিকের একটা ব্রিজের কাছাকাছি গিয়ে দেখি এখানে কোন জেটি নাই।

এরকম অবস্থায় পড়েছিলাম ২০০৩ সালে বার্লিনে, তখন দল থেকে হারিয়ে সারাদিন মাটি হয়েছিল আমার। এবার হারানোর সুযোগ নাই। আমাদের সবার হাতে ফোন। খানিক পরে ভাইবারে আওয়াজ পাই। লাভলু ভাই ফোন করে ফেলেছেন। আমি বুঝলাম, একটা টি বরাবর গিয়ে যেখান দিয়ে বামে গিয়েছিলাম সেখান থেকে ডান দিকে যেতে হবে। কথা ছিলো ৪০০ মিটার হাটবো, আমার হাটা হলো প্রায় ১ কিলোমিটার এবং এরপর যখন ঘাটে পৌঁছালাম, সবগুলো চোখ আমার দিকে ধাবমান। আমি ওঠা মাত্রই ফেরি ছেড়ে দিলো। এটা দেখতে এমন যে, মনে হবে নদীর পাড়ে কাচের ঘের দেয়া একটা বিশাল প্লাটফর্ম নদীর তীর থেকে হঠাত চলতে শুরু করেছে। তাঁর গতি অতি ধীর এবং সে নদীর পাড় ধরে ধরে শান্ত গতিতে টোকিওর কিনারা দেখাতে দেখাতে নিয়ে যায়।

এই ফেরিটার খোালসে অনেক মানুষের বসার জায়গা। প্রশস্থ বেঞ্চি দেয়া আছে। তলটি এমনই সমতল যে এর উপ পানির গøাস রাখলেও খুব নিরাপদে থাকে। আমার বসার জায়গা নির্দিষ্ট নাই। আমি ক্যামেরা হাতে ছুটোছুটি করি। একবার সবার মনোযোগ গেলো একটা বিল্ডিং এর উপরের একতা ভাষ্কর্যিক জিনিসের প্রতি।

আয়া যখন আমাদের নামিয়ে দেয়, তখন দূর থেকে এ বিল্ডিং এর তাকিয়ে আয়া বলেছিল- এটা হচ্ছে টোকিওর সব চেয়ে বড় বিয়ার ফ্যাকটরির হেড অফিস। এ বিল্ডিংটা দেখতেও অনেক লোক নিয়মিত আসে। আর দূর থেকে ওই যে সোনালী রংয়ের একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে,  এটা ডিজাইন করে এর স্থপতি খুব নাম কুড়িয়ে ছিলেন। এই বিয়ার কো¤পানির একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৮৯ সালে এটা বানানো হয়। আর সোনালী পাত দিয়ে মোড়ানো যে অংশটা বেরিয়ে এসেছে, এটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ডিজাইনার এটাকে নেতিয়ে পড়া প্রদীপ শিখা হিসেবে ডিজাইন করেছিলেন। কিন্তু স্থানীয়রা একে ভিন্ন নামে ডাকে।

আমরা বলি- কী নামে?

আয়া বলে, এটা বলা যাবে না। তোমরা খুঁজে বের কর।

শুরু হয় নদীপথে টোকিও দেখানোর পালা

এটা দেখতে এমন যে, মনে হবে নদীর পাড়ে কাচের ঘের দেয়া একটা বিশাল প্লাটফর্ম নদীর তীর থেকে হঠাত চলতে শুরু করেছে। তাঁর গতি অতি ধীর এবং সে নদীর পাড় ধরে ধরে শান্ত গতিতে টোকিওর কিনারা দেখাতে দেখাতে নিয়ে যায়।

এই ফেরিটার খোালসে অনেক মানুষের বসার জায়গা। প্রশস্থ বেঞ্চি দেয়া আছে। তলটি এমনই সমতল যে এর উপ পানির গøাস রাখলেও খুব নিরাপদে থাকে। আমার বসার জায়গা নির্দিষ্টহ নাই। আমি ক্যামেরা হাতে ছুটোছুটি করি। একবার সবার মনোযোগ গেলো একটা বিল্ডিং এর উপরের একতা ভাষ্কর্যিক জিনিসের প্রতি।

আয়া যখন আমাদের নামিয়ে দে, তখন দূর থেকে এ বিল্ডিং এর তাকিয়ে আয়া বলেছিল- এটা হচ্ছে টোকিওর সব চেয়ে বড় বিয়ার ফ্যাকটরির হেড অফিস। এ বিল্ডিঙটা দেখতেও অনেক লোক নিয়মিত আসে। আর দূর থেকে ওই যে সোনালী রংয়েও একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে,  এটা ডিজাইন করে এর স্থপতি খুব নাম কুড়িয়েছিলেন। এই বিয়ার কো¤পানির একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৮৯ সালে এতা বানান হয়। আর সোনালী পাত দিয়ে মোড়ানো যে অংশটা বেরিয়ে এসেছে, এটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ডিজাইনার এটাকে নেতিয়ে পড়া প্রদীপ শিখা হিসেবে ডিজাইন করেছিলেন। কিন্তু স্থানীয়রা একে ভিন্ন নামে ডাকে।

আমরা বলি- কী নামে?

আয়া বলে, এটা বলা যাবে না। তোমরা খুঁজে বের কর। আমাদের গবেষনা শুরু হয়ে যায় এই ফর্ম নিয়ে। এটা প্রদীপের শিখা এটা মানতে রাজি হলেও একজন বলে বসেন, এই ফর্মতা আর্টি¯ের মাথায় এসেছে তাঁর বাথ রুম করার পর। এবং কমোডে বসে নয়, মাটির উপর কাজটা করে তিনি যা দেখে খুব আরাম পেলেন, তারই রূপ দিলেন এখানে, এ নিয়ে আর কোন সংশয় নাই।

আমরা মজা করতে এসেছি, মজাতেই থাকি। আমাদের ডান বামে নানা রকমের জলজ বাহন ছুটে যায়। কোনটির আকার দুমুখো মাছের মতো, যেনোবা সাবমেরিন উঠে এসেছে পানির উপর, চলছে জলজ বাস। শহরের প্রান্ত বরাবর বয়ে চলা এই সুমিদা নদীকে  কেন্দ্র করেই এক সময় এই বন্দরনগরী গড়ে উঠেছিল। এক সময় নানা রকমের পালবাহী জাহাজ ছিলো তাঁর বাহক, নিশয় অনেক খেয়া নৌকাও ছিলো। এখন তাঁর কিছুই নাই। দুই তিন মাইল পর পর আছে একেক ডিজাইনের এক এক সেতু। কৈানটা রংধনুর মতো,  কোনটা বা প্রজাপতির পাখার মত। আমাদের হাতির ঝিলে কোনটার মতো পাখনা লাগানো হয়েছে টা নিয়েও চলে মশকরা।

এক সময় বড় শহরতলির উঁচু উঁচু দালান পার হয়ে যাই। তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকা দেখি। অত্যন্ত ঘনবসতির এই শহরের এপার্টমেন্টগুলো সাইজে খুবই ছোট। ৮-৯০০ বর্গফুটের এপার্টমেন্টের সারি চোখে পরে। অনেকগুলো এপার্টমেন্ট মিলে এক একটি দালান। দালাঙ্গুলো একটা থে আরেকতা বেশ দূরে। সব ঘরে আলো বাতাস ঢুকার ব্যবস্থা আছে। প্রায় ৪০ মিনিটের মাথায় আমাদের মিজুবে লাইনের চলন্ত পাটাতনটি এসে থেমে যায় এক ঘাটে। ঘোষণা এলো, এবার আমরা একতা পার্ক দেখবো। রিংকাই পার্ক।

যখন বাসে থাকি তখন আয়া আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। যাবার আগে বলেছিল, এই ফেরিটি যখন আমাদের পার্কে নামাবে তখন বৃষ্টি আসতে পারে। এজন্য আমাদের ‘আম্বারালা’ র ব্যবস্থা করে রেখেছে।

কী আশচর্য, জেটি থেকে নামতেই দেখি গুড়িগুড়ি বৃস্টি। জাহাজ থেকে ছাতা নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু বৃষ্টি আহামরি প্রবল নয় দেখে আমরা রয়ানা দিয়ে দেই ছাতা ছাড়াই এবং পার্কের মাঝামাঝি এসে টের পাই, এখানে আর ছবিটবি তোলার সময় হবে না, দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠলাম। শুনলামীই বাসটি আমাদেরকে আবার মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দেবে ।

আমি জোট বেঁধেছি লাভলু ভাইর সাথে । আমার কাজ হচ্ছে তাঁকে ফলো করা । আমি তাঁর হাতেও একটা ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়েছি। তিনি ছবি তুলতে আর গাড়ি চালাতে খুব মজা পান। এখানে গাড়ি চালানোর সুবিধা নাই, তাই ক্যামেরা চালাচ্ছেন । ছবিটা তুলতেই তিনি আরাম পান, নিজে অবশ্য ভালো করে দেখ এনও না কী তুলছেন। কার্ড ভরে গেলে আমি তাঁকে নতুন কার্ড দেই, আর তাঁর সব ফুটেজ আমার কাছে এনে রাখি।

মেইজির ক্যাম্পাসে এসে বাস থামে। আমি লাভলু ভাইকে বলি, এখন কই যাব ?

বায়তুল মোকাররম।

মানে ?

ফলো মি।

আমি তাঁকে ফলো করি।

টোকিওর বায়তুল মোকাররম

মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরু গাদাই ক্যাম্পাস থেকে দুই মিনিট হাঁটার দূরত্বে ওচানোমিজু স্টেশন। সেখান থেকে মেট্রোতে বারো মিনিটের পথ আকিহাবারা। জনপ্রতি টিকিট ১৬০ ইয়েন। মেট্রো ধরে এসে নামলাম স্বপ্নের আকিহাবারায়। আন্ডার গ্রাউন্ড স্টেশনের দিক নির্দেশনা দেয়া আছে কোন দিকে গেলে মিলবে ইলেকট্রনিক জগত। সেইদিকে এগিয়ে মাটি ফুরে যখন উপরে উঠলাম, মনে হলো অন্য কোনগ্রহে এসে পড়িলাম।

লাভলু ভাই বলেন- এটা হচ্ছে টকিওর ইলেক্ত্রনিক্স মার্কেট। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এলেক্ট্রনিক বাজার এটা। মনে কর একশোটা বায়তুল মোকাররম এর পেটে ঢুকালে এর এক কোনাও ভরবে না।

আমি মহা পুলকিত হয়ে উঠি। সওদাপাতির যা কিছুই আমার আগ্রহের টা হচ্ছে এই ইলেক্ট্রনিক্স। সেটা ক্যামেরা বা গ্যাজেট, যাই হোক। এ পর্যন্ত চার জেনারেশনের ক্যামেরার সাথে আমার পরিচয়। প্রথমটি ছিলো পিনহোলের একটু আধুনিক ভার্শন। এরপর ছিলো একটা কোডাক, যার এক ফিল্মের এক ক্যামেরা। ছবি তোলা শেষ ক্যামেরাও শেষ। এরপর , ১৯৮০তে পেলাম ইয়াশিকা ইলেক্ট্রো থার্টি ফাইভ, এরপর ইয়াশিকা এম এফ টু। এরপর এস এল আর প্যান্টাক্স কে ১০০০, মিনোলটা। এলো নাইকন টিজিটাল, সেটা দিয়ে ডি এস এল আর এ প্রবেশ। ফিল্ম ক্যামেরা শেষ হলে প্রথম জেনারেশনের ডিজিট্যাল ক্যামেরাও আমার নেয়া হয়ে যায়। তারপর বছর বছর ক্যামেরা কোম্পানি তাঁদের সুবিধা বাড়ান মডেল বদলায়, আমিও তাল মিলিয়ে বদলাই। সব জাতের ক্যামেরা চালান শেষ করে এখন থিতু হয়েছি অজমো প্লাসএ। এটা অনেক মজায় ক্যামেরা। আছে আরেকতা ম্যাচবক্সের সাইজের গো-প্রো। একসাথে দুই হাতে দুই ক্যমেরার ছবি তুলে আমার অভ্যাস আছে। আগে যখন ট্রাইপড নিয়ে চবি তুলতে বেরুতাম তখনো এ কাজ করেছি, খানিক কষ্টে। যেমন ত্রিপদে ক্যামেরা বসিয়ে স্পা শপ স্টিল ক্যামেরায় ছবি তুলে আবার ভিডিও ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ দিয়েছি।

সুতরাং এসব নতুন নতুন ডিভাইসের নানা রকমের এক্সেসরিজ থাকে যা দেশে পাওয়া যায় না। এই মার্কেট হচ্ছে তার স্বর্গরাজ্য। সুতরাং এই আকিহারাবাতে এসে আমি প্রায় দিশেহারা হয়ে যাই। কোন গলিতে যাবো, কোন সিঁড়ি মাড়াব বুঝে উঠতে পারি না। সমস্ত বড় রাস্তা জুড়ে বড় বড় দশ বারো তালা দোকানতো আছেই। সেগুলোর দুই পাশে যত ছোট রাস্তা আছে, সবগুলোতেই ছোটছোট দোকান ঠাসা। একজন বললো, একেক রাস্তা একেক কারণে বিখ্যাত। আপনার পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ারের মাদারবোর্ড নষ্ট হয়েছে? বা পুলি ভেঙ্গে গেছে? তো এই রাস্তায় যান। ক্যামেরার ¯েপশাল লেন্স চাই? তো সেই রাস্তা। নতুন আইটেম চাই? তো ঐদিকে!! আপনার ইলেকট্রনিক কোন চাওয়াই ফিরেয়ে দিবেনা আকিহাবারা।

আমরা লিফ্ট-এস্কেলেটর মারাতে থাকি। কিছু দেখি চোখে, বাকিটা আমার ক্যামেরার এলসিডিতে। মজাই লাগে। আমরা নানা পদের ইলেক্ট্রনিক জিনিস দেখি এবং ক্যালকুলেটরে কনভার্ট করি । দেশি আমাদের বসুন্ধরা সিটি বা বায়তুল মোকাররমে জাপানি জিনিস যে দামে কিনি তার চেয়ে বেশি দাম সব জিনিসের। দুই-তিনটা জিনিসের দাম দেখে বুঝে ফেললাম সস্তায় ইলেক্ট্রনিক্স কেনার জায়গা সিঙ্গাপুর আর ব্যাংককের কিছু মার্কেট, টোকিও নয়। এমনিতে টোকিওর ইলেক্ট্রনিক্স গুণগত মানে দুনিয়া সেরা, কিন্তু ওঁদের জিনিস ওঁদের বাইরের দেশ থেকে কেনাই সাশ্রয়ই। হতে পারে, তাঁদের দেশের মানুষের বেশি আয়ের সাথে মিলিয়ে জিনিসের দাম ঠিক করা, বিদেশের জন্য তারা হয়তো সাশ্রয়ি মূল্যে বাজারজাত করে।

তারপরও আমার শুটিং-এর জন্য দরকারি বিবেচনায় চরা দামে একটা পোর্টেবল মাইক্রোফোন কিনে নিয়ে খাবার দোকানের সন্ধান করি। জানি সন্ধ্যা ৬ টা থেকে তারা রাতের খাবার শুরু করে আটটায় শেষ। সুতরাং এবার আমাদের অভিযান শপিং কমপ্লেক্সের ফুডকোর্ট।

প্রথম আসল জাপানী খাবারের আস্বাদন গ্রহণ

আকিহারাবার বাজারে ফুড কোর্টে গিয়ে রসগোল্লার মতো গোলগোল একটা খাবার খেয়ে তৃপ্তি পেলাম। অনেকটা আমাদের দেশি হান্দেশের মত। এর নাম  তেমপুরা। পাতলা  গোলাকার সামুদ্রিক খাবার এবং শাকসব্জি মিশিয়ে তেলের কড়ায় ভাজা হয়। জেনেছি, এঁদের সামুদ্রিক খাবার প্রায়ই ভাজা হয় আবার অনেকক্ষেত্রে সাশিমি হিসেবে কাঁচা বা সুশীতে পরিবেশিত হয়। ভাত ছাড়াও নুডলস যেমন সোবা ও উডন ইত্যাদি প্রধান খাবার হিসেবে পরিবেশিত হয়।

তবে বিপদে পড়ে গেলাম লাভলু ভাইয়ের সাথে খেতে বসে। আমি যখন ছবি তোলায় ব্যস্ত, লাভলু ভাই বসেছেন খাবারের মেন্যু নিয়ে এবং তাঁর হাটুর কাছে এসে বসেছে রেস্টুরেন্টের তরুণী ওয়েটার। তাঁরা দুজনে শলা পরামর্শ করে খাবারের অর্ডার দিয়েছেন। লাভলু ভাইর পছন্দের উপর আমার অনেক আস্থা। আমি ছবি তোলা শেষ করে তাঁর কাছে গিয়ে বসি। দেখি দুই বাটি স্যুপ এসেছে। সাথে নানাজাতের উদ্ভিজ জিনিসপত্র। বললেন- সী ফুডের অর্ডার দিলাম, খা, খুব টেস্টি।

আমি খাওয়া শুরু করি। একটি তেতো স্বাদের জলীয় খাবার, আর নরোম গোছের কিছু সমুদ্রের তলায় পড়ে থাকা ঘাস-লতা-পাতা। বুঝলাম, টেলিভিশনের ডিসকভারি চ্যানেলে আন্ডার ওয়াটার লাইফে যেসকল লতাপাতা দেখেছি, এটা তারই অংশ।

অনেকটুকু খাওয়ার পর নিচ থেকে কিছু ভারী গোলাকার জিনিস চামচে উঠতে লাগলো।

লাভলু ভাই কে বলি- এগুলো কী ?

নিজে এগুলোর একটি কামড়াতে কামড়াতে বলেন, খা, খুব টেস্টি।

আমি আবার বলি, খেলাম তো একটা, টেস্ট বুঝতেছিনা, জিনিসটা কী ?

সরল ভাষায় জবাব দেন- এগুলো শামুকের কচিকচি বাচ্চা।

আমি বলি, এগুলোকে আমরা বলি গুগইল। ছোটবেলা খালের পাড় থেকে খলুই ভরে ভরে নিয়ে আসতাম, হাঁসকে খাওয়ানোর জন্য। হাঁসের খাবার খাওয়ার জন্য কি জাপানে এসেছি, আপনি খান, আমি নাই।

আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। চিন্তা নাই আমার। রুমে চিড়া আছে, চিনি আছে। হোটেলের পাশের সেভেন ইলেভেন থেকে দুধের প্যাকেট আর কলা নিয়ে যাব। কলা অবশ্য বেশ এক্সপেন্সিভ। মাঝারি সাইজের একটা কলার দাম বাংলাদেশি টাকায় আশি টাকা। সমস্যা নাই। আমি খাওয়া বন্ধ করে আবার ছবি তুলতে বেরোই।

দেখি সব রেস্টুরেন্টের সামনে কাঁচের সেলফের ভেতর হরেক রকমের খাবার সাজিয়ে রাখা। আছে ভাত, নুডুলস, ডিম, মাছ, লতাপাতার মিশেলে নানা পদের সব্জির বাহার। প্রতিটার পাশে তাঁর দাম দেখা। আমার ইচ্ছা হলো টাকা দিয়ে সেখান থেকে একটা প্লেট উঠিয়ে নেই। চেষ্টা করতে গিয়েই লজ্জা পেলাম। প্রথমেই বলা হলো, এখান থেকে নেবার কোন সিস্টেম নাই। এখানকার কোড নাম্বার দিয়ে ক্যাশে টাকা জমা দিতে হবে। টাকা পাওয়ার পর তাঁরা একটা টোকেন দেবে। এই টোকেন নিয়ে ভেতরে গিয়ে বসে থাকা যাবে এবং এক সময় টোকেনে দেয়া যে সিরিয়াল নাম্বার লেখা থাকবে সেই সিরিয়ালের নাম্বার ডিজিট্যাল বোর্ডে ভেসে উঠলে আমি কাউন্টার থেকে খাবার নিতে পারবো, বা আমাকে সে টেবিলে দিয়ে দেয়া হবে।

এখানে  কথা বলাবলির সুযোগ নাই বললেই চলে, সব কিছু মেশিন আর কার্ডের মামলা, নগদে কাউরেই লেনদেন করতে দেখি না। কার্ড দিলে ঘ্যাচাং করে মেরে হাসি মুখে ফেরত দেয়। অন্য সব দেশে পিন চায়, পাসওয়ার্ড চায়, এখানে  ক্রেডিট কার্ডের কোন পাসোয়ার্ড যাচাই বাছাইয়ের বিষয়ও নাই। ধারণা করছি, জাপানে কেউ-ই বোধহয় ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে না, সেকারণে আলাদা পিন বা পাসওয়ার্ডের যাচাইবাছাইয়ের বিষয়টা তাঁদের লেনদেনে নাই।

খাবারের ছবি তুলতে তুলতে আমি আবিস্কার করে ফেলি, এই যে বাটিবাটি খাবার সাজিয়ে রাখা আছে এখানে তার সবই প্লাস্টিকের খাবার। কিন্তু ডিম, ডিমের পোচওয়ালা ছবি বা কুসুমের ছবি যেভাবে প্লাস্টিক দিয়ে বানিয়েছে, কাঁচের টেবিল না হলে হয়তো আমি নিয়ে খেতেই বসে যেতাম।

আমি লাভলু ভাইর কাছে ফেরত আসি। বলি, এরা খালি সামুক-টামুকই খায়না তো, আরো অনেক কিছু আছে, দেখে এলাম। তিনি একটা বড় মেন্যু বুক উল্টাতে উল্টাতে বলেন, জাপানের মজাদার খাবার হচ্ছে মাছের ঝোল ওডেন এবং সুকিয়াকি আর নিকুঞ্জাগায় গোমাংস। এখানে চীনা খাবার যেমন চাওমেন, ফ্রাইংডাম্পলিংস এবং গয়জা জাপানি হয়েছে। উপাদান এক হলেও স্বাদ আলাদা। জাপানে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের আগে থেকেই মাংস খাওয়া একেবারের পছন্দের তালিকায় ছিলো না। ১৮৮০ সালের দিকে জাপানে  টোংকাটসুর মত মাংসের পদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

আমি লাভলু ভাইকে বলি- বাদ দেন এসব, আমাকে শুশি খাওয়াইয়েন একবার, ঢাকায় খেয়েছি, এখানে খেতে চাই।

তুই খেতে পারবি না।

কেন ?

এটা পিওর কাঁচা মাছ দিয়ে বানায়, ঢাকারটা হালকা সেদ্ধ মাছের।

তাই নাকি ?

হ্যা। আর এর স্পেশালিটি হচ্ছে, কাঁচা মাছের সাথে একটু রক্ত লাগিয়ে রাখবে,  বোঝানোর জন্য যে এটা পিওর কাঁচা মাছের।

তাইলে থাক। চলেন যাই আজ, রুমে গিয়ে চিড়া খাই।

আমরা খাওয়ার আর খাওয়ার ছবি তোলার পালা শেষ করি।

এ ওয়াক ইন দ্যা রেইন

এবার  হোটেল ফেরার পালা। কিন্তু শপিং মল থেকে বেরুতেই দেখি গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। আমি লাভলু ভাইকে বলি, ট্যাক্সি নেন, হোটেল যাবো। আর পারিনা।

আমাদের দুইজনের হাতে দুইটা ছাতা। কিছুক্ষণ আগে আমরা ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় এমন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পেয়ে ছিলাম। তখন ১৪০০ ইয়েন (বাংলাদেশি টাকায় ১০৫০ টাকা) দিয়ে দুটো ছাতা কিনেছিলাম। সেই ছাতা মাথায় দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি।

লাভলু ভাই তাঁর চোখের সামনে থেকে ফোন সরাতে সরাতে বলেন, এখান থেকে আমাদের হোটেল ম্যালাদূর, প্রায় ৬ কিলোমিটার। ট্যাক্সিতে যেতে সময় লাগবে ১৯ মিনিট, কিন্তু ভাড়া ৫৫০০ ইয়েন। আর  মেট্রোতে গেলে ৩০ মিনিট। ৯ মিনিট হাঁটার পর ট্রেন পাবি। ১১ মিনিটে তোকে পৌঁছাবে ইয়তসুয়া স্টেশনে, সেখান থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা পথে আমাদের হোটেল। ভাড়া দুইজনের ২৮০ ইয়েন। কী করবি ?

আমি বলি- হোটেলে ফেরারতো তাড়া নাই আমার। এটাতো ঢাকা না যে রাত দশটা হলে বাসা থেকে ফোন আসবে, খাওয়ার জন্য বসে আছে সবাই, খেতে বসতে হবে। এখন আমাদের পুরো সময়টা হচ্ছে টোকিও এক্সপ্লোর করার। ১০ দিনের এই সফরে আজ আমরা প্রথম বেরিয়েছি টোকিও দেখতে। এই শহরের ট্রেনও একটা দেখার জিনিস। আমাদের ইয়েন বাঁচবে ৫হাজার আর মাগনা চড়া হয়ে যাবে টোকিওর ট্রেন।

লাভলু ভাই মেশিনে টেপাটেপি করে দুইটা কাগজ বের করে আনেন। একটা আমার হাতে দিয়ে বলেন, এই নে টিকেট, ঢুকে পড়।

স্টেশনে ঢোকার আগে প্রথম মনে হলো, এই স্টেশনটি খুব ছাতা বান্ধব। যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে এবং সবাইকেই কিছু না কিছুপথ পায়ে হেঁটে আসতেই হয়েছে সুতরাং ছাতা আছে সবার সাথে। স্টেশনের যে ব্যারিকেড পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে হবে সেখানেই দেখি অনেকগুলো লম্বাটে প্রকোষ্ঠ। এর  দৈর্ঘ্য এক ছাতার সমান। লোকজন এই প্রোকোষ্ঠে তাদের ভেঁজা ছাতা ঢুকিয়ে কেমন করে একটা মোচড় দিয়ে আবার বের করে আনছে। বের করে আনা ছাতাটি দেখি একটা স্বচ্ছ পলিথিনে মুড়িয়ে দেয়া। এবার এই ছাতা থেকে চুইয়ে পড়া পানি স্টেশনের কোন ফ্লোরকে আর ভেজানোর সুযোগ পাবে না।

আমরা এসে দাঁড়াই ৫নং প্ল্যাটফর্মে। এর নাম চুও-সুবো লাইন । সিনজুকুগামী এই ট্রেনটি ৪ বার নানা স্টেশনে থামবে, পঞ্চম স্টেশনটি আমাদের।

চিন্তা নাই। প্রতি ৩মিনিট পরপর একটা করে ট্রেন আসে এই লাইনে। প্ল্যাটফর্মে গিয়েই দেখি একটা ট্রেন দাঁড়ানো এবং লাইন ধরে যাত্রীরা উঠছে। খানিক পর ট্রেনটা চলে গেলে খালি প্ল্যাটফর্মে দেখি নানা সারিতে কিছু লোক এসে দাঁড়াচ্ছে একটা হলুদ দাগের পর। যিনি সামনে দাঁড়ালেন তাঁর পেছনে দাঁড়াচ্ছেন আরেকজন। পুরো প্ল্যাটফর্ম জুড়ে এরকম কতোগুলো দাগ দেয়া আছে, সেই সব দাগকে মেপে দাঁড়িয়ে থাকে লোকজন। পাশে পুলিশ আছে একজন। লাভলু ভাই বলেন, এসব পুলিশের কাজ হচ্ছে, মানুষজনকে ধরে ধরে ট্রেনের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া। রাশ আওয়ারে এরা বেশি সক্রিয় থাকে। তখন শুটকিগাজার মতো একেকটারে ঠেলে ভেতরে ঢুকায়। এরা পুলিশ না। পুলার। হিউম্যান পুলার।

রেল স্ট্রেশনে যাত্রীদের শৃংখলাও একটা দেখার মত জিনিস

আমাদের জন্য হিউম্যান পুলার লাগেনি। ভেতরে সিটও পেয়ে যাই আরামে এবং টের পাই, এই শহরের বেশিরভাগ মানুষই মাটির তলায় বেশি চলাচল করে।

৪ টা স্টপেজ শেষে আমরা নেমে যাই ইয়তসুয়া স্টেশনে। সেই কাগজ টুকরাটা আবার দরকার হয়। আরেকবার মেশিনে ঢুকিয়ে দিলে সে আমার জন্য রাস্তা খুলে দেয়। আমরা বেরিয়ে পড়ি স্টেশন থেকে।

টোকিওতে প্রথম দিনের ট্রেন সফর

বাইরে বৃষ্টি। লাভলু ভাইকে বলি, ট্যাক্সি ডাকেন। আমি আর হাঁটতে পারবো না। রেল থেকে নামার পর অনেক উঠানামা করতে করতে আমি ক্লান্ত।

লাভলু ভাই ট্যাক্সি লেখা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন।

টোকিওতে ট্যাক্সিওয়ালাদের ‘না’ বলে কোন শব্দ নাই। সবুজ বাতি জ্বলা ট্যাক্সি হাত বাড়ালেই থেমে যাবে এবং অটোমেটিক্যালি বামপাশের দরোজা খুলে যাবে। ট্যাক্সিতে বসে গেলে বাম পাশের দরোজাটি নিজে নিজেই লেগে যাবে। এবার ড্রাইভার জানতে চাইবেন, কোথায় যেতে হবে । জায়গার নাম জেনে তিনি জিপিএসে টেপাটেপি করেই গাড়ি স্টার্ট দেবেন, তাঁর ভাড়া মিটারে তরতর করে বাড়তে থাকে অংকের পরিমান। নেমে যাবার পর ক্যাশ বা ক্রেডিত কার্ডে ভাড়া মিটিয়ে তিনি চলে যাবেন। কেউ কারো সাথে কোন কথা না বললেও কোন সমস্যা নাই।

আমাদের হোটেলে ট্যাক্সিতে যেতে লাগবে ৩ মিনিট, পায়ে হেঁটে যেতে ১০ মিনিট, দূরত্ব ৭০০ মিটার।

আমি ছাতাটা বের করে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে থাকি। আমার হাঁটাহাঁটি দেখে লাভলু ভাই ট্যাক্সি লেখা জায়গাটা থেকে সরে এসে আমার কাছে আসেন। প্রথমে মনে হয়েছিল তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে যেতে এসেছেন। কিন্তু আমার কাছাকাছি আসতেই মনে হলো – না, তিনি আমার সঙ্গেই হাঁটতে এসেছেন।

আমি বলি, চলেন- সামনে একটা সেভেন-ইলেভেন আছে। সেখান থেকে কিছু পানি নিয়ে যাই রুমের জন্য। ৫০০ ইয়েন দামের ৪০০ মিলি পানি খেতে কষ্ট হয়।

আমরা ছাতা মাথায় রাস্তা পার হয়ে সেভেন ইলেভেনে যাই। দুই বোতল দুই লিটারি পানি কিনি ১২০ ইয়েনে। বোতল হাতে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেই, এটা ফেরত দিব। এতো ভারি পানির বোতল নিয়ে ৬০০ মিটার হাঁটা যাবে না।

ফেরত দিলাম পানির বোতল। এবার খালি হাতেই হোটেল ফেরার পালা। আমি ছাতা নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার খুব নিকোটিনের চাপ অনুভ‚ত হয়। আমি এই সেভেন ইলেভেনে একটা  মোবাইল ছাইদানী কিনতে গিয়ে খবর পেলাম, এই দোকানে সিগারেট বিক্রি হয় এবং দোকানের সাথে লাগানো একটা ছোট্ট কিয়স্ক আছে, সেখানে ছাইদানীও রাখা আছে। কেবল সেখানে দাঁড়িয়েই সিগারেট খাওয়া যাবে।

আমি ছাতা মাথায় দিয়ে মহানন্দে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করি। আমার গাইডগুগল ম্যাপ। এই গুগলমামার উপর আমাদের অনেক আস্থা। কিন্তু খানিক পর এক গলির মুখে আসতেই দেখি, গুগলমামা আমাকে খালি উল্টা পথে যেতে বলে। অথচ আমাদের ৫৬ তলা উঁচ‚ হোটেলটি সামনেই দেখা যাচ্ছে। মামী আমার উল্টা যেতে কয় ক্যান ? যে গলিটার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি, সে পথ দিয়ে কিছু মানুষের চলাচল আছে। সবার মাথায় ছাতা। আমাদের মাথায়ও ছাতা। কিছু মানুষের হাতে ট্রান্সপারেন্ট ছাতা। এই ছাতায় রোদ ঠেকায়না, বৃষ্টি ঠেকায়, কিন্তু আলোটা আটকায়না।

আমার এক হাত সিগারেটের জন্য ব্যস্ত। আমি লাভলু ভাইকে বলি- আপনি এই গলি পথের একটা ছবি তুলেন। সামনে যে কাপলটা আসছে, তাদের ছবি।

লাভলু ভাই গভীর মনোযোগের সাথে ছবি তুলতে থাকেন।

আমার ইচ্ছা হলো এদের সঙ্গে একটু কথা বলতে। অপরিচিত জায়গায় কারো সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে হলে কোন একটা জায়গার ঠিকানা তাঁকে জিজ্ঞাস করাই যায়। এমন কিছু ইউরোপ-আমেরিকায় করেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারো সময় হয়না আজনবির সাথে কথা বলতে। তাদের ফ্রেইজে আছে-Never believe a stranger . কিন্তু জাপানিরা কেমন ?

আমি দেখি লাভলু ভাই তাদের সাথে কথা বলছেন। নিউ ওটানি হোটেলটা কোনদিকে জানার চেষ্টা করছেন।

খানিক পরে আমার কাছে এসে বলেন, চল- এরা দেখিয়ে দেবে।

আমরা অপর একটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে আরেকটা রাস্তা পাড়ি দেই। আমি জানি, আমার গুগলমামীও আমাকে এই পথের কথা বলে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় লাইটপোস্টের পর ডান দিকে চলে গেলেই হোটেল।

সেই যুগল তাদের চলারপথ ফেলে রেখে আমাদের জন্য দ্বিতীয় লাইটপোস্ট পর্যন্ত এসে দাঁড়ায়।

আহ ! সেই বৃস্টিমাখা সন্ধ্যা

বৃষ্টি পড়ে টোকিও আকাশ ফুঁড়ে। টিপটিপ বৃষ্টি, মাঝেমাঝে জোরেজোরেও বইছে। আমাদের মাথার উপর ছাতা। এই ছাতার উপর ভটভট শব্দ করে বৃষ্টির বড়বড় ফোটাপড়ে। কিছু সরাসরি আকাশ থেকে, আর কিছু এই সরু পাহাড়ি পথের দু’পাশে থাকা বড় বড় গাছের পাতা থেকে ঝরেপড়া জল।

যে পথ দিয়ে আমরা হেঁটে যাই, তা খানিকটা উঁচু পথ। দুই পাশে টিলা। এই টিলাময় পথ পেরুলে হাতের বায়ে বাঁক নিলে আমাদের হোটেলের গেট। মাঝপথ পর্যন্ত এসে একবার পেছনে তাকাই। দেখি স্বচ্ছ ছাতার নিচে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন জাপানি যুগল। আমরা হাত নাড়ি, বুঝাই, হোটেল পেয়ে গেছি, তোমরা চলে যাও।

হাঁটতে হাঁটতে যেখানে বাঁক নিয়ে হোটেলের গলিতে ঢুকবো, সেখান থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, সেই যুগল আমাদের দিকে তাকিয়ে তখনো দাঁড়িয়ে।

রাতে হোটেলের আরেক রূপ। কলকাতা, দিল্লী, জয়পুর, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড থেকে আসা বাঘাবাঘা স্থপতিরা এসে ভিড় করেন আমাদের রুমে, মানে আমি আর আরিফ ভাই যে রুমে আছি সেই রুমে। আমরা খোলা কাচের ভেতর দিয়ে টোকিওর রাতের স্কাইলাইন দেখতে দেখতে রাজা উজির মারি। কাল আমাদের আরেকটি ফাঁকা দিন। জাপান স্থপতি ইন্সটিটিউট আমাদের জন্য আরেকদিন রেখেছে টোকিও দেখানোর জন্য। আমরা ভোর রাতে ঘুমাই। কাল এগারোটায় বাস আমাদের কোথায় কোথায় যেনো নিয়ে যাবে।

দ্বিতীয় দিনের সফর

কাল থেকে শুরু হবে সেমিনার। আজ আমাদেরকে আরেকদফা টোকিও দেখানোর জন্য বাসে করে নিয়ে যাবে। আমরা মেইজি  বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গিয়ে হাজির হই।

লক্ষ্য করি চওড়া  ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঢাকার ফুটপাথের গুষ্টি উদ্ধার করি। এতো জনবহুল শরহরটার ফুটপাথগুলোও যেনো একেকটা বাগান।

বেলা বারোটায় বাস ছাড়বে। যে তরুণী আমাদের গাইড করে নিয়ে যাবে তার কথা বার্তা শুনে মনে হয় এক কালে সে সিনেমায় কমেডি রোল করতো। কথা বলার আগে একটু হেসে নেয়, কথা বলায় মাঝখানে আরেক বার হাসে, আর তার কথা শেষ হলে সবাই হাসে। সে যতোটা না মুখে কথা বলে, চোখ দিয়ে বেশী বলতে চায়। মাঝে মাঝেই চোখ বুজে টিপ টিপ করতে করতে কথা বলে।

আমাদের দলের স্থপতি মাসুদ খানের সাথে তার শুরুতেই ভাব হয়ে যায়। তার দেহ ভঙ্গি আকৃষ্ট করে মাসুদ ভাইকে। তিনি তার সাথে বাংলায় কথা বলেন, সে বলে তাঁর নিজস্ব ইংরেজিতে। ‘ইংরেজি’ নামটাও মাসুদ ভাইয়ের দেয়া । বলেন, ওর ইংরেজির চেয়ে আমার বাংলা বেশি বুঝা যায়। জাপানি মেশান যে ইংরেজি সে বলে তাতে আমার জন্য বেশি অসুবিধা। এর এক্সেন্ট গতকালেরটার চাইতে চার ডিগ্রী আলাদা। আর এটা সে জানে বলেই বোধ হয়, সব কথা অভিনয় করে বুঝিয়ে দিতে চায়। তাঁর মুখ, মাথা, চোখ এবং দুই হাত একসাথে কথা বলে। মাসুদ ভাইকে দেখে মনে হলো, মজা লুটার শেষ চেষ্ঠাটাও তিনি ছাড়বেন না। হ্যান্ডশেক করার পর মনে হলো দুইজনে হাত শক্ত আঠা দিয়ে লাগানো হয়ে গেছে, কেউ ছুটাতে পারছেন না। হাসি মুখে নিয়েই মাসুদ ভাই বলেন – বইনগো, আমরা আজ কোথায় যাবো ?

মাসুদ খানের সাথে খুব দ্রুতই খাতির হয়ে যায় আমাদের আজকের গাইডের সাথে । শুরুটা হয় জাপান-বাংলা ভাষা বিনিময় দিয়ে।

গাইড তার হাতে ধরে রাখা হাত আরো জোরে শেক করতে করতে বলে- থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ।

আমরা হাসি। মাসুদ ভাই আরো জোরে হাসেন। বলেন- আরিগাতো আরিগাতো।

গাইড তার হাত ছাড়েনা, সে আরো জোরে মাসুদ ভাইর হাত চেপে ধরে হাসে এবং বলে- আরিগাতো গুদাইমাসি, আরিগারোতো গুদাইমাসি

মাসুদ ভাই বলেন- হা, মাসি মাসি।। ইউ লুক লাইক মাসি।

একসময় তাঁদের হস্তবন্ধন টুটে যায়। মাসুদ ভাই সামনের দিকের একটা সীটে বসে পড়েন। গাইড সবার সীটে পানির বোতল পৌছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, আর এ সময় বাসের জনগনের উদ্দেশ্যে মাসুদ ভাই বলেন- এইটার বয়স কিন্তু পঞ্চাসের কাছাকাছি, দেখতে লাগে পঁচিশ-তিরিশ। এরা মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে খায় না, এ জন্য বয়সও বোঝা যায় না।

আজকের এই বাসে সব যাত্রী বাংলাদেশি। মনে হলো যেন আইএবির পিকনিকে যাচ্ছি একদল স্থপতি। মৌজের মুড সবার । সিটে বসে সিট বেল্ট বাঁধতে বলার আগেই আমরা বেল্ট বেঁধে ফেললাম। জানি কেউ একজনও যদি বেল্ট না বাঁধে বাস ছাড়বে না।

একসময় বাস ছাড়লো। আমি আমার ক্যামেরা অন করে দিলাম।

গাইড শুরু করলো তার বয়ান। আজকের এই বয়ান শুনে মনে হলো এঁদের সব গাইড প্রতিদিন যদ যাত্রীদের একই গল্প শোনায়। গতকালের গাইড কী কী বলেছে তাঁর কিছুই সে শুনেনি, যদি শুনতো তাহলে অর্ধেক সময় তাঁর চুপ থাকলেও হতো।

প্রশান্ত মহাসাগরের একদম পূর্ব কোণে ৬৮০০ টি দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট্ট এই দেশটি নিয়ে পৃথিবী জুড়ে মানুষের বিস্ময়ের সীমা নেই। প্রযুক্তির মুন্সিয়ানায় গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছে জাপানিরা, কিন্তু তাদের সাফল্যের দৌড়  কেবল কাঠখোট্টা প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, শিল্প সাহিত্যে চিত্রকলা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ঈর্ষণীয় বিচরণ।

তার কথাবার্তা এখন আর আমাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না। মনে হলো যে স্ক্রীপ্ট মুখস্ত করে এসেছে এটা গতকালের গাইড আমাদের বলে ফেলেছে। একই কথা, একই পরিসংখ্যান।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করি- আমি জাপানের তিনজন লোকের খুব ভক্ত এদের ঠিকানা পাই কই ?

সে বলে-কারা ?

আমি বললাম, আকিরা কুরোসাওয়া, হারুকি মুরাকামি, তাদাও আন্দো।

এর মধ্যে সে নাম জানে একজনের । কুরোসোয়া। বাকিদের নাম শুনেনি।

আমি বললাম, তার ছবি দেখেছো ?

সে হাসে। গগন বিদারী হাসি। হাসতে হাসতে বলে-  না , দেখেনি। তবে ছবির নাম শুনেছেশ- সেভেন সামুরাই।

আমি বলি-  টম ক্রুজের দি লাস্ট সামুরাই ছবি দেখেছো ?

সে আবার হাসে। এবার তার হাসির মানে বুঝে ফেলি আমরা সবাই। এর মানে হচ্ছে সে আসলে প্রশণটাই বুঝে না। ইংরেজু যেটুকু বলে টা মুখস্ত। অথবা এমন হতে পারে- আমাদের বাংলাদেশী এক্সেন্টের ইংরেজির সাথে সে একেবারেই পরিচিত না বলে সেই রহস্যময় হাসিটা দেয়, যার মানে হ্যা হয় আবার না ও হয়।

আমাদের বাস থামে একটা টাইল ফ্যাক্টরির শো রুমে। জাপানি টাইলস দেখান হবে বাংলাদেশ থেকে আসা এই স্থপতিকূলকে । এটা দেখানো শেষ হলে নিয়ে যাবে একটা কাকড়ার রেস্টুরেন্টে। কাকড়া দিয়ে লাঞ্চ খাওয়াবে সবাইকে।

দ্বিতীয় দিনের টোকিও ট্যুরে থাকা বাংলাদেশী স্থপতিকূলের কয়েকজন

আমি সবার শেষে নেমে দালানটির বাইরে, ফুটপাতে সিঁড়ির গোড়ায় বসে থাকি। এগারো তালার শো রুমে যাই না। বসে বসে আমার জাপানি মানুষজন দেখতে ইচ্ছা করে। এবং দেখি যে এক বৃদ্ধ তার বাড়ির সামনের জায়গাটি নিজে নিজে পরিস্কার করছেন। তার হাতে যে জিনিস, এটা মিউনিসিপ্যালিটির কর্মীদের হাতে দেখেছি পৃথিবীর অন্য দেখে। এখানেও হয়তো আছে। কিন্তু তিনি যে মিউনিসুপ্যালিটির কর্মী না, তার পোশাক দেখেই বুঝতে পারি।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য  জিজ্ঞেস করি- স্যার, ইয়োর হোম ?

তিনি কথা না বলে নিজের দিকে আঙুল দেখান, আমি বুঝি- জানতে চাইছেন, আমি তাকেই এ প্রশ্ন করেছি কী না।

আমিও কথা না বলে মাথা নাড়ালাম, মানে- হ্যাঁ।

তিনি উল্টাদিকের দালানের দোতালার দিকে আঙুল দেখালেন, ওটাই তার বাড়ি, দোতালায় তিনি থাকেন। বয়স হবে আশির উপরে, নিজের বাড়ির সামনের জায়গাটা নিজেই পরিস্কার করছেন।

নিজেদের সড়ক নিজেই পরিস্কার রাখে জাপানীরা

এমনিতে জেনেছি যে, জাপানে স্কুলের শিশুদের প্রথমেই শেখানো হয় পরিচ্ছন্নতা। টয়লেট থেকে শুরু করে স্কুল আঙিনার সবকিছু ছাত্ররা নিজ হাতে করে। শুধু ছাত্ররাই না, তাদের শিক্ষকেরাও নিজ হাতে তাঁদের আঙিনা পরিস্কার রাখে। আর শিশুদের স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি আদব-কায়দা শেখানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়ে থাকে। গুরুজনদের সম্মান করা, মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সবাই মিলে কাজ করা ইত্যাদি শিক্ষা একদম ছেলেবেলায় জাপানিদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়।

বিশ্বজুড়ে অসম্ভব করিৎকর্মা পরিশ্রমী একটি জাতি হিসেবে জাপানিদের দারুণ সুনাম রয়েছে। দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে অবসরের পরও তারা ঘরে বসে থাকতে পছন্দ করে না। ঘরের কাজে, বাচ্চাদের যতœআত্তিতে, বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে ব্যস্ত সময় কেটে যায় তাদের। পরিশ্রমের সুফলটাও প্রত্যক্ষ। জাপানের মানুষের চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে কম, শরীর শক্তপোক্ত থাকে বহুবছর পর্যন্ত। সবচেয়ে দীর্ঘজীবী মানুষের তালিকায় জাপানের অবস্থান তৃতীয়। গড়ে প্রায় ৮৩ বছর বাঁচে জাপানিরা, পুরো জীবনটাই কাটে কাজের প্রতি বিপুল উদ্দীপনায়, পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে।

আমাদের ইতিহাস শুনতে ইচ্ছা করে না, আমরা এই মজার গাইডকে নানা রকমের প্রশণবানে জর্জরিত করতে থাকি।

আমাদের একজন তাঁকে প্রথম প্রশ্ন করে – আচ্ছা , তুমি কি গান গাইতে জান ?

ইংরেজিতে যেকোন প্রশ্ন তাঁকে করলে এমন ভাবে মুখ ও মাথা নাড়ায় আর চোখ মুখে কথা বলে যে এর মানে হ্যাঁ। না, নাই তার মুখে, যা বলা হবে তার উত্তর হ্যাঁ দিয়ে শুরু করবে । যে ও মাথা এমনভাবে নাড়ে যে মনে হয় বলছে- হ্যাঁ হাঁ গাইতে পারি।

 

উত্তর সে জেনেই দিক বা না জেনে, আমাদের ইচ্ছা হয় এক্ষুনি তার গান শুনতে।

কিন্তু এই ট্যুর গাইডে রকাজ তো আর গান শুনানো নয়। কিন্তু সবাই কে অবাক করে দিয়ে যে বলে- ঠিক আছে , তোমাদের সবাইকে নিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দেব, তখন গান শুনাবো। এখন যাই খেতে।

জাপানে মাত্র দুইদিন হয়েছে আমাদের। আরো কতো কিছু যে দেখব!

আমাদের দল চলে আসে টাইল্স্ সামগ্রি দেখে। আমাদের গাইড তাড়া দিচ্ছে কাকড়া রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে।

এমনিতে জাপানি খাবারে আমি এখনো স্বাদ পাইনি। নানা বেরাছেরা হচ্ছে এই খাবার নিয়ে। দেখা যাক আজ কী আছে সেখানে ।

আহ ! কাকড়া ভোজনের সেই ক্ষণ

কাকড়াহার

চীনাদের কে আমার জাপানের খালাতো ভাই মনে হতো। অনেক কিছুতেই তাঁদের মিল। চীনাদের খাবারের সাথেও দেখি মিল আছে জাপানিদের। দেশে যে চীনা খাবার খেয়ে আহ্লাদের ঢেকুর তুলেছি, চীনে গিয়ে চীনা খাবার মুখে তুলতে না পেরে একই রকম বিষাদ লেগে ছিলো। চীনের প্রথম রাতে পাঁচতারার বড়  হোটেলে জাপানি খাবার খাইয়েছিল আমাদের চীনা আপ্যায়ক। সে রাতে হোটেলে ফিরে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া চিড়া টি-পটে ভিজিয়ে ব্রাউন-সুগার মিশিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। জাপানে যাতে একই অবস্থায় না পড়তে হয়, এবার সাথে করে বেশি চিড়া আর চিনি নিয়ে এসেছি। জানি- জাপানি খাবারও আমার মুখে রুচবে না। মুখটা জাপানে নিয়ে এলেও জিহবাটাতো আমার দেশি রয়েই গিয়েছে।

ঢাকার গুলশানের এক জাপানি রেস্তোরায় বার কয়েক শুশি খেয়ে তৃপ্ত হয়েছি, জানি মূল জাপানি শুশি এমন হবে না। সেখানে আসল কাঁচা মাছটিই থাকবে, পারলে মাছের সাথে রক্ত লাগিয়ে রেখে দেখাবে এটা আসল কাঁচা মাছ। সুতরাং আমি জাপানি খাবারে নাই, এটা ধরেই নিয়েছি আর সে কারণেই কী-না জানি না, এই যে আমাদের বাস ভর্তি ঢাকাইয়া স্থপতিকুলকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে গাইড নানা রকমের মজার মজার কথা আর অঙ্গ ভঙ্গি করছে তাতেও আমার এখন আগ্রহ কম।

আমার কান যদিও গাইডের দিকে, আমার চোখ আমার হাতে ধরে রাখা ওজমোপ্লাস-এ, চোখ আমার সেলফোনের ভিউফাইন্ডারে। বাসের স্পিকারগুলো যেখানে আছে তাঁর কাছে লাগিয়ে রেখেছি আমার একটা ভয়েস রেকর্ডার। সুতরাং আমার কোন চিন্তা নাই। মন দিয়ে এখন সব কথা না শুনলেও হবে- দেশে গিয়ে শুনে নেব আবার, লেখার আগে।

এরমধ্যে জাপানি খাবারের ধারণা আমার অনেকটুকুই হয়ে গেছে। প্রথম ভোরে টোকিওর সবচেয়ে বড় হোটেলের সবচেয়ে বড় ডাইনিং স্পেসে খেতে গিয়ে শতাধিক পদের খাবার বেছে শেষমেশ ব্রেড-বাটার-জেলি আর ফলফলাদির মধ্যে শেষ করেছি।

আমাদের রসিক গাইড ডানদিকের একটা বিল্ডিং দেখিয়ে বলে, এখানে একটা বাজার আছে। সকালবেলা মাছের নিলাম হয়। সমুদ্র থেকে আসা মাছ সারারাত ধরে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দেয়া হয়। সকালবেলা, সূর্য ওঠার সাথে সাথে শতশত লোক এসে এই মাছ বাজারে ভিড় করে, তাঁরা নিলামে মাছে কেনে। শুধু তাই না, মাছের এই বাহারি আয়োজন, এবং মাছের নিলাম প্রক্রিয়া দেখার জন্যও প্রচুর লোক এখানে আসে, তাঁরা প্রধানত ট্যুরিস্ট। আর এই মাছবাজার দেখতে এসেছিলেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা। জাপানের প্রধানমন্তীকে সাথে নিয়ে সুশি খেয়ে তৃপ্তও হয়েছিলেন তিনি।

জাপানের ঐতিহ্যবাহী রন্ধন প্রণালী চালের উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়। যেহেতু আদি কাল থেকেই এটা সমুদ্রঘেরা একটি দেশ, তাই নানাজাতের সামুদ্রিক মাছ তাঁদের আহারে প্রধান উপাচার হয়েই আছে। তার সাথে আছে শাকসব্জীর আচার এবং পাতলা ঝোলের শাকসব্জির তরকারী।

আমি গাইডের কাছাকাছি চলে আসি। গাইডের কথা সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হচ্ছে রফিক আজম ভাইকে। তিনি সুবোধ বালকের মতো বসেছেন সামনের সিটে তাঁর তরুণী স্ত্রীকে নিয়ে। এবং এ কারণে তাঁকে যতোটা তরুণ হতে হয়েছে তাঁর স্ত্রী হয়েছেন আরো গম্ভীর। স্ত্রীর বয়েসী তরুণী স্থপতিরা যে রকম চিল্লাচিল্লি চেচামেচিতে থাকেন তাঁর এই স্ত্রী একেবারে তাঁদের বয়েসীদের মত নন।

আমি পাশের এক খালি সিটে বসে গাইডকে  জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা- এই যে তোমাদের বয়স বোঝা যায় না, সবাই  কেমন যেনো তন্বী-তরুণীর মতো, এর সিক্রেট কি জাপানী খাবার ?

গাইড হাসে। তাঁর সেই চোখ-মুখ-নাক-নিয়ে হাসা হাসি। হাসতে হাসতে বলে- ইয়েস , ইয়েস, ফুদ হেবিত।

আমি বলি, সারা দিন তোমরা কী খাও?

সে বলে- আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবারের সময় হলো সকালের নাস্তা। সকালে মিশো সুপ, একটি মান্দারিন আর এক কাপ গ্রিন টি বেশিরভাগ জাপানিরা খায়। মিশো সুপে চর্বি কম । এর সাথে তিনটি লাল আটার রুটি শাক-সব্জি দিয়েও খাওয়া হয়।

জাপানি লোকেরা দূপুরে এক বাটি সুসি সয়া সস দিয়ে খায়। এটা একেবারেই কাঁচা মাছ দিয়ে বানানো । সাথে মাশরুম দিয়ে এক বাটি নুডুলস ও একটি আপচ। আর সকালের মতই এক কাপ গ্রিন টি। জাপানিদের রাতের খাবার তালিকায় থাকে এক বাটি ভাত, একটি কমলা ও সসিমি যা বিভিন্ন মাছের সমন্নয়ে তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহি জাপানি খাবার। আর প্রতিবেলা খাবারের পর তারা এক কাপ গ্রিন টি পান করতে পছন্দ করে ।

খাবারের গল্প শোনা শেষ, এবার খেতে যাওয়ার পালা।

আমাদের গাড়ি এসে নামে সেই বিখ্যাত কাকড়া রেস্তোরায়। পুরো রেস্টুরেন্টের সামনে নানা জাতের কাকড়ার বড়বড় ছবি। সাথে জাপানি ভাষায় অনেক লেখা। ইংরেজির চল নাই। খাবারের দামের তালিকায়ও জাপানি হরফ। ঠিক বুঝতে পারছি না, কতো টাকার খাবার আমরা খাবো। বুঝে লাভও নাই। বিলতো আমাদের দিতে হচ্ছে না। বিল দেবে সেই জাপানি কোম্পানী যাদের টাইলস ও স্যানিটারি ফ্যাক্টরির শোরুম আমরা দেখে এসেছি। আমার কাজ খাওয়া, দেখা আর আর ছবি তোলা।

রেস্টুরেন্টে ঢুকেই দলের সবাই খাওয়ার কথা ভুলে দল বেঁধে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।;

ভেতরে ঢুকতে হলে বাইরে জুতা রেখে ঢুকতে হবে। জাপানিরা তাঁদের ঘরে বাইরের জুতা পায়ে নিয়ে ঢুকে না। বাইরে থেকে আসা লোকদের জন্য জুতা রাখার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। না, জুতা চোর নাই সেখানে। এ কারণে কোন তালা মারার ব্যবস্থাও নাই। তাকের উপর জুতা রাখতে হয়। যিনি তাকে না রেখে সামনের দোরগোড়ায় রেখে  গেলেন তাঁর জুতাটি পরিপাটি করে এক কর্মি এসে নিরবে সাজিয়ে রেখে চলে যাচ্ছে কাজে। এবং কাজটা করছে খুব দ্রæত।

ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিললো জাপানি খাবার টেবিলের। দেখে বুঝলাম, তাঁরা প্রায় মাটিতে বসেই খায়। জানু পেতে বসার পর যতটুকু উচ্চতার টুল লাগে, সে পরিমান টুল সামনে সাজানো।

আমাদের বসা মাত্রই একে একে সাজানো খাবারগুলো চলে আসতে লাগলো। তিন কোর্সের খাবার। প্রথমে ভাজা পোড়ার মতো কিছু, পরে ৭ আইটেমের থালি যার মাঝাখানে বিশাল একটা কাকড়ার মাংশ আর দুই ট্যাং রোস্ট করা, আর শেষে মিষ্টান্ন জাতীয় আরো কয়েক পদ। এক বাটি ভাত আছে, আছে নানা জাতের আচার, সব্জি। খাবারের সাথে আলাদা পানি নাই,  আছে পানি জাতীয় স্যুপ। আমি সবার খাবারদাবারের ছবি তুলি। এতো সুন্দর করে প্লেট সাজিয়েছে যে খেতেই ইচ্ছা হচ্ছে না, মনে হলো খেতে শুরু করলেই তো আর সাজানোটা নষ্ট করে ফেলবো।

জাপানী গাইড বলে কথা । কখনো ট্যুরিস্টের ছবি তুলে দিচ্ছে, কখনো গান শোনাচ্ছে আবার রেস্টুরেন্টে টুরিস্ট নিয়ে গিয়ে খাদেম সেজে খাওয়াচ্ছেও

একসময় দেখি আমাদের সেই গাইড এখানে এসে রেস্টুরেন্টের ওয়েটারের সাথে কাজে লেগে গেছে। খাবার প্লেট এনে দিচ্ছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি দেখলাম, তা হচ্ছে এই রেস্টুরেন্টের কোন ওয়েট্রেস (এরা শতভাগ মহিলা) হাঁটে না, সবাই দৌড়ায়। দৌড়াতে দৌড়াতে খাবার সার্ভ করে, করার আগে কাস্টমারের হাটুর কাছে বসে তারপর আনত ভঙ্গিতে হাসি মুখে খাবার তুলে দিতে থাকে। কারো অতিরিক্ত কাচা মরিচ বা লবনের দরকার হলে তা এনে দেবার জন্য তাদেরকে মহা ব্যস্ত হতে দেখি। এবং এক সময় খাবারের ছবি তোলা শেষ করে আবার বাসে উঠি।

বাসে উঠে গাইডকে ফিস সিফ করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাদের এই সেট মেন্যুতে পার হেড কতো পড়েছিলো।

সে সেলফোনের ক্যালকুলেটর টিপে বলেছিল- পার হেদ এইতি দলার।

আমার কাকড়াহার পড়ে থাকে রেস্টুরেন্টে। আমি অপেক্ষায় থাকি রুমে গিয়ে কখন দুধ-চিড়া খাবো

আমি তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে চিড়া ভিজানোর অপেক্ষায় থাকি।

রপঙ্গির আকাশছোঁয়া দালান

কাকড়া রেস্তোরায় খাওয়া শেষ। এখনো পুরো দিনি বাকী। এঁরা দুপুর সাড়ে বারোটায় নিয়ে এসেছিল দুপুরের খাবার খেতে। খাওয়া শেষ। এখন বেলা দু’টো। সন্ধ্যা নামবে সাড়ে ছ’টার দিকে। আমাদের টোকিও দেখানোর জন্য আমরা আজ সারাদিন আছি আমাদের কৌতুকাভিনেত্রী গাইডের সঙ্গে। জানি না এখন আমরা কোথায় যাবো।

এক সময় আবার বাসে উঠে আমরা সিটবেল্ট বেঁধে বসে থাকি। আস্তে আস্তে বাস চলতে শুরু করে। মাইক হাতে গাইড। সে জনালো, আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে একটা মিউজিয়ামে। মরি, আর্ট মিউজিয়াম।

এই প্রথম আমাদের কোনো নাগরিক চত্বরে আসা। চারপাশে কাচঘেরা দালান। বোঝাই যাচ্ছে, এগুলো নানা রকমের অভিজাত শপিং কমপ্লেক্স। কাল যে বায়তুল মোকাররমে গিয়েছিলাম সেটা নয়, এটা বসুন্ধরার আরেক টোকিয়ান ভার্সন।

সাড়ে ৫শ ফুট উপর থেকে ক্যামেরা দিয়ে টোকিওকে ধারন করার চেষ্ঠা

মূলত: রপংগি পাহাড় চত্বরটিকে অভিজাত নাগরিক রূপ দেবার জন্য, এই সেদিন, মানে ২০০৩ সালে এখনে এই মরি টাওয়ার বানানো হয়েছিল। মানুষজনকে টেনে আনার জন্য তৈরি করা হয়েছে একটা কালচারাল কমপ্লেক্স। এখানে সিনেপ্লেক্স আছে, আর্ট মিউজিয়াম আছে, আর আছে একটা উঁচু বাণিজ্যিক ভবন।

 খোঁজ নিয়ে জানি, মরি মিনরু আর মরি ইয়োহিকু দম্পতিই এই চত্বরের হোতা। সঙ্গত কারণে তাঁদের নামেই টাওয়ারের নাম।

কিছুদূর হাঁটাহাঁটি আর ফটোফাটি করে হঠাৎ দেখি স্কাইভিউ কাউন্টারের দিকে আমাদের লোকজনের ভিড়। এরা কেউ আর জ্ঞানার্জনের জন্য আর্ট মিউজিয়ামে যেতে চাচ্ছে না, মিউজিয়ামের টিকেটের সাথে ফাও পাওয়া ৫২ তলার ডেকে চড়ে সবাই টোকিও দেখতে চান।

এই বিল্ডিংটি সাকুল্যে ৫০ তলার। তার ৪৯ থেকে ৫৪ তলার নানা ফ্লোরে নানা রকমের প্রদর্শণীর ব্যবস্থা আছে। বাকী ফ্লোগুলো ¯্রফে কমার্শিয়াল অফিস হিসাবে ভাড়া দেয়া। এদের চলাচলের পথ আলাদা। সতরাং আমাদের দেখা হয় না দালানের অন্য ব্যবহারকারীদের সাথে। আমরা দেখি টোকিও, দেখি নানা জাতের  পর্যটক।

পৃথিবী প্রায় সব বড় শহরেই এমন একটা উঁচু দালান থাকে, যখন থেকে পর্যকটদের শহর দেখানো হয়। এর শুরু বোধ হয় প্যারিসের আইফেল টাওয়ার দিয়ে। সেটা প্রায় দেড়শ বছর আগে বানানো হয়েছিল মূলত: একটা শিল্প প্রদর্শণীর সময়, ক্রেতা আকর্ষনের জন্য। আমাদের গ্রামাঞ্চলের মেলাও যেমন লাল-নীল বাতির চরকী থাকে, এটা দেখে মানুষ আসবে তার জন্য। প্যারিসের মেলা শেষ হয়ে গেলেও উঁচু মিনারটি রেখে দেয়া হয় পর্যটকদের আর্কষনের জন্য। এরপরও পৃথিবীর নানা বড় শহরে এমন হয়েছে, তার অনেকগুলোতে  আজ যাওয়া হয়েছে। আমেরিকার নিউইয়র্ক, শিকাগো, লাসভেগাস- এসব শহরে সবচেয়ে উঁচু তলার টিকেট কেটে উঠে শঞর দেখেছি। আমাদের এশিয়ার কুয়ালালামপুরে বা চীনের সাংগাইতে এমন কিছু দেখেছি। অনেক শহরের এই উঁচু দালানটি যখন হয়েছে, বিশেষ করে গত শতকের ৮০’র দশকের পর থেকে, তা সেই শহরের ল্যান্ডমার্ক স্থাপনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বার্লিন, মন্ট্রিয়েল, সাংহাই এসব শহরের ল্যান্ডমার্ক স্তাপনা হিসেবে এইসব উঁচু দালানের কথা বলা হয়ে থাকে।

রপঙ্গি থেকে দেখা টোকিও

 টোকিওর এই রপঙ্গি ছিল সে অর্থে তেমন কোন উঁচু দালান নয়। খোদ টোকিওতেই এর চেয়ে উঁচু আরো ৫টি দালান আছে। উচ্চতার বিচারে এটা ৬ষ্ঠ। সপ্তম স্থানে আছে টোকিওর সবচেয়ে খান্দানী টাওয়ার, টোকিও টাওয়ার। ১৯৫৮ সালে এটা বানানো। রবীন্দ্রনাথ একশো বছর আগে যখন এই টোকিও এসেছিলেন তখন তিনি দু-তিন তলার উঁচু দালান দেখেন নি, তাই উঁচু দালানের কথা তাঁর লেখায় নাই। আমরা ছোটবেলা থেকে এই রেডিও এন্টিনা লাগানো টোকিও টাওয়ারের ছবি দেখে এসেছি। মাত্র ৭টি তলা নিয়ে ৩৩৩ মিটার উঁচু এই টাওয়ার। রেডিও এন্টিনা লাগানো বলে ওর উচ্চতা শুধু পরিমাপের কাজে লাগে, উপরে উঠা যায় না বলে তাকে নামিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। আইফেল টাওয়ারের গড়নে তৈরি এটা। তবে শুধু উচ্চতা বিচার করলে এটা কেবল ৬৩৪ মিটার উঁচু টোকিও স্কাইট্রির পরে স্থান নেয়। স্কাই ট্রি আমরা কাল নদী থেকে দেখে এসেছি। সুমিদ্য অঞ্চলে তার বাস। বড় বড় কমার্শিয়াল বিল্ডিং সেখানে আছে। এবং এটাও ব্রডকাষ্টিং টাওয়ার হিসাবে বানানো। ২০৮০ ফুট উচ্চতায় এই টোকিও স্কাই ট্রিটি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার। এর আগের টোকিও টাওয়ার দিয়ে ডিজিট্যাল ট্রানসমিশন সম্ভব হচ্ছিলো না বলে জাপানীরা মূলত: তাদের টেলিভিশন সম্প্রচার বাড়ানোর জন্য এ টাওয়ার বানিয়েছিলেন।

আমাদের এই রপ্পঙ্গি হিল টাওয়ার তেকে খুব ভালো করে দেখা যায় টোকিও প্রাচীনতম অভিজাত সেই টোকিও টাওয়ার। এছাড়াও টোকিওর অন্যসব উঁচু দালানগুলোও বেশ স্পর্শ এখান থেকে। বিশেষ করে মিনাটো অঞ্চলের তরানোমন হিলস, মিডটাউন টাওয়ার কিংবা সিনজুকুর মেট্টপলিটন গভর্ণমেন্ট বিল্ডিং এখান থেকে খুব স্পষ্ট।

তবে সুদর্শণ দালান দেখার জন্য সিনজুকুর খুব নামডাক। এখান থেকেই জাপানের সবচেয়ে ভালো ট্রেনগুলো ছাড়ে। বড় রেল স্টেশন এখানেই।

রপ্পঙ্গি হিলস-এর মরি টাওয়ারে সারাদিন বসে থাকা যায়। বসে থাকার মতো নানা রকম জায়গাও তৈরি করে রাখা আছে। যদিও স্থির  বস্তুর সামনে দীর্ঘক্ষণ তিথু হয়ে বসে থাকা যথেষ্ট বিড়ম্বনার, তথাপিও এ জায়গাটি সে রকম নয়। সে রকম নয় এজন্য যে, সামনের দৃশ্যপটের মধ্যে থাকা স্থির বস্তগুলো আমলে বড় বৈচিত্রময়। আছে বসবাসের ঘর, আছে অফিস কাচারী। আছে ছাদের উপর বাগান, খেলার মাঠ, আছে সামনের বহুতল সড়কপথ। মানুষ ছাড়াও জড়বস্তুর সমাহারও যে অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে দেখা যায়, রপ্পঙ্গির এই টাওয়ারটা তাই। আর আকেটা বিষয় হচ্ছে, এর উচ্চতাটা এমন উঁচুতে নয় যে, নিচের ভ‚মির সাথে অনেক দূরত্ব তৈরি করে। সে কারণেই বোধ হয় এমন।

আমার সুবিধা অনেক। যেহেতু আমায় দেখার সময় ক্যামেরায় দেখাটাকেও গুরুত্ব দিতে হয় এবং তাকে যথেষ্ট স্থির করে রাখতে হয়, তাই ক্যামেরায় সাথে আমার নিজেরও বসে থাকার ফুরসত হয়ে যায়। আমার ক্লান্তি আসে না।

এক ফাঁকে ঘুরে দেখি এর নানা রকমের প্রদর্শণশালা। শুধু দেখিয়েই নয় নানা চমৎপ্রদ জিনিসপত্রের সওদা নিয়ে বসেছে এসব প্রদর্শণকারী। বিক্রিও হচ্ছে ভালো।

লাভলু ভাই যখন ক্যামেরা হাতে খুবই উত্তেজিত

এক ফাঁকে ইচ্ছে হলো, ৫৬ তলার উপরে থাকা খাবার জায়গাটিতে বসে হালকা পানীয় খেয়ে গলাটা ভেজাই।

 বেশ কাজ হয় তাতে। ট্রিপল হাইটের কাচের দেয়াল থেকে ফুড়ে যাওয়া আলোর ভিতর দিয়ে আরেক পলক টোকিও দেখে দেখে আমি সময় কাটাই।

কিন্তু বেশিক্ষণ বসা যায় না। আমাদের ডাক পড়ে বাসে যাওয়ার। এবং আমার ফোনে যেসকল ম্যাসেজ আসতে থাকে তার মর্মার্থ হচ্ছে, আমি ছাড়া বাকি সবাই বাসে উঠে বসে আছে। তারা কোথায় যাবে এখন জানি না। আমি তাড়াতাড়ি নেমে যাই। জাপানের আকাশরেখা দেখানো শেষ। বিকেল এখন চারটাও বাজে নাই। কি করি?

বাসে উঠানো হয়েছে আমাদের। বলা হলো, এই বাস সরাসরি চলে যাবে মিজি বিশ^বিদ্যালয়ে তার আগে আমাদেরকে জাপানের সবচেয়ে অভিজাত শপিং কমপ্লেক্স দেখানো হবে। এর ছাদে চমৎকার একটা বাগান আছে। মোট সময় ১৫ মিনিট। যারা ১৫ মিনিটে নেমে আসতে পারবেন, তাদের নিয়ে বাস যাবে মিজি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আর না এলে?

মুচকি হাসি হাসে আমাদের গাইড। বলে- ইত ইজ ইয়োর তাইম। বাত আই হেভ তু লিভ।

বুঝলাম, তার ডিউটি শেষ। আমরা নেমে পড়ি টোকিওর অভিজাত পাড়া গিনজাতে। গিনজার নামডাক শুনেছি। এখানে ‘গিনজা সিক্স’ একটা শপিং আর্কেড আছে, দুনিয়ার তাবৎ নামীদামী ব্রান্ডের শো রুম আছে এখানে, আর দালান।

গিনজার স্থাপনা

গিনজা  

টোকিওর আধুনিক দালানকোটা চোখ ধাঁধানো। ঝকঝকে, তকতকে, একেবারেই এনিমেশন করা থ্রি ডাইমেনশনাল রেন্ডার করা প্রজেক্টের ছবির মতো।

এখন যে এই মহাজৌলসের শপিং কমপ্লেক্স, তা বেশিদিন হয়নি। মাত্র আড়াই বছর আগে, ২০১৭’র এপ্রিলে এর উদ্বোধন হয়। এর মালিকানার সাথে যুক্ত আছেন মারি সাহেব, যাঁর আর্ট মিউজিয়াম আর স্কাইডেক দেখে এসেছি কিছুক্ষণ আগে। লোকটার শিল্পবোধ অতি উচ্চমাত্রার। বাণিজ্যের সাথে শিল্পের মিলমিশ ঘটানো খুব কঠিন। এই লোকটা করেছে। টোকিওতে বাড়তি সপ্তাখানেক থাকলে এই লোকটাকে খুঁজে বের করতাম। এখন সুযোগ নেই এসেছি একেবারে ভিন্ন ধাঁচের সব কিছুই চমকিত করে। এটা যেমন ইউরোপে গেলে হয় না। যাহা জার্মান; তাহা ইতালী- ঊনিশ বিশ। কিন্তু এঁরা আলাদাই। এঁদের কাজিন ব্রাদার চীনা, কোরিও। চীন দেখা হয়েছে, কিন্তু সাংহাই ছাড়া জাঁকজমকের তেমন কিছু কোথাও দেখিনি। এই টোকিও যা ছোটবেলা পোস্টকার্ডে দেখেছিলাম, সেই টোকিও এখানে নেই। এখন শান শওকতের ছড়াছড়ি তাদের সর্বত্র। কারিগরি উৎকর্ষতা হাতের মুঠোয় নিয়ে সবকিছু উপস্থাপন করে শৈল্পিক ভঙ্গিতে। কিন্তু দু’দন্ড যেকোন জাপানির সাথে খোসগল্প করবো, সে সুযোগ নাই। যে যার কাজে আছে কাজের কথা বলে। কাজ শেষে এক অক্ষরও কথা বলবে না। আর আছে ভাষার বিড়ম্বনা। যেহেতু তাঁরা তাঁদের জীবন ও জগতের সবকিছুই নিজের ভাষায় করে ফেলতে পারে, অন্য কোন ভাষা তাঁদের জানার প্রয়োজন হয়নি, সে যত বড় ডিগ্রীধারী শিক্ষিতই হোক না কেন। তবে আমার ধারণা, মাত্র কয়েক বছর ধরে একটু ইংরেজি এসেছে এই সমাজে। যে কারণে কিছু তরুণ-তরুণী, যারা এই মিলেনিয়াম বেবি, যাক যা ডিজিট্যাল গেøাবাল ভিলেজের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে তাঁরা বুঝানোর মতো কিছু  ইংরেজি শব্দ বলে। এই যা। তারপরও উচ্চারণটা তাঁদের নিজের। আমাদের নোয়াখালির উচ্চারণে কেউ বাংলা বললে যেমন শুনায়ম, এঁদেরটাও তাই এঁদের জিহবায় ‘ট’ নেই সবই ‘ত’। টোকিওতে আছি, অথচ জাপানিদের মুখে শুনছি ‘তোকিউ’। এই যা।

গিনজা সিক্স ১৯ তালার কমপ্লেক্স। র‌্যাম্প বাইয়ে, গ্রাউন্ড ফ্লোরে যেখানে আমাদের নামানো হলো এটা থেকে উপরে মাত্র ১৩ তলা। তার বাদবাকীগুলো নিচে, নামতে নামতে মারি তলায়। মাটির তলায় লিফ্ট- এসকেলেটর দিয়ে সুড়সুর করে চলে যেতে যেতে মনেই হয় না, কোথায় এলাম। মাটির তলায় আরেক টোকিও। ঘরবাড়ি নিশ্চয়ই নেই। নাকি আছে। জানি না। তবে এও শুনেছি, ভ‚মিকা প্রবণ এই শহরটিতে বড় ভ‚মিকম্পে উপরে ওঠার পথ বন্ধ হয়ে গেলে পুরো জনগন অন্তত: ৪৮ ঘণ্টা যাতে থাকতে পারে, সেরাম খাবার দাবার, বিছানাবালিশ মাটির তলায় এঁদের মজুদ আছে। গাইডের কথা রাখতে গিয়ে আমরা প্রথমেই চলে যাই ১১ তলার উপর রুফগার্ডেনে। উঠে দেখি একটা পার্ক যেন বানিয়ে রাখা আছে ছাদের উপর। আছে জলাশয়।

ছাদের উপর পার্কের বাংলাদেশী মহিলা স্থপতিকূলের একাংশ

সেখান থেকে কলকল বেগে কলকল বেগে পানির ¯্রােত বইছে, অনেকা আমাদের সিলেটী পাহাড়ী এলাকার ছড়াগুলোতে যেমন কলকল করে পানি ছোটে তা। স্বচ্ছ পানির ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তাঁর অমসৃণ তলদেশ। খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ইঞ্চি চয়েক গভীরতার এই জলাশয়টি বানানোই হয়েছে ছাদের উপর পানির চলাচল দেখানো আর এখান থেকে লিনুয়া বাতাসের প্রবাহ গায়ে মাখানোর জন্য। এর এক পাশে শপিং আর্কেডের রুফটক বার, অপর পাশে কংক্রিটের কিছু ফ্রেম উচিয়ে দেয়া হয়েছে, তাঁর ফাঁক দিয়ে গাছগাছালির সারি। আছে পায়ে হাঁটার পথও।

ছাদের উপর জলাশয়

এইটুকু দেখতে দেখতেই আমরা জেনে যাই আমাদের ফেলে বাসটি চলে গেছে মিজি বিশবিদ্যালয়। সুতরাং খেতাপরি ট্যুরিস্ট বাস। আমরা নিজেরাই দেখে নেবো বাকীটা টোকিও। আমাদের হাতে অনেক সময়।

আমি লিফ্ট দিয়ে কয়েক ধাপ নামি। খবর পাই ১৪ নং তলার কফিবারের সামনের খোলা জায়গায় আমার সঙ্গীদের কয়েকজন আছেন। তারা বসে বসে টোকিওর অতি আধুনিক এইসব স্থাপত্যকলার নানা কথাবার্তা বলছেন।  কোন বিল্ডিং-এর সামনে কি পর্দা দিয়ে তাকে আটকানো হয়েছে, কীভাবে এটা সেডিং। ডিভাইসের কাজ করেছে এমন। কেউ কেউ এই বিল্ডিং-এর আর্কিটেক্ট ইয়োশিও থানিগুটির কথা বলছেন যে, আপাত দৃষ্টে একটা বাক্সের মতো দালানের ভেতরটা কেমন করে সাজালো এই ব্যাটা। কেউ কেউ বলছেন, এমন স্বাধীনতা আর সুযোগ পেলে, এমন বড় জায়গা পেলে আমরাও এমন ডিজাইন দিতে পারতাম।

এক ফাঁকে আমি কিছু দোকান দেখে আসি। কোথায় যাবো, কী দেখবো, বুঝতে পারি না। কেনাকাটা যেহেতু আমার রুটিনের মধ্যে নাই, তাই আমার দুই হাতে দুই ক্যামেরা এক করে ওদের ভিউ এলসিডি গুলোর দিকে তাকানো ছাড়া আমি আর দেখবোই বা কী। এসব ক্ষেত্রে আমি কিছু প্রাকৃতিক ক্রেনশট পেয়ে যাই। খাড়া এসকেলেটর বা ক্যাপসুল লিফ্ট আমার ছবি তোলার জন্য পছন্দের জায়গা। ক্যাপসুল লিফটে স্বচ্ছ কাচ না পেলে ঝামেলায় পড়ে যাই। এসকেলেটরে সে অসুবিধা নাই। আমি বার কয়েক উঠি বার কয়েক নামি। প্রতিবার এঙ্গেল বদলাই। আমার কাজ হয়ে যায়।একটা বুক সেন্টার দেখে এক ফ্লোরে নেমে পড়লাম। বই আর বই। আমাদের পাবলিক লাইব্রেরির গোটাটা বোধ হয় ভরে ফেলানো যাবে এখানে। অন্তত: ১০ হাজার বর্গফুটতো হবেই একটা স্টোরে। এখানে নানা পদের বই ছাড়াও আছে খাতা কলম স্টেশনারিও আর্টওয়ার্কের নানা সামগ্রি। আছে খাবার ও পান করার জায়গা। তবে সবচেয়ে অবহেলিত অংশ, এক চিপার ভেতর ছোট গলি? শেষ মাথায় আছে একটা স্মোকিং কর্ণার। গিয়ে দেখি কয়েকজন তরুণী আপন মনে ধূমপান করেই যাচ্ছেন। এরা জাপানি না অন্য কেউ বুঝতে পারি না। তবে বোচা নাকের। কোরিয়ান বা চীনা পর্যটক না হলে এরা নির্ঘাত জাপানি। জাপানিদের খুব বেশি সিগারেট খেতে দেখি না তবে পুরুষের চেয়ে মহিলারা বেশি সিগারেট খান কিনা পুরো পরিসংখ্যান না দেখে বলা যাবে না।গিনজা সিক্স থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি শুরু হয় আমাদের। বড় দল থেকে ছোট দলে চলে এসেছি। সঙ্গের বাকি জনাতিরিশেক কেথায় গেলো জানি না, নিশ্চয়ই যে যার মতো ঘুরতে বেরিয়েছে। আমরাও বেরিয়েছি, কিন্তু কী দেখতে বেরিয়েছি আমার দলের লোকেরা জানলেও আমি জানি না।আমি একটা হাতলের মধ্যে আমার গো-প্রো ক্যামেরাটা সেঁটে রেখে বড় ভাইদের অনুসরণ করি আর শেষ বিকেলের টোকিও দেখি।

বিদেশী সিনেমায় হাই ডেফিনেশনের ফিল্মে শুট করা চকচকে নাগরিক চত্বর যেমন দেখা হয়েছিল আগে, এখানেও দেখি তাই। বিকেলের সূর্য আড়াল হয়ে গেছে, তার রোদ নাই, কিন্তু প্রতিফলিত আলোর আভা আছে। এই আভা দিয়ে দালান দেখা যেতো না, দালানগুলোর নিজস্ব আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে আপনা থেকেই, তার সাথে যুক্ত হওয়া শেষ বিকেলের আলো। এমন মায়াবী একটা আলোয় টোকিওর সবচেয়ে আধুনিক বাণিজ্যিক এলাকার দালানকোটার দিকে ক্যামেরা ঘুরালে তা তো সহজে আর সরিয়ে আনাও যায় না। এর মধ্যেই আমি শহর দেখি, লোকজনের চলাচল দেখি। কিছুক্ষণ আগে যাঁদের অফিস ছুটি হয়েছে তারা এখন ছুটছে।আমি একসময় আলোচকদের কাছে এসে দাঁড়ালাম। জগলুল ভাই আমার ৩ বছরের সিনিয়ার, খোকন ভাই আর লাভলু ভাই দু’বছরের বড় আর্কিটেক্ট। সুতরাং মরুব্বিদের বিচার বিশ্লেষণের মধ্যে নিজের মতামত এনে হাজির করে দেয়ার মতো বড় বেয়াদব আমি নই। আমি শুধু এটুকু বুঝলাম যে, কয়েকজন মাস্টার আর্কিটেক্টদের করা আমাদের চোখের সামনের এই দুমড়ানো মোচড়ানো আকারের অবয়বটি কীভাবে ড্র করা হলো, এর স্ট্রাকচার কী করে করা হলো, এসবের আলাপ হচ্ছিলো।

একজন ফ্র্যাংক ও’গেরির কথা বলছিলেন যে, প্রথমে সহজ সরল ফর্মের একটা দালানের মডেল বানিয়ে নেবার পর এর উপর কিছু একটা দিয়ে চাপ দিয়ে এর দলানো মোচড়ানো যে আকার বেরোয়, সেটাকেই জুনিয়ার আর্কিটেক্টের হাতে দিয়ে বলা হলো- এটা নামাও। আমি দুইদিন পর দেখছি।দুইদিনপর দেখে কয়টা টান মেরে দিয়ে খালাস। কম্পিটিশন হলে বিচারকরা এটা কোন কিছু না বুঝেই নম্বর দিয়ে দেবেন। আর্ট ক্রিটিকরা কেউ কেউ সমালোচনা করে একেবারে নালায় ফেলে দেবেন আবার আরেকদল এই প্রমেক্টটাকেই হয়তো এওয়ার্ডেড করে দেবেন। এই হচ্ছে।

কথা বলতে বলতে তারা ট্যাক্সি নেবার জন্য উবারের এপ্স্এ চাপ দিলেন। ভাড়া আসবে আট হাজারের মতো। ওঁদেরই একজন বললোÑ হাতে সময় আছে, চলো ট্রেনে যাই।জাপান রেলে ৭দিন অসীম দূরত্বে ফার্স্টক্লাস কেবিনে চড়ার জন্য দেশ থেকে টিকেট কেটে এসেছি। দেশী টাকায় এর মূল্য ছিলো সাড়ে একত্রিশ হাজার টাকা। এই টিকেট দেখিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড, বা-ট্রেন সবকিছুতে চড়া যাবে। কিন্তু এখনই এই টিকেট ব্যবহার করা যাবে না। করলে পরবর্তী দূর যাত্রার শেষ দিনে আটকা পড়ে যাবো। ঠিক হলো আমাদের জাপান বাসের চতুর্থদিন থেকে তা কার্যকর করানো হবে এবং বলবৎ থাকবে একাদশতম দিবস পর্যন্ত যেদিন আমার জাপান ছাড়বো।ঠিক হলো নতুন করে টিকেট কেটেই যাবো। এর মধ্যে নতুন আরেকটা সাব-ওয়ে দেখা হয়ে যাবে টোকিওর।

টোকিওতে মাটির তলার পাতালরেলের সূচনা রবীন্দ্রনাথের জাপান সফরেরও আগে, সেই ১৯১৫ সাল থেকেই। রবীন্দ্রনাথ পাতালরেল চড়েন নাই, চড়লে তাঁর লেখায় পাওয়া যেতো। অবশ্য সে সময়কার পাতাল রেল যাত্রী পরিবহনের জন্য ছিলো না। শুধু ডাক পরিবহনের কাজে ব্যবহার হতো। আর এই গিনজার রেলস্টেশন হয় আরো পরে, ১৯৩৪ সালে। পরবর্তীতে আরো দুই ধাপে তার কাজ হয় ১৯৫৭  আর ১৯৬৪ সালে। সুতরাং ১৯৬৪ সালের পরে যেহেতু বড় কোন সংস্কার করার সুযোগ হয়নি তাই এসকেলেটর বা এলিভেটর কোনটাই নাই। প্রায় ৬ তলার সমান মাটির তলায় যেতে হয় কতগুলো খাড়াখাড়া সিঁড়ি বেয়ে।একসময় নিচে এসে থামা হয়। এ আরেক বিশাল বাজার। মনেই হয় না যে মাটির এতো নিচে এখানে এতো আয়োজন।রেল লাইন দুই পাশেই। আমি একটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি, হলুদ দাগের পেছনে সারি দিয়ে একের পর এক এসে লাইনে দাঁড়িয়ে যে যার সেলফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে।ওরা কী এমন কিছু করে ফেইস বুকিং? চ্যাটিং? নাকি অন্য কিছু! বুঝার উপায় নাই। কিন্তু এমন কাউকে দেখা গেলো না যার হাতে ফোন আছে, অথচ সে ফোন ছাড়া অন্য কারো সাথে ভাব বিনিময় করছে।একটা কিয়স্কে টেপাটেপি করে জগলুল ভাই জানলেন যে আমরা যেখানে খাবো তার ভাড়া জনপ্রতি দু’শো ষোল ইয়েন। চারজন যাবো, সাড়ে আটশোর মতো পড়বে। বাংলাদেশী টাকায় ছয়শো টাকার মতো। খুবই সস্তা।ট্যাক্সি ভাড়া নিতো কাটায় কাটায় দশগুণ। এবার টিকেট কাটার পালা। জগলুল ভাই কমলাপুর রেলস্টেশন মনে করে কাউন্টারের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভেতরে বসা ইউনিফর্ম পরা লোকটার হাতে একটা এক হাজারি নোট ধরিয়ে দিতে গেলেন।ইউনিফর্ম পরা তরুণ চেয়ার থেকে উঠে একেবারে বাইরে চলে এলো। একটা মেশিন দেখিয়ে বললো, এখানেই টাকা দিয়ে যাও, টিকেট এসে যাবে। জগলুল ভাই হাজার রূপীর নোটটা ঢুকিয়ে দেন। কাজ হয় না।তরুণ আবার চলে আসে।

এবার মুদ্রাটি উল্টা দিকে দিয়ে ঢুকিয়ে দিলে- ক্রমা——- ১,২,৩, ও ৪ সংখ্যার ঠিক ঠিক করে চারটা টিকেট বেরিয়ে আসে। এবার ট্রেনে ওঠার জন্য আমরাও লাইনে দাঁড়াই।একটা জিনিস এই দুই দিনে লক্ষ্য করলাম যে, মানুষের চরিত্র আসলে তার পরিবেশদ্বারা সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়। চরিত্র বলিয়ে, পড়িয়ে যতটা না গঠন করানো যায়, দেখিয়ে এর চেয়ে বেশি। এই টোকিওতে এসে আমরা সবাই জাপানি রোবটের মতো নিয়ম মেনে হাঁটছি, চলছি, দাঁড়াচ্ছি, রাস্তাপার হচ্ছি। এমনকি টিকেট চেকারের ভয় না পেয়েও আমরা সুচারুরূপে কী করে টিকেট কেটে যাওয়া যায়, তাও দেখছি।ট্রেন এসে পড়ে। কতগুলো সাহায্যকারী পুলিশ আছে। যে কেউ চাইলে তারা ট্রেনে উঠাতে সাহায্য করে দেবে। একজন মহিলা —– হয় সাহায্য চেয়েছিলেন, তাকে হাতে ধরে ধরে উঠিয়ে দিলো এই পুলার।আমাদের ট্রেন চলতে থাকে। প্রতিদিন ঠিক কত মানুষ এই রেল স্টেশনে চলেন তার হিসাব জানি না। তবে এটুকু বোঝা গেছে, টোকিওর কিওর লোকেরা রাস্তার উপর দিয়ে যত চলে মাটির তলা দিয়ে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক চলে, এ ব্যাপারে সংশয় নাই।নেট খুঁজে পেলাম, ২০১১ সালের এক হিসাবে এই স্টেশনে গড়ে প্রতিদিন ২ লাখ ৪১ হাজার ৫শ ১৩ জন যাত্রী পারাপার করেছেন। ২০১৮ তে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। আজ নিশ্চয়ই ৩ লাখের বেশি লোক এই স্টেশন পার হয়েছেন।আমরা নেমে পড়ি। পরবর্তী গন্তব্য কোথায় হবে তা জানার জন্য আমি লাভলু ভাইর পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করি।

জাপানি ভাগ্যমন্দির

আমরা যে পথ দিয়ে হাঁটছি তার ডানে বামে শুধু খাবারের দোকান। নানা পদের খাবার। জাপানি খাবারের সাথে বিদেশী খাবার যেমন কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ড, এসবও আছে। বোঝা গেলো এ এলাকাটা একটা বড় ট্যুরিস্ট স্পটের কিছু একটা হবে।

সামনে তাকিয়ে দেখি জগলুল ভাই আর খোকন ভাই নাই। আমার সঙ্গ ছাড়েন না লাভলু ভাই, তাই তিনি আছেন। আমার ক্যামেরায় আমি তাঁর চলাচল ধরি, তিনি আমারটা।

আমি বলি- কোথায় এলাম?

তিনি বলেন- দরগা গেইট নামছি। সামনে শাহজালালের মাজার।

বলি, আমার কাছেও তাই মনে হচ্ছে। সিরনির পরিবর্তে আছে নানা পদের ভাজাভুজি। নাম জানি না এসব জাপানি খাবারের। ফুটপাতের উপর তাওয়ার উপর ভাজাভুজি হচ্ছে, লোকজন পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। অবশ্য দাঁড়িয়ে খাবার জায়গা আলাদা। হঠাৎ একটা সাইনবোর্ড দেখে থমকে যান লাভলু ভাই। বলেন, এই রেললাইনের সুসিটা আমি খাব।

মানে?

ঐ দেখ একটা ট্রেইলের উপর চক্রাকারে আসছে নানা রকমের ডিশ। রেল লাইনের উপর রাখা আছে নানা রকমের বাটি। তোর যেটা দরকার নিয়ে নিবি। দাঁড়া, দাম দেখে নেই।

এই বলে তিনি দাম দেখতে চলে যান।

এসে বলেন, না রে, হবে না। অনেক দাম। এক একটা বাটি ৬-৭শ, টাকা। তিন-চার বাটির নিচে তো হবে না। যাক গে, চল, সামনে যাই।

এখন বাজে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। এখনো খোলা আছে। সামনে আলো ঝলমলে কিছু দেখা যাচ্ছে। আমরা এগোই। টেরপাই, এটা একটা অন্যরকমের শপিং আর্কেডের ভেতর ঢুকে পড়েছি। একতলা দোকান। উপরে ভোল্টেড ছাদ। দিনের বেলা এলে ভালো করে দেখা যেতো। রাত বলে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটুকু মনে হচ্ছে যে, আদিকাল থেকেই এখানে একটা বড় বাজার ছিলো। সে বাজারটাকেই এখন গুছিয়ে রাখা। মজার ব্যাপার, একতলা দালানগুলো দেখে তার বয়স ঠাহর করা যাচ্ছে না। রাস্তায় কংক্রিটের স্ল্যাব বসানো। কোথাও কোথাও সুন্দর প্যাটার্নের পাথর।

এখানে যে সকল দোকান ছিলো তা কিছুক্ষণ আগে বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু খাবারের আর একটি মাত্র স্যুভেনির শপ ছাড়া সব দোকান বন্ধ। আমি একটা বন্ধ দোকানের সামনে বসে পড়ি। হাঁটাহাঁটি ভালো লাগছে না।

আসাকুসার এই বাজার এখন ভাঙা হাঁট। কেউ দিন শেষের কাজ গুছিয়ে এখন বাড়ি ফিরছে। দলবেঁধে কিছু তরুণ তরুণী আপন মনে আড্ডা দিতে দিতে হেঁটে যায়। আমি কারো সাথেই কথা বলতে পারি না। প্রথমত; আমি একজন বহিরাগত। বিদেশী পর্যটক। দ্বিতীয়ত: এখানকার মানুষদের ভাষা আমার অজানা। সুতরাং আমার কাছ একপক্ষীয় পর্যবেক্ষণ।

একসময় হাঁটতে শুরু করি একটা এক্সিস ধরে, যে এক্সিসের শেষ মাথায় খুব উজ্জ্বল একটা তোরণ দেখা যাচ্ছে। যেতে যেতে কতগুলো দোকানের দিকে চোখ গেলো। একি! মনোহারী দোকান বন্ধ করার পর দোকানীরা যে শাটার আটকে রেখেছে দোকানের তা যেনো এক দীর্ঘ ওয়ালপেইন্টিং । জানিনা, এই আইডিয়াটা কার মাথায় প্রথম এসেছিল। শুধু জানি যে, এই অঞ্চলটা পর্যটক ভিড়ে ঠাসাঠাসি করে। দিনের বেলা নানা রকমের জিনিস দেখে যাদের মন ভুলাবে রাতে হাঁটতে হাঁটতে কী দেখবে তারা! তাই সাটারগুলোর উপর এঁকে রেখেছে চিত্র। ডিজিট্যালি আঁকা এই চিত্রের কোনটাতে তাদের পুরনো ইতিহাসের ছবি, কোনটাতে নতুন কিছু। সুতরাং হাঁটতে হাঁটতে ডানে বামে যেদিকেই তাকানো হোক না কেন, এখানে দেখা যাবে যেনো প্রায় সিকি কিলোমিটার দীঘ এক ধারাবাহিক দেয়ালচিত্র। যেনো এক উন্মুক্ত প্রদর্শণশালা পেরুতে পেরুতে এসে পড়া গেলো এক চমৎকার তোরণের পাশে। বুঝলাম, দরগা গেইটের যে মোড়ে এসে নেমেছিলাম ঘণ্টা খানেক আগে, এখন দরগার সামনে এসে পড়েছি এই গেট দিয়ে ঢুকলে কী কী দেখা যবে, ধারণা করতে পারছি। দূরে একটা প্যাগোডার অবয়বও দাঁড়ানো আছে। এবার আমরা চারজন একসাথে প্রবেশ করি।

এটাকে বলে সেনসোজি মন্দির। প্রায় ১৪শ বছর আগে এক সময় এখানে একটা বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল। এর পাশেই টোকিওর সেই বড় নদীটা। এই নদীতে মাছ ধরতে যেয়ে একবার দুই জেলে ভাই একটা মূর্তির সন্ধ্যান পান। নিশ্চয়ই নদীতে গড়িয়ে গড়িয়ে উপরের কোন অঞ্চল থেকে এই মূর্তি এসে পড়ে এখানে। দুই ভাই মিলে পাড়ার সর্দারের কাছে এই মূর্তি এনে দেন। তিনি রেখেদেন তার বাড়িতে। এই মূর্তি দেখার জন্য, তাকে উপাসনার জন্য নানা জায়গা থেকে লোক আসতে শুরু হয়। মূলত; ওটাকে কেন্দ্র করেই সুমিদা নদীর তীরে এই আসাকুসা অঞ্চলেই গড়ে উঠে সেনসোজি মন্দির কমপ্লেক্স। এর মধ্যে বেশ ক’বার এর অবয়বে বদল ঘটে। আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়। আবার তাকে নতুন করে বানানো হয়। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এরপরে ১৯৬০ সালের দিকে অনেকটা নতুন রূপ দিয়ে একে বানানো হয়, সেই থেকে আছে। এখনো পর্যন্ত এ জায়গাটি টোকিওর সবচেয়ে বেশি পর্যটদের জনপদ। বাইরে প্রায় ৩ কোটি পর্যটক এখানে আসেন আর ১৪শ বছর ধরে গড়ে ওঠা এই বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনার নানা আলংকারিক রূপ দেখেন।

এর পাশেই আছে একটা মানত ঘর। আমাদের দরগাতে যেমন থাকে, অনেকটা সে রকমই। একটা জায়গায় মুদ্রা বা কয়েন ফেলার জায়গা রাখা আছে। সেখানে মানত করে, মানে কোনো আশা পুরনের কথা লিখে কাগজটি এ জায়গায় ফেলে দিলেই নাকি মানত পুরণ হয়ে থাকে।

খাস জাপানিরা যে যতই কারিগরি বিদ্যায় অনেক উপরে থাকুক না কেন, নানা রকমের সংস্কারে তারা বিশ্বাস যে করে এমন নজির পেয়েছি দীর্ঘদিন ধরে জাপানে থাকা আমাদের এক বুয়েট প্রকৌশলী আশির আহমেদের লেখায়। জাপান কাহিনির গোটা পাঁচেক বই আছে তাঁর। জাপানি নানা বিষয়ের খুটিনাটি তথ্যবহুল আর রসালো বিশ্লেষনে ভরা। জাপানিদের এই গণকবৃত্তি নিয়ে লিখেছে যে। সেখানে বলা আছে যে ভাগ্য গণনা তে জাপানিরা ব্যয় করে বছরে ১০০ হাজার কোটি ইয়েন। বাংলা টাকায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। তারা যে সকল পদ্ধতি অবলম্বন করে তা হচ্ছে ঃ

                (১) ওঝা পদ্ধতি-  প্লানচ্যাট করে এক জ্বিন-ভুত শরীরে নিয়ে আসবে। তখন আপনি যা প্রশ্ন করবেন সে তার উত্তর দেবে।
                (২) হাতের লেখা পদ্ধতি- আপনাকে কিছু একটা লিখতে দেবে, না হয় আঁকতে দেবে। আপনি কি রঙ ব্যবহার করলেন, কি আঁকলেন – এইসব দেখে আপনার চরিত্র বিশ্লেষণ আর ভবিষ্যৎ বলে দেবে।
                (৩) চাহনি দেখা পদ্ধতি- আপনার কথা বলার ঢঙ, চোখের পাতা কত বেগে ফেলছেন এসব দেখে আপনার ইতিহাস ভবিষ্যৎ সব বলে দেবে।

                (৪) বেতের বাড়ি পদ্ধতি- আপনি হাত পাতবেন। বাড়ি খাবেন। আপনার রি-আকশন দেখে বলে দেবেন সব। কেউ কেউ চড় থাপ্পড় ও দেন।
                ৫) লটারি পদ্ধতি- বড় বড় যত মন্দির দেখবেন, এসব মন্দিরে এক ধরণের লটারি থাকে। ১০০ ইয়েন দিয়ে যে কোন একটা কাগজ ওঠাবেন। কাগজে আপনার ভাগ্য লেখা থাকবে। এর নাম ওমিকুজি।
                বুঝলাম এই ওমিকুজির বাক্স হচ্ছে এটা। নিশ্চয়ই এর পেছনে অনেক শক্তিশালী কেউ আছে যে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে।
            আমাদের দেশে ইসলাম ধর্ম এসেছে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের হাত ধরে। তাহলে কি আমাদের মাজার, মানত, টাকা পয়সা দেয়া, ছিটানো, এমন কিছু কি তবে অনেক আগে থেকেই ছিলো?

নেপালের পোখরাতে হিন্দু মন্দিরের পাশের এক কুয়াতে রেখে দেয়া ছিল এক বালতি। বালতিটি দেখা যায়। উপর থেকে ৫-১০ রূপীর সিকি ইচ্ছেমতো ফেলতে থাকে মানুষ যতক্ষণ না পর্যন্ত পানির প্রতিসারিত অবয়বকে ফাঁকি দিয়ে ঐ বালতির মধ্যে মুদ্রাটি পড়ে। সেখানে পড়লেই নাকি ‘মনোষ্কামনা’ পূর্ণ হবেই। হিন্দু ধর্মের সেখানে যা দেখেছিলাম বৌদ্ধ ধর্মের এখানেও তাই দেখলাম, আর আমাদের নানা রকমের মাজারের মানতের কত কিছুই দেখেছি।

 যেখানে ধর্ম আছে, সেখানে ধর্ম নিয়ে নানা রকমের বাণিজ্যিক উপকরণও খুব সহজে তৈরী হয়ে যায়। এই মন্দিরেও তার অনেক কিছু দেখা গেলো। তবে বিশ্বাসের উপর ভরসা করে মানুষ তার প্রভুর কল্পিত নানা প্রতিরূপের কাছে নানাভাবে নানা স্থানে, নানা রকমে সমর্পিত হয়। কেউ কিছু পায়, কেউ আগামীতে পাবার আশায় ফেরত যায়।

প্রথম দিনের সেমিনার

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯। এশিয় স্থপতি সম্মেলনের দুদিনের সেমিনারের প্রথমদিন আজ। বলতে গেলে আজ উদ্বোধন, সইে মিজি বিশ^বিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে। এ ধরনের একটা আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান, সেখানে এশিয়ার ২১টি দেশের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বকারীরা উপস্থিত, তার আয়োজনের অবস্থা দেখে উৎসবপ্রিয় এই বাংলাদেশী স্থপতিদের খুব মন খারাপ। বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুটো লম্বা ব্যানার, ছোট ছোট দু’তিনটা প্ল্যাকার্ড, এছাড়া প্রচারণার আর কিছু নাই। এবং মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে, এই পুরো আয়োজনের জন্য কোন স্পন্সর কোম্পানি নাই, নাই কোনো প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন বা কোন প্রডাক্টের সৌজন্যে কোন অনুষ্ঠানও।

জাপানিদের এই পরিমিতি দেখে টাশকি খাওয়ার মতো অবস্থা। স্থপতিরা নির্মাতাদের সুপারিশ করেন এমন জাপানি ফিটিংস আর ফিক্চারে বাংলাদেশ বা এশিয়াতো আছেই পুরো বিশ^ই জাপানি জিনিসের কদর করে এবং সেনিটারি, ইলেকট্রিক্যাল ফিটিংস বা ফিক্চার-এর জাপানি কোন কোম্পানি এখানে হাজার হাজার ডলারের কর্পোরেট স্পন্সর করবে না?

কিন্তু করতে দেয়া হয়নি। বোঝা গেলো। নিজের অনুষ্ঠানের আয়োজনের সব খরচ নিজেরই বহন করবে বলে সেই হিসেবে রেজিষ্ট্রেশন ফী টাই নিয়েছে। এই ফী’র মধ্যে উল্লেখ আছে ক’বেলা কী কী খাবার এতে ফ্রী আছে, বাদবাকী খাবারের এমন কি মিটিং চলার খাবারের জন্য যারা আলাদা মিটিং করবে তার টাকাটাও তাদের দিতে হচ্ছে।

আপাত: মনে হচ্ছে খুবই ছোটলোকি কারবার করলো জাপান। কারণ এর আগে আমরা বা ভারতের কোন শহরে যখন এ ধরনের কনফারেন্সে গিয়েছি নানা পড়ের স্পন্সরের দেয়া মাগনা খানা-পিনা আর উপহারের সামগ্রি পেতে পেতে যেখানে লিপসা বেড়ে গিয়েছিল, সেখানে জাপানে এসে খানিকটা স্তম্ভিত। এখানে বেøাশিয়ারের মধ্যে এক জায়গায় কতগুলো কোম্পানির নাম শুধু দেয়া। লেখা-পার্টনার ব্যাস। এটুকুই।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান একেবারেই সাদামাটা। না কোনো টেলিভিশন ক্যামেরা, না কোনো পত্রিকার সাংবাদিক না কোন্ োমন্ত্রী বা মেয়র। কাউরে পোছার টাইম নাই তাদের।

১৯৭০ সালে এই আর্কিটেকটস রিজিওনাল কাউন্সিল এশিয়া, বা সংক্ষেপে আর্কেশিয়া নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল যাতে এশিয়া দেশের স্থপতিদের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে একে অপরকে পৃষ্টপোষকতা ও প্রণোদনা দিতে পারে। ১৯৭৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে এসে এশিয়ার ২১টি দেশ এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছে। এদেরকে এ,বি ও সি এই তিন জোনে ভাগ করে রাখা। জোন- এতে আছে বাংলাদেশ, ভ‚টান, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা।

সাদামাটা সেমিনার হল

জোন বি তে আছে ব্রæনেই, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালে মিয়ানমার, ফিলিপিন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড আর ভিয়েতনাম।সবশেষে জোন সি তে রাখা হয়েছে চীন, হংকং, কোরিয়া, ক্যাকাও, মঙ্গোলিয়া আর জাপানকে।এই এশিয় স্থপতিদের ১৮তম সমাবেশ ঘটানোর জন্য আপ্যায়ন মনোনীত হয়েছিল জাপান সেই আসর বসেছে আজ। চলবে আগামীকালও। আসরের থিম হিসেবে বেছে নিয়েছে দুটো শব্দ। Simplicity, Multiplicity ব্যস। এই নিয়ে কথা হবে। বাঘা বাঘা স্থপতিরা কথা বলবেন।

বাঘাবাঘা তিনজন মূল বক্তা আছেন তিনটা সেশনে। শুরুতে মূল প্রবন্ধ পড়বেন কাই-উই বার্গমেন, এরপর জাপানের প্রবীনতম মাস্টার আর্কিটেক্ট ফুমিহিকো মাকি আর পরদিন ইয়াসমিন লারি।

আর্কেশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের সর্দার জাহাঙ্গির খান, জাপান স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট মাসাহুরা রকুশিকা আর মিজি বিশ^বিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট কেলিচিরো সুচিয়াÑ এই তিনজন মাত্র বক্তার কথামালা শেষ হলেই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়ে যায়। কী সাধারণ, কী গোছানো আর পরিমিত আয়োজন।

আমরা অপেক্ষা করতে থাকি মাকির কথা শুনবো বলে। জাপানি স্থপতিরা বিশ^কাঁপিয়েছেন। এঁদের মদ্যে বেঁচে থাকা সবচেয়ে পুরনো স্থপতি এই ফুমিহিকো মাকি। গত ৬ সেপ্টেম্বর নব্বুইতম জন্মদিন পালন হলো তার। জাপানি মাস্টার আর্কিটেক কেন জো তাংগে ছিলেন তাঁর সিনিয়র। মাকির চেয়ে ১৫ বছরের বড় এই স্থপতিই মূলত; বৈশি^ক স্থাপত্যধারাকে জাপানি ঐতিহ্যিক স্থাপত্যের সাথে মিশিয়ে এক আধুনিক স্থাপত্যভাষার জন্ম দিয়েছিলেন জাপানে। ওসাকার এই স্থপতির কিছু কাজ আমারা দেখবো ওসাকায় গেলে। তাঁর বিখ্যাত কাজ হচ্ছে হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্ক, টোকিও অলিম্পিক এরিনা, সেন্টমার্টিন গীর্জা এসব।

স্থাপত্যে নোবেল পুরস্কার হিসেবে গণ্য প্রিতকজার পুরস্কার পেয়েছিলেন কেনজো তাংগি ১৯৮৭ সালে। ১৯৭৯ সালে চালু হওয়া এই পুরস্কারের প্রথম পদক পেয়েছিলেন মাস্টার আর্কিটেক্ট ফিলিপ জনসন। ২০১৮ সালে ভারত উপমহাদেশে প্রথম আসে এ পুরস্কার, পেয়েছিলেন বলকৃষ্ণ দোশি। জাপানে ৭ জন এ পর্যন্ত পেয়েছেন। জেনজোর পরেই এ পরুস্কার এসেছিল মাকির হাতে। তার দু’বছর পর আরেক বিষ্ময়কর স্থপতি তাদাও আনন্দো পেলেন ১৯৯৫ সালে। তাদাও আনন্দোও ওসাকাবাসী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই স্থপতিগুরু হয়ে বসে আছেন বক্সার তাদাও। তাঁরও বেশ কিছু কাজ আছে ওসাকাতে। ওসাকাতে গিয়ে দেখা হবে সে সব। সেমিনার শুরু হয়। মাকি ধীর গলায় বিশুদ্ধ ইংরেজীতে তাঁর কাজগুলো দেখান। হার্ভার্ডের ডিগ্রী থাকার কারণে তাঁর উচ্চারণে জাপানি ইংলিশ নাই। কিন্তু বয়সের ছাপ এসে গেছে। জাপান ছাড়াও আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, সিঙ্গাপুরে বড় বড় কাজ আছে মাকির। সে সব দেখানো শেষ হলো ৪০ মিনিটের বক্তাতয় এক সময় শেষ হয় সেশন। আমরা বাইরে বেরিয়ে আসি। আমি আমার অজমো মোবাইলের ডিসপ্লেতে চোখ রাখতে রাখতে হেঁটে হেঁটে বেরিয়ে আসি রাস্তা পর্যন্ত। লাভলু ভাই হঠাৎ ডাক দেন আমাকে।

দ্যাখ, দ্যাখ মাকি দাঁড়িয়ে আছে।

আমি তাকাই।

নব্বুই বছরের মাস্টার আর্কিটেক্ট বক্তৃতা শেষ করে বেরিয়ে এসেছেন, একা। না তার কোন সহকারী সঙ্গি, না আয়োজকদের কেউ আছে তার সঙ্গে। তাঁর হাতে একটা ছোট ফাইল কেবিনেট। তিনি সিগনাল পোস্টে বোতাম টিপে দাঁড়িয়ে আছেন। সবুজ বাতি জ¦ললে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হয়ে ওপাড়ে যাবেন। তারপর ট্রেন ধরে কি বাড়ি যাবেন? না অফিসে?

আর জানা গেলো না।

জাপানিরা তাহলে এমনই! যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের কাজটা করতে পারবে, ততক্ষণ তার কারো সাহায্য নেবে না। আর আগ বাড়িয়ে খেদমত করার মোগলী কানুন তারাও বোধ হয় শেখেনি, সে কারণেই অনেকক্ষেত্রে, অনেক কিছুই আমাদের বুঝে উঠতে দেরি হচ্ছে, এই রোবটের শহর টোকিওতে। একদিন নিজের মতো

একাকী এক দিন

আজ আমাদের ফুজি মাউন্টেনে যাবার কথা। কাল বুকিং দেয়া হয়েছে। ১২০ ডলার করে জনপ্রতি টিকেট। হোটেল থেকে গাইডেড বাসে করে নিয়ে যাবে। ফুজি মাউন্টেনের রূপ দেকাবে। পথে দুবেলা নাস্তা আর দুপুরের বুফে লাঞ্চও খাওয়াবে এবং সন্ধ্রা নাগাত আবার হোটেলে পৌঁছে দেবে। এজন্য সকালের বাসে উঠতে হবে সকাল ৮টায়। ৮ টায় বাসে ওঠা মানে ৭ টায় উঠে গিয়ে একবারে সাড়ে ৭ টায় নাস্তা খেতে চলে যাওয়াও। এমনটা আমদের দলের বাকী ৭জনই করলো আমি ছাড়া। ভোর রাত সাড়ে তিনটায় ঘুমানোর পর সাড়ে ছ’টা থেকে যখন এলার্ম বাঁজা শুরু হলো আমি ফোনটা উঠিয়ে আবার রেখে দেই। আমার রুমমেট আরিফ ভাই। তাঁকে বলি, ভোর সাড়ে তিনটায় আমি ঘুম থেকে উঠতে পারবো না। আপনার যান।

সাড়ে তিনটা কেন? এখনতো সাড়ে ছয়টা।

আমি বলি- সাড়ে ছ’টা জাপানে। আমার শরীরে ঢাকার টাইম রয়ে গেছে। সে বলছে, এখন ভোর হবে কিছুক্ষণ পর। আমাকে ঘুমাতে বলছে। আমি ঘুমাই আপনারা ফুজি মাউন্টেনের সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে নিয়ে আসেন। রাতে ছবি দেখবো।

তোর নামে কিন্তু বুকিং দেয়া।

জানি তো।

আমার ক্রেডিট কার্ড থেকে কিন্তু বুকিং হয়েছে।

তো?

না গেলেও কিন্তু টাকা যাবে। দেখ। উঠে পড় কফি দেবো?

না। যান আপনারা। টাকা কাটলে কাটুক। নিশ্চয়ই টাকার চেয়ে ঘুম উত্তম। আমি ঘুমালাম। আপনারা যান।

(আর লেখা হয় নাই। লিখলে দিব) 

 

মন্তব্য
Loading...