প্রথম বিলেত

২০০১ সালে আমেরিকা থেকে ফেরার পথে কয়েক ঘন্টা লন্ডন সফরের স্মৃতিকথা

ট্রানজিট কাহিনী

২০০১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি।

হিথরোতে নেমে ফোন করতে হবে। আমাার কাছে কোনো পাউন্ড নেই। টেলিফোনের গায়ে লেখা ৩ মিনিট পর্যন্ত কথা বলতে ৩৫ পেনি ঢালতে হবে। এখন ৩৫ পেনি পাই কিভাবে ?

আমার কাছে মার্কিনী ডলার আছে। তা ভাঙানোর জন্য ডিউটি ফ্রির বিক্রেতাকে অনুরোধ করি। মাঝ বয়েসি এই মহিলা মুখের উপর না করে দেন। তিনি খুচরা দিতে পারবেন না, তবে কিছু কিনলে বাকী টাকা কয়েনেই দিবেন।

আমি দোকানের দিকে তাকাই। সবচেয়ে সস্তার যে জিনিসটা চোখে পড়লো তা ছিলো আড়াই টাকা দামের এক প্যাকেট চকলেট। আমি এটা হাতে নিয়ে তাঁকে ১০ ডলারের নোট দেই। তিনি একটা ক্যাশ কাউন্টার আমাকে দেখিয়ে সেখানে টাকা দিতে বলেন।

ক্যাশ কাউন্টারে সিরিয়াল। আমার সিরিয়াল এলে আমি চকলেটের প্যাকেট আর ১০ ডলারি নোট ধরিয়ে দিলাম। তিনি কতগুলো খুচরো আমার আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি ৫০ পেনির একটা মুদ্রা ঢুকিয়েই ফোন করলাম কুসুম খালাকে। তাঁকে যে আমি ফোন করবো এয়ারপোর্টের কয়েন বক্স থেকে এমন কথা কাল নিউ ইওর্ক থেকে ফোন করে পাকা করে এসেছি। একটা রিং বাজতেই কুসুম খালাকে পাওয়া গেলো। মনে হলো, তিনি ফোনের পাশেই ছিলেন। তাঁর কন্ঠে অস্থিরতা- ‘তোমার নাম্বার খও, আমি ঘুরাইয়ার।’

‘নাম্বার কিলা দিতাম, আমি তো কয়েন বক্স তাকি ফোন করছি।’

‘কয়েন বক্সের গায়ে নম্বর আছে, ওটা খও, শুয়েব তোমার লাগি হিথরো আছে । কয়েকবার ফোন করেছে।’

শুয়েব আমার অতি প্রিয় বন্ধু। প্রথম শৈশবের প্রথম প্রিয়জন। এক ক্লাসে পড়তাম, এক সাথে স্কুলে যেতাম আবার দিক ঘুরিয়ে বেশি সময় হাঁটবো বলে এক সাথে বাড়ি ফিরতাম। যেদিন স্কুল বন্ধ থাকতো সেদিন আমাদের মন খারাপ হয়ে যেতো। আমরা একজন অপরজনের বাড়ি চলে যেতাম। আমি গিয়ে দেখি ও বাড়ি নাই। বাড়িতে ফেরত এসে শুনি- শুয়েব আমাকে খুঁজে গেছে। আবার ওর বাড়ি যাবো, দেখি রাস্তার পাশে বেড়ার উপর হেলান দিয়ে সে দাঁড়িয়ে।

১৯৭৬ সালে আমি (সামনে বায়ে) আর শুয়েব (সামনে সর্বডানে)

তিন বছর এক সাথে পড়ার পর ১৯৭৮ সালে আমি চলে যাই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, ওকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ওর নানার বাড়ি গোবিন্দশ্রী গ্রামে, সেখানে এক স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়। ৪/৫ মাস থাকে সেখানে। গোবিন্দশ্রী আমাদের থেকে মাইল দুই দূরের সেই গ্রাম। আমাদের দেখা-সাক্ষাত বন্ধ, আমাদের যোগাযোগ হয় চিঠিতে। তার হাতের লেখা ছিলো সুন্দর। গোল গোল বড় বড় হরফে খুব সুন্দর করে লিখতো। কাগজের কোনায় নিজের হাতে গোলাপ ফুলের ছবি আঁকত। সে আমাকে কবিতা লিখে পাঠাতো। ওর আদর্শ ছিলো কবি নজরুল। অনেক দিন তার কোন চিঠি পাই না, একদিন শুনি সে আর নানার বাড়ি নাই। এসে গেছে নিজের গ্রামে। তাকে ভর্তি করানো হয়েছে আমাদের গ্রামের মাদ্রাসা। কিন্তু ততোদিনে আমি গ্রাম ছাড়া। প্রথম ছুটিতে এসে শুনি শুয়েব লা-পাত্তা। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না । যখন পাওয়া গেলো সে আরেক কাহিনী ।

একবার আমির উদ্দিনের গানের দল কোথাও পালা গাইতে গিয়েছে, সেখানে সানগ্লাস পরা এক কিশোরকে দেখে গ্রামে খবর দেয়া হয়। বড় চশমা দিয়েও তার মুখ ঢাকা যায় নি, সে ধরা পড়ে যায়। অনেক কাহিনী করে তাকে ফেরত আনা হয় বাড়িতে।

এর মধ্যে আরো দিন যায়। আমি ক্যাডেট কলেজ থেকে বাড়ি এসে তার খোঁজ নেই। শুনি শুয়েবরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে সিলেট শহরে। সুবিদবাজারে বাসা বানিয়েছেন তাঁর বাবা। কিন্তু সেই বাসায় সে থাকে না, ওখানে নতুন দালান বানানোর কাজ শুরু হয়েছে, তাই ২/৩ মাসের জন্য লামাবাজার মীর্জা জাঙ্গাল মামার সাথে এক বাসা ভাড়া করে থাকে। সামনে তার মেট্রিক পরীক্ষা । এ জন্য বাশঝাড় ঘেরা একটা বাসায় সে থাকে। প্রাইভেট পড়ে আর পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়।

আমি ক্যাডেট কলেজ থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে সিলেট নেমে যাই। তার সাথে আমার দেখা হয় এক সন্ধ্যায়। সামনেই মেট্রিক পরীক্ষা। পড়াশুনা নিয়ে সে ব্যস্ত। এর মধ্যে বলে বসলো- ঢাকা থেকে বৃটিশ হাইকমিশন চিঠি দিয়েছে, ইন্টারভিউর ডেট পেয়েছে। পরীক্ষার পরপর ভিসা নিতে যাবে। তাঁর বাবা আমাদের গ্রামের পুরনো লন্ডনীদের একজন। আমার বাবার বিশেষ বন্ধুও।

শুয়েবের সাথে এর পর আমার আরেকদিন দেখা হয়েছিল। তার একটা নতুন গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলো । কিন্তু আমাদের কারোই জানা ছিলো না যে সে এখনো গাড়ি চালানো ভালোভাবে শিখে নাই। খোলা সড়কে গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে এক নিরপরাধ রিকশার চাকা ফাটিয়ে দে। আমরা সবাই মিলে সেই রিকশাওয়ালার একটা নতুন চাক্কার দাম দিয়ে রেহাই পেয়ে বাড়ি ফেরত এসেছিলাম। এই ছিলো দেশে তার সাথে আমাদের শেষ সাক্ষাৎ।

১৯৮১ সালে পরিবারের সাথে সে চলে আসে লন্ডন। তার সাথে আমার আর দেখা হয় না। কুড়ি বছর পর আজ আমার সাথে তার দেখা হবে, এমন উত্তেজনায় অনেকটা কাঁপছি যখন, তখন আমি যে বুথের সামনে দাঁড়িয়ে, সেখানেই টেলিফোনে রিং বাজে।

এটা পাবলিক বুথ। আমি কী করবো বুঝতে পারি না। পাশের দোকানের এক বিক্রেতা আমার দিকে চেয়ে বলে এটা তোমার ফোন হতে পারে।

আমি সাহস করে রিসিভার উঠাই । ওপাশে সেই পরিচিত সুরে এক অপরিচিত স্বর। শুয়েবের কন্ঠ। সে যা বললো তার সারাংশ এই যে, তার ধারনা ছিলো বৃটিশ পাসপোর্ট দেখিয়ে যে ভেতরে  আসতে পারবে, কিন্ত  তাকে ভেতরে আসতে দিচ্ছে না, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ।

এখন কী করি ?

নিউ ইয়র্ক থেকে ফোনে আমাদের সাক্ষাতের যে পরিকল্পনা করে এসেছিলাম, এ দেখি ভেস্তে যেতে বসেছে। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স এর বিমান নামার কথা ৯:৪৫-এ, ঠিক সময়ে নেমেছেও। আমার পরবর্তী ফ্লাইট ১:৪৫-এ, এমিরেটস্ দিয়ে দুবাই নামবো। মোস্তফা রাত ১২ টায় দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে নিয়ে যাবে। হিথরোতে আমার হাতে সময় থাকবে ৪ ঘণ্টা। এর মধ্যে ট্রানজিট লাউঞ্জে সুয়েব আসবে। আমরা পরস্পরকে দেখবো, কথা বলবো আর দুইজন এক ফ্রেমে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবো।

কুড়ি বছর পর দেখা বাল্যবন্ধু শুয়েবের সাথে

শুয়েবের কণ্ঠে হতাশা। সে একাও আসে নাই। বর্নমাউথ থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছে তার এক বন্ধুকে যে লন্ডন শহর ভালো চেনে। তাছাড়া বৃটিশ আইনকানুনও তার বেশ জানা। এয়ারপোর্ট, ইমিগ্রেশন তার কাছে কোনো ব্যাপার না। শুয়েব সেই যে এসেছিল ১৯৮১ সালে, আর কখনো এই হিথরো দিয়ে কোথাও বেরোয় নি, এমনকি দেশেও যায় নি। এ কারনে সাহায্যকারি বন্ধুকে নিয়ে আসা।

কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তৃতীয়বার ফোন করে শুয়েব জানালো কেবলমাত্র নতুন টিকেট কেটেই ভেতরে যাওয়া যাবে, আর কোনোভাবে নয়। হিথরোর নিয়ম কানুন এখন কড়া করে ফেলেছে।

ঠিক হলো, গেট পর্যন্ত সে এসে দাঁড়াবে। আমি ওখানে গিয়ে কাচের দরোজার বাইরে থেকে তাকে দেখবো। সে থাকবে কাচের দেয়ালের ওপাশে, আমি থাকবো এ পাশে। আমরা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলবো। কেউ কারো কথা শুনবো না, কিন্তু দেখতে তো পারবো ?

এ অবস্থায় আমি অসহায়ের মতো বাইরের কাচের দেয়াল দেয়া গেটের অন্বেষণ করতে গিয়ে ইউনিফর্ম পরা এক ইংরেজকে আমার সমস্যার কথা বললাম।

তিনি সম্ভবত কোন নিরাপত্তা কর্মকর্তা। জবাব দেবার আগে তিনি আমার পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস দেখতে চাইলেন। দেখা শেষ করে মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন ‘দুঃখিত, তোমার বন্ধু কোনভাবেই ভেতের আসতে পারবে না। তবে তুমি যদি ভিসা নিয়ে বেরুতে পারো, তবেই দেখা করতে পারো।’ এই বলে তিনি আমার হাতে আমার পাসপোর্টের পোটলা ফেরত দিয়ে হাঁটা শুরু করেন।

আমি তাকে যেতে দেই না। পেছন থেকে দ্রুত হেঁটে, আবার তাঁর সামনে গিয়ে দাড়াই। বলি ‘ভিসা কোথা থেকে নিতে হয়?

ইউনিফরম পরা লোকটি কিন্তু মোটেই বিরক্ত হলেন বলে মনে হলো না। আবার তিনি হাসলেন এবং একটা গেটের নাম বলে আঙ্গুল উঁচিয়ে সেই গেটে গিয়ে খোঁজ নিতে বলে নিজের মতো হাঁটতে শুরু করেন ।

বিলেতের মাটিতে এই আমার দ্বিতীয় স্পর্শ।  ৫ সপ্তাহ আগে আমেরিকা যাবার পথে ৪/৫ ঘন্টার ট্রাঞ্জিট ছিলো গেটউইক বিমান বন্দরে। সেখানে আমি বেশ আরামে বিশ্রাম করেছি, গোসল করেছি, লম্বা সোফায় আধশোয়া হয়ে ছোট্ট তন্দ্রা নিয়েছি। প্লেনে ওঠার আগে এক মহিলা আমাকে কিছু প্রশ্ন করেছেন, তাঁর ইংরেজি ভালো বুঝি নাই। তিনি এর পরে আস্তে আস্তে ভাঙা ভাঙ্গা ইংরেজিতে আমাকে বুঝিয়ে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলেন , যে স্যুটকেস আমি নিয়ে যাচ্ছি তা কি আমি নিজে প্যাক করেছি, না অন্য কেউ ?

এই সহজ প্রশ্নটি আমার বুঝতে কষ্ট হয়েছিল সেদিন। কিন্ত এই পুলিশের কথা আমি ভালো ভাবেই বুঝলাম।

এমনিতে বৃটিশ পুলিশের সুনাম শুনেছি আমার নানীর কাছে । তিনি বলতেন- এরা যুদি খালি কলেমাটা ফটিলিতো তে হখলটি বেহেস্ত যাইত। ইংলিশ ফুলিশর লাখান ইমানদার মানুষ দুনিয়াত নাই।

আমি এই ইমানদারের কথার উপর ভরসা করে শুয়েবকে ফোনে জানাই, আমি ভিসার জন্য চেষ্ঠা করছি, কী হয় জানাবো।

এই বলে ‘পাসপোর্ট এন্ড ইমিগ্রেশন’ লেখা কাউন্টার বরাবর প্রায় ১০ মিনিট হেঁটে গিয়ে যেখানে হাজির হলাম দেখি সেই কাউন্টার একেবারেই ফাঁকা। সেখানেও শুরুতে ইউনিফর্ম পরা এক লোক। তাঁকে বলি, মহাশয়- ট্রানজিট ভিসা কোথা থেকে নিতে হয়, তা কি আমাকে দয়া করে জানাবে ?

এই পুলিশও সদয়। খুব স্বাভাবিক অবয়বে কোনার দিকের একটি বুথ দেখিয়ে আমাকে সেখানে যেতে বলা হয় ।

কোনায় যে মহিলা বসে আছেন তার মাথার উপরে যে ট্যাগ লাগানো, তাতে লিখা ‘ইমিগ্রেশন’। আমি তার কাছে গিয়ে আমার পাসপোর্ট, দুবাইর টিকেট এবং বোডিং কার্ড মেলে ধরি। যতটুকু গুছিয়ে পারি আমার মতো করে শুদ্ধ ইংরেজিতে বলি- মহাশয়া, আমি একজন বাংলাদেশি আর্কিটেক্ট, ৫ সপ্তাহ আগে আমি আমেরিকা গিয়েছিলাম আমার পেশার কাজে, আমি এখন নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরছি,  দুবাই হয়ে আমার দেশ বাংলাদেশে ফেরত যাব। আমার হাতে আড়াই ঘণ্টা সময় আছে, আমার এক বন্ধু এই হিথরো বিমানবন্দরে বাইরে গেটে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তার সাথে গত ২০বছর আমার দেখা হয় নাই। সে আমার ছোটবেলার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল । তুমি কি তার সাথে দেখা করার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারো?

ভদ্রমহিলা আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলেন, তোমার ভিসা আছে?

‘নাই’ আমার সহজ উত্তর।

তিনি একপাতার একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলেন – ‘ অনুগ্রহ করে এই ফর্মটা পুরণ করো।’

আমি দেখলাম, এখানে মাত্র ৪/৫টা তথ্য আমাকে দিতে হচ্ছে। নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট, ফ্লাইট নাম্বার, এসব। আর লন্ডনের একটা ঠিকানা।

আমি তাঁর ডেস্কের দাঁড়িয়েই ফর্ম ফিলাপ করি। ঠিকানা মুখস্ত, নানার ঘর, ফরটি ত্রি নর্টন হাউজ, লন্ডন এ ১, ও এল বি। এক মিনিটে ফর্ম ফিলাপ করে তাঁর হাতে দেই, তিনি আরো এক মিনিটের কম সময়ে এই ফর্ম দেখে কম্পিউটারে কিছু একটা লিখে আমার পাসপোর্টে একটা সিল মেরে মিস্টি হাসি দিয়ে ফেরত দিলেন।

দেখি আমার পাসপোর্টের উপর একটা ট্রানজিট ভিসা, ওখানে মেয়াদ লেখা আছে ২৪ ঘণ্টা। আমার হাতে পাসপোর্ট দিতে দিতে ভদ্রমহিলা বলেন ‘তোমার সময় সুন্দরভাবে কাটুক। কিন্তু আমি মনে করি এ সময়ের ভিতর যদি তুমি শহরে যাও তবে ট্রাফিকজামে আটকা পড়তে পারো, তোমার হাতে কিন্তু বেশি সময় নাই।

আমি তাঁকে অভয় দিলাম।

তিনি আমাকে বলতে থাকেন, এয়ারপোর্টের কাছাকাছি অনেকগুলো ভালো কফিশপ আছে। তুমি বরং সেখানে তোমার বন্ধুর সাথে সময় কাটাও।

তাঁকে পুরর্বার ধন্যবাদ জানিয়ে এসকেলেটর দিয়ে নিচে নামতেই দেখি শুয়েব দাঁড়িয়ে।

এর আগে ওর ছবিতে দেখেছি নজরুলের মতো কাধ পর্যন্ত বাবরি চুল। সে রকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখি ছোট চুল। চেহারাও দেখি কুড়ি বছরে এক ইঞ্চি বদলালো না। আগে যা ছিলো তাই। তারচেয়ে আমার মনে হলো আমারই শরীরের পরিবর্তন হয়েছে। সময় কাউকে কাউকে ছাড় দেয়। আমাকে দেয়নি, ওকে দিয়েছে।

শুয়েব আমাকে বলে- এখন বাজে সাড়ে ১০টা তোর ফ্লাইট তো ১ টা ৪৫। কিন্তু ভিসা দিয়েছে ২৪ ঘন্টার। এখন কী করি ?

বোর্ডে দেখেছি এমিরেটস-এর শেষ ফ্লাইট রাত ১০টা ২০ মিনিটে। আমার ফ্লাইটটা যদি ১ টা ৪৫ এর জায়গায় ১০টা ২০-এ করতে পারি তবে মন্দ হয় না। এই লন্ডন শহর নিয়ে কত গল্প শুনেছি ছোটবেলায়। এতো কাছে এসে গিয়ে শহরটা দেখবো না, নানার বাড়ির মামা-মামীদের দেখবো না, এই কী হয় !

গেলাম এমিরেটস এর কাউন্টারে।

এক মিশরি চেহারার ছোকরা মুখের উপর বলে দিল, হবে না।

‘কেনো?’

ওর জবাব ‘যে ফ্লাইটে প্যাসেঞ্জার যাবে, সে ফ্লাইটেই তার মালামাল যাবে, এটাই নিয়ম। নিউইয়র্ক থেকে তোমার যে দু’টো স্যুটকেস এসেছে ইউনাইটেড এয়ার লাইন্স-এ ওগুলো এখন তোমার ফ্লাইটের জন্য ট্যাগ করা আছে, এ কারণে হবে না।’

আমি এর আগে ইংরেজদের সাথে মুলামুলি করে এ পর্যন্ত চলে এসেছি। এই আরবকে কি পারবো না ?

আমার গলায় ইংরেজি আরো মোলায়েম হয়ে এলো। একটু ভারি গলা নিয়ে বলি – শোন ভদ্রলোক,  আমি কি তোমার স্টেশন ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে পারি ?

এই ধমকে কাজ হয়ে যায়। সে একটা অয়ারলেসে ফোনে আরবিতে কথা বলে আমাকে জানায়-  এক মিনিট, তিনি আসছেন।

এবং আবার ম্যানেজারের কাছে অতীব নরম স্বরে আমার মনোবাসনার কথা উপস্থাপন করি। তিনি আমার সব কাগজপথ (পাসপোর্ট, ভিসা, টিকেট, বোর্ডিং পাস ) উলটে পালটে দেখেন এবং একসময় আমার মতো মোলায়েম কন্ঠে বলেন –

‘ আমি চেস্টা করে দেখি তোমার জন্য কী করা যায়’।  এই বলে তিনি আমার বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে কম্পিউটার গুতাতে লাগলেন। এর মধ্যে তিনি বলতে থাকেন- এটা নির্ভর করছে দু’টো জিনিসের উপর। এক- ১০টা ২০-এর ফ্লাইটে তোমার জন্য খালি আসন থাকবে কী না, আর তোমার লাগেজ দু’টো যদি এখনও প্লেনের ভিতর ভরা না হয়ে থাকে। আমি এই দুটো জিনিস চেক করছি।

এবং মিনিট দুইয়ের মাথায় আমাকে ১০ টা ২০ এর ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস আমার হাতে দিয়ে বললেন, লন্ডনে তোমার বন্ধু ও আত্মীয়ের সাথে সুন্দর সময় কাটুক।

বিলেত ছোঁয়া

সেদিনের ভাগ্য আমার অত্যন্ত প্রসন্ন ছিলো। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে লন্ডনের পথে যাওয়ার সময় শুয়েবকে প্রথমেই বললাম- নানা কারণে আজকের দিনটা আমার অনেকগুলো সেরাদিনের একটি। একসাথে এতোগুলো ফলাফল আমার পক্ষে যাবে ভাবিনি।

গাড়ির জানালা থেকে দেখা লন্ডনের পরশ

লন্ডন নিয়ে আমার কৌতুহলের শেষ নাই। জন্মের পর থেকে সিলেট শহরের নাম শোনার আগে লন্ডনের কথা শুনেছি। ছোটবেলা থেকেই জানি লন্ডন আমার নানা বড়ি। নানা-নানী, ২ মামা ও তাদের সংসার, ৩ খালা ও তাদের সংসার। আমার মা, নিতান্তই নানার বড় মেয়ে বলে তার লন্ডন আসা হয়নি। ১৯৭৬ সালে নানার পরিবার যখন লন্ডন আসে তখন থেকেই নানা বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে লন্ডনের কত গল্প, কত কাহিনী।

কোনো শহরে প্রথম যাওয়ার পর যা হয়, আমারও তাই হলো। এ শহরের গল্পগুলো যখন শুনেছি, তখন থেকে তার রাস্তাঘাট দালান, মানুষগুলোকে এক রকম করে চিন্তা করেছি। আবার এখন আমার সামনে দিয়ে দ্রুতগতিতে অতিক্রম করছে লন্ডনের প্রকৃত পরিবেশ। আমি আমার কল্পনা ও বাস্তবের দুই অবয়বকে মিলাতে চেষ্টা করেছি।

শুয়েব বলে- আমেরিকা দেখার পর লন্ডন ভালো লাগবে না, লন্ডন দেখার পর আমেরিকা গেলেই ভালো হতো।

কথাটা অনেকটাই ঠিক। আমেরিকার ৮টা স্টেট ঘুরেছি।  রাজ্য থেকে রাজ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতির তফাৎ হয়েছে। আমেরিকার সব রাজ্যের উঁচু উঁচু ইমারতের মিল থাকলেও তাদের পারিপার্শ্বিকতা একজনের চেয়ে অন্যের আলাদা। প্রকৃতির বৈষম্যতো আছেই। লন্ডনকেও আমি সে হিসাবে আমার ধারাবাহিক ভ্রমণের একটা অংশ হিসাবে যদি ধরি, তাতেও আমার কাছে মনে হবে, এ এক অভিজাত শহর। যদিও আপতত:ভাবে দালানকোটাগুলোকে দেখে মনে হবে, এগুলো পুরনো, কিন্তু এসবের ভিতর যে পরিমান খানদানিপনার গন্ধ পাওয়া যায়, তাতে বুঝতে বাকি থাকে না, খোদ আমেরিকাও যে অস্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের প্রতিভু ছিলো।

একে একে পার হয় যাই, ওয়েস্ট মিনিষ্টার এবি, ডাউনিং স্ট্রিট, বাকিংহাম প্যালেস, পার্লামেন্ট হাউজ, ট্রাফালগার স্কত্রি,  আরো কতো!

একবার নামতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সুযোগ নেই। গাড়ি থামার জায়গা নেই। থামলেই জরিমানা।

কিন্তু এতো সব ট্যুরিস্ট কী করে তাহলে ওখানে ঝাঁক বাঁধছে !

শুয়েব বলে- ওরা সবাই টিউবে এসেছে। লন্ডনে টিউব ছাড়া নড়া কষ্ট।

টিউব। ছোটবেলা পাঠ্যবইতে পড়েছিলাম লন্ডনের পাতাল রেলের গল্প। নিউইয়র্কে ওরা অবশ্য এটাকে সাবওয়ে নামে ডাকে। মাটি আর সমুদ্রের তলা জয় করে নির্বিঘ্নে চলাচল করার সুযোগ। উন্নত বিশ্বের উন্নত চিন্তা, উন্নত উপযোগ। আমরা ভেতো বাঙালী, আমাদের এতোদিন ছিলো শুনেই সুখ, এখন একটুখানি দেখে।

লন্ডন শহরের স্থাপত্যের পরিমিতি বোধ এবং ফাসাদের মধ্যে যে ঐক্যতান লক্ষ্য করা যায়, তার প্রশংসা কে না করবে! ছোট-সরু রাস্তা, হয়তো দুশো বছরের পুরনো, তার পাশ দিয়ে, একটুখানি ফুটপাত রেখে যে সকল দালানের অবয়ব দেখা যায়, মনে হয় তা যেন একই চিত্রকরের আঁকা ফাসাদের বিন্যাস। কোনটা পুরাতন আর কোনটা নতুন, খুব সহজে তাদের আলাদা করা যায় না। যারা এখন পুরনোটাকে মেরামত করে নতুন করছেন, তারাও নতুন কিছু যোগ করার অধিকার রাখেন না, তাদেরকে পুরনো স্টাইলটাকেই নতুন উপকরণ দিয়ে বানাচ্ছেন মাত্র, রংও করছেন আগের ইমারতের সাথে মিলিয়ে। এক্ষেত্রে আধুনিক স্থাপত্যের কোনোই প্রভাব যে লন্ডনের স্থাপত্যে পড়েনি, তা নয়। মূল শহরের নির্দিষ্ট এলাকা বাদে কিছু কিছু ইমারত উঠেছে কাঁচও ইস্পাতের মিলনে, এদের দু একটা তাক লাগানোর মতোও বটে।

লন্ডনে ঢুকে বর্নমাউথ থেকে আসা আমাদের ড্রাইভার ভাই পথ হারিয়ে ফেলেন। ঠিক কোন সড়কে পথ মাড়ালে সহজে অল্ডগেট যাওয়া যায় তার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। সুতরাং ৪৫ মিনিটের ড্রাইভে যেখানে পৌছার কথা, সেখানে পৌছাতে সময় লাগলো আড়াই ঘণ্টা। এই অতিরিক্ত বিড়ম্বনা যদিওবা ড্রাইভারের, আমার জন্য কিন্তু তা উপরি পাওনা।

সঙ্গিতায় কুদ্দুস ভাইর সাথে আমি ও শুয়েব

ব্রিকলেনের কাছে আসতেই শুয়েব বললো ‘লন্ডনের মেইন জিনিসগুলো তোমার দেখা হয়ে গেছে, আর কিছু বাকি নাই। এবার দেখো সিলেটী এলাকা।’

এই হচ্ছে বিরিক লেইন- ছোট্ট একটা গলির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে শুয়েব বললো কথাটি।

আসলে আমেরিকা থেকে এসে লন্ডনের নিচু নিচু ইমারত খুব চোখে লাগছে না। তার উপর যে সরু রাস্তা দিয়ে ঢুকছি তা দিয়ে রাস্তার পাশে একটা গাড়ি দাঁড়ানো থাকলে অপর দুটো গাড়ি নিজেদের অতিক্রম করতে বিড়ম্বনায় পড়ে।

ব্রিকলেনের নাম এখন বাংলা টাউন। ওখানে বাঙ্গালীদের দোকান, বাঙ্গালীদের বাণিজ্য এবং তার আশপাশ এলাকায় বাঙ্গালীদের বসতি। ওখানে বোরখাপরা মহিলা এবং টুপিপরা যে সকল মানুষকে দেখা যাবে, তাদের সাথে নিশ্চিন্তে সিলেটী কথা বলা যাবে। এমন তথ্য শুয়েবের।

একটা দোকানে ঢুকে পড়ি কাউকে কিছু না বলেই। এর আগে নিউইয়র্ক, ডালাসে কিংবা লসএঞ্জেলেসে বাঙ্গালীদের দোকানে ছবি তুলেছি, কথা বলেছি। কিন্তু এই দোকানে ঢুকেই বিড়ম্বনার শিকার। এক বিক্রেতা অতর্কিতে সিলেটী ভাষায় আমাকে বলেন- ছবি তোলা যাবে না। যা তুলেছেন তা রিওয়াইন্ড করে এর উপর অন্য কিছু তোলে এটা মুছুন। কে আপনি ? এসব…

আমি নিজের পরিচয় দেবার আগেই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। এর আগে নিউইয়র্কের বাঙ্গালী, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটস্ও দেখেছি। লন্ডনের এই বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকা ব্রিকলেন। ব্রিকলেনকে ঘিরে আমাদের গল্পের ও অহংকারের শেষ নেই। হাজার হাজার মাইল দূরে ইংল্যান্ডের বুকে আরেক বাঙ্গালী আবাসন। আমেরিকায় যেমন দেখেছি চায়না টাউন, লন্ডনেও আছে বাংলা টাউন।

ব্রিকলেন

সঙ্গীতায় যাই। কুদ্দুস ভাইকে ফোন করেছি এয়ারপোর্ট থেকে। তিনি বসে আছেন। বাংলা নাটকের ও সিনেমার ভিডিও ও অডিও ক্যাসেটের পাশাপাশি বাংলা বই, পত্র-পত্রিকার আড়ত তার সঙ্গীতা। লন্ডনী কইন্যার এডিটিং পরে সাবটাইটেল করতে গিয়েছিলাম অর্নেট নামক প্রডাকশন হাউজে। তার একজন মালিক প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী সেলিম চৌধুরী। এই নাটক এডিটিং প্যানেলে দেখে তিনি আমাকে বলেন এর লন্ডনে ভিএইচএস রাইট  আমি চাইলে সঙ্গীতাকে দিতে পারি। একবার তার পার্টনার কুদ্দুস ভাই দেশে এলে আমি ৩০ হাজার টাকা নিয়ে একটা বেটা ক্যাসেট তাঁকে দিয়ে দেই। টিভিতে প্রচারের আগেই এটা লন্ডনের বাজারে চলে যায়। প্রচারের পর এটা নিয়ে হৈ চৈ শুরু হলে বিক্রি বাড়ে। কুদ্দুস ভাই বলেন, বাই, মিছা মাত্তাম নায়, আমি ১৮ হাজার ফাউন্ড খামাইসি আফনার এক ক্যাসেট তাই। তাঁর দোকানে যাই। দেখি এখনো এর ক্যাসেট আছে, সাথে নতুন প্রচার হওয়া টেলিফিল্ম ‘নাইওরী’ ও । কাউন্টারে দাঁড়ানো একজন আমাকে কফির কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে বলেন –  বলেন- ‘আপনার লন্ডনি কইন্যা এখনও যার, আরোকটা দেইউক্রেকা আমরারে ‘।

আমি হাসি।  জবাব দেইনা। ঠিক কোন লাইনে কথা বলবো বুঝতে পারি না। এমনও শুনেছি  লন্ডনী কইন্যা বিটিভিতে প্রাচারের পর সিলেট ও লন্ডনে গন্ডোগোল শুরু হলে ব্রিকলেন মসজিদে জুমার নামাজ শেষে একলোক দাঁড়িয়ে মুসল্লিদের কাছ থেকে গণ-দস্তখত নিয়েছে  আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।

বেরিয়ে পড়ি সঙ্গীতা থেকে ।

কুদ্দুস ভাই নিয়ে গেলেন ‘জনমত’ অফিসে। জনমতের নবাব ভাই আমাদের খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু বেইজমেন্টে নেমে দেখি  জনমতে বসে আছেন মাসুদা ভাট্টি। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আয়েসী গলায় বলছেন, ‘আমেরিকা কাঁপিয়ে এলেন, এখন কি লন্ডন কাঁপাবেন?’

আমি হাসি। বলি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আছি আপনার এখানে, নবাব ভাই কৈ?

নবাব ভাই জনমতের সম্পাদক। কিন্তু ৫টা পর্যন্ত চাকরী করেন আরেক অফিসে। সাড়ে পাঁচটায় তার সাথে দেখা হবে আবার জনমতে। ইসহাক কাজল ছিলেন বাংলাবাজার পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি। তিনি কাজ করছেন এখন জনমতে। নিউজ দেখেন। মিনিট পাঁচেক বসে রওয়ানা দিলাম কুসুম খালার ঘরে। আমার নানাবাড়ির লোকজন সেখানে অপেক্ষা করছে।

আমার মামারা এসেছেন ৭৬ সালে। বড় মামা ক্লাস নাইনে পড়ার সময় চলে আসেন লন্ডন। তারপর থেকে পড়াশুনা নাই। কাজ করতেন এক চামড়ার ফ্যাক্টরীতে। ছোট মামাও এসে কিছুদিন পড়াশুনা করে কিছুদিন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, ওখানে লস খেয়ে ক্যাব, এসব করে যাচ্ছেন। তিন খালার বিয়ে হয়েছে। কুসুম খালার স্বামী শাহাব উদ্দিন বেলাল। লন্ডনের বাংলা কম্যুউনিটিতে উনাকে সবাই চিনেন। ওখানে গিয়ে দেখি কতগুলো বাচ্চা ছেলে সাইকেল চালাচ্ছে। একবার ভাবী, এদের কেউকি আমার খালাতো ভাই বা বোন! কারণ আমি ওদের নাম জানি মাত্র, ছবি দেখেছি, তাও বেশ আগে। এখন ওরা বড় হয়েছে। ওদেরকে দেখলে চিনবো না।

নাম জিগ্যেস করি। মিলে না। বাড়ি জিগ্যেস করি, মিলে না। কিন্তু তারাও সবাই সিলেটী। পরে জানলাম এ বিল্ডিং এর ২০টি ফ্লাটে সবাই সিলেটী। কুসুম খালার ফ্লাটে ঢুকেই দেখি ঘর ভর্তি মানুষ। নানা বাড়ির সবচেয়ে বড় নাতি লন্ডন এসেছে খালাতো-মামাতো ভাই-বোনদের উৎসাহের শেষ নেই। বড় মামার ৩ ছেলে ২ মেয়ে। বড় মেয়ের ১ ছেলে কোলে। কুসুম খালার ৩ ছেলে ১ মেয়ে, আদাই খালার ৩ ছেলে, সাজান মামার ২ ছেলে ১ মেয়ে। সব মিলিয়ে জমজমাট আয়োজন। ভাই-বোন গুলো সবাই পড়াশুনা করছে। বড় মামার মেঝ মেয়ে ৫টি এ প্লাস নিয়ে ‘ও’ লেভেল পাশ করেছে, তার মেঝ ছেলে লন্ডনের এক ক্লাবের হয়ে খেলে এসেছে জার্মান, ফ্রান্স ও আমেরিকা। কুসুম খালার বড় ছেলে হাসনাত টেলিকম্যুনিকেশনে কাজ করে ও ওয়েব ডিজাইনার মেঝ ছেলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে পড়ছে।

দেখলাম ২৪ বছর আগে তাদের বাবা মা-রা যেভাবে লন্ডনে এসেছেন, তাদের পরের প্রজন্মের জন্য লন্ডনের আবহ সম্পূর্ণ আলাদা। দেশের মাটিকে বিসর্জন দিয়ে একদিন নানা পাড়ি জমিয়েছিলেন লন্ডনে। সে সময় নিশ্চয়ই তিনি চিন্তা করেন নি, যে তার পরবর্তী বংশধরেরা হাজার হাজার মাইল দূরে শীতের দেশে আরেক আবাসন গড়ে তুলবে।

শুয়েব বিদায় নিয়েছে আগে। এখন ছোট মামার জিম্মায় আছি। তিনি কিছুক্ষণ পরপর ঘড়ি দেখেন আর বলেন, ডোন্ট ওরি, তুমি আসল জিনিস দেখি যাও।  আমরা ১০ মিনিটের জন্য যাই নর্টন হাউজে।

আহ। এই সেই নর্টন হাউজ ! সেখান থেকে যাই কমার্শিয়াল স্টিটের এক তেতলা বাড়ির সামনে। মামা বলেন, সেভেন্টি সিক্সে ফয়লা আইয়া অখানো উটছিলাম।  আমার ইচ্ছা, একদিন তোমার মারে আনিয়া দেখাইতাম।

লন্ডনে ছোট মামা রা বড় মামা

মামা বলেন- এখানে যখন ছোটবেলা আসি, তখন আমরা ক’জন মাত্র বাঙ্গালী। বাকী সব সাদা। এখন সাদারা আর এখানে থাকে না। তারা বিক্রি করে দিচ্ছে। বাঙ্গালীরা কিনে নিচ্ছে। সাদাদের টাকা দিয়েও এখানে রাখা যাবে না। এ অঞ্চল এখন বাঙ্গালীর।

রাত ৯ টায় হিথরোতে আবার ফেরত আসি। জানি দুবাই তে আমার জন্য মোস্তফা অপেক্ষা করছে।

 

মন্তব্য
Loading...