পঞ্চপর্যটকের ভ্রমণকাহন

২০০১ সাল থেকে ৫ বন্ধুর বিশ্বভ্রমনের ফিরিস্তি

 

আকাশেতে আমি রাখি নাই মোর ঊড়িবার ইতিহাস, তবু, উড়েছিনু, এই মোর উল্লাস

একসময় পাখীকে আকাশে উড়তে দেখে আমাদেরও ইচ্ছা হয়, পাখীর মতো উড়ে উড়ে জগতটাকে দেখার। আর সেই বাসনা থেকেই আন্দিজ থেকে আন্দামান, কিংবা লুক্সর থেকে লন্ডন, আমরা যাযাবরের মতো দলবেঁধে ঘুরে বেড়াই।

আমাদের এই ঘুরাঘুরি শুরু হয়েছিলো ছাত্রাবস্থায়ই, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্টাডি ট্যুরের নামে ভারত ভ্রমণ দিয়ে, গেলো শতকের আশির দশকে।

১৯৯০, কলকাতা

১৯৯০ সালে কলকাতার ৩০০ বছর পূর্তির স্থাপত্যসম্মেলনে যোগ দিতে গেলে সেখানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া জনাপঞ্চাশেক স্থপতির মধ্যে আমরাও ৫-৬ জনের দলে ভাগ হয়ে ঘুরতে থাকি।

কিন্তু আমাদের পঞ্চপর্যটকের এই দলটা এমনি এমনি ঠিক হয়ে যায় ২০০১ সালে মিয়ানমার ভ্রমণের সময়।

২০০১, মিয়ানমার
২০০১, মিয়ানমার

এই দলে বুয়েট আর ক্যাডেট মিলে পাঁচ জনের দল। স্থপতি কাজী এম আরিফ, স্থপতি তরিকুল লাভলু, ব্যবসায়ী এনায়ের কবীর, ব্যাবসায়ী এম সাঈদ হাসান আর স্থপতি শাকুর মজিদ।

১ নভেম্বর ২০০৩, আমস্টার্ডাম শিফল বিমানবন্দর

এই দলটির একটা বড় অংশ যখন ২০০৩ সালে চিলি যাওয়ার পথে আগে পিছে দুই সপ্তাহ ইউরোপ সফরের পরিকল্পনা নিলো এবং এই সফরে দলের এক সদস্য আমাদের পুরো যাত্রাটাকে ক্যামেরাবন্দি করতে শুরু করলো, সে সময় থেকে আমাদের এই সফর অনেক ব্যাঞ্জনাময় হয়ে উঠে।

চিলি যাবার আগে আমরা বার্লিনের শোভা দেখে ইতিহাসের শহর এথেন্সের ঘ্রাণ নিয়ে পুলকিত হয়ে আসি।

নভেম্বর ৭, ২০০৩, এথেন্স। সক্রেটসের জেলখানার সামনে

এরপর আন্দিজের শোভা উপভোগ করতে করতে আমরা নেমে পড়ি বাংলাদেশের ঠিক তলায় অবস্থিত দক্ষীন আমেরিকার মরিচাকার দেশ চিলিতে।

১০ নভেম্বর ২০০৩, সান্তিয়াগো, চিলি

২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে চিলিতে বসেছিলো বিশ্ব-স্থপতিদের এক মিলন মেলা। পাওয়ার এন্ড লো এনার্জির আর্কিটেকচার কিভাবে তৈরি হতে পারে তিন দিনে তার জ্ঞান নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি পাবলো নেরুদার বাড়ি দেখতে বা সান্তিয়াগোর নাগরিক জীবন বা ভেল্পারাইসোর কূল বরাবর লেগে থাকা প্রশান্ত মহাসাগরের ছোয়া পেতে।

চিলিতে থেকে ফেরত আসতে আসতে আমরা প্যারিসের ধূলা মেখে ফেরার পথে মোহময়ী ব্যাংকক দেখে দেশে ফিরি।

২৭ মে ২০০৭। মেকং মোহনায়

২০০৭ সালে পঞ্চপর্যটকের দলটি ভিয়েতনাম সফর করে। ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী অঞ্চল আর ভিয়েতনামী সংস্কৃতির ছোয়া নিয়ে ফেরত এলে

২০০৮, আন্দামান

পরের বছরই ভারতের রহস্যময় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ৫ রাতের একটা সফর করে আসি।

আন্দামানে চিত্রায়ণ
আন্দামানে সমুদ্রের উপর আন্তদ্বীপের ভ্রমণ

২০০৯ সালে পঞ্চপর্যটকের একটা বড় অংশ ওসমানী সুলতানের দেশ দেখতে ইস্তাম্নুল সফর করে। সেখানে ৬ শ বছর ধরে বেড়ে ওঠা ওসমানী সাম্রাজ্য ও তার বর্তমান রূপ দেখে, দেখে বসবরাসের উপর গড়ে তোলা সুলতানী প্রমোদ বিহারের বর্তমান রূপও।

২০০৯, অক্টোবর ৩। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে

ফেরার পথে ৮ দিনের জন্য মিশর সফর করতে করতে উদ্ধার করে ফেরাউনের গ্রাম।

২০০৯, অক্টোবর ১৭, লুক্সর

গিজার পিরামিড কিংবা লুক্সরের মন্দির বা মাটির তলার রাজ-রানী সমাধীপ্রাসাদ। ৪ রাত নীল নদের উপর ভাসতে ভাসতে নদী তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন প্রার্থনাশালার বর্তমান রূপ আর নীল নদ।

২০১০ সালে শ্রীলংকায় বসেছিলো এশীয় স্থপতিদের মেলা। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া স্থপতিকূলেরাও সেখানে যোগ দিতে গেলে পঞ্চপর্যটক দল উপভোগ করে শ্রীলংকার স্থাপত্য, সংস্কৃতি আর নৈসর্গিক রূপ।

২০১০, ফেব্রুয়ারি ২৪, আগুঙ্গালে, শ্রী লংকা

২০১১ সালের এপ্রিল মাসে তিন সপ্তাহের জন্য পঞ্চপর্যটক দল বেরিয়ে পড়ে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম দিয়ে শুরু হয় যাত্রা।

১৭ এপ্রিল ২০১১। স্টকহোম

৪ রাত থাকার পর ফেরি করে বাল্টিক সাগর পার হয়ে এসে পড়ে পোলান্ডের বন্দর নগরি গিদাইন্সক।

সেখানে দেখা পায় শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট লেচ ওয়ালেসার সাথে ।

২০১১, এপ্রিল। গিদাইন্সক, পোল্যান্ড
২০১১, এপ্রিল। গিদাইন্সক, পোল্যান্ড

প্রাচীন শহর গিদাইন্সক দেখা শেষে আমরা চলে আসি কোপার্নিকাসের শহর তরুন ।

২১ এপ্রিল ২০১১, তরুন। পোলান্ড

এক রাত কাটিয়ে আসি পোলান্ডের বর্তমান রাজধানী ফিনিক্স সিটি ওয়ারসোতে।

২২ এপ্রিল ২০১১। ওমর ফারুকের বাড়িতে

দু রাত ওয়ারশো দেখে বাংলাদেশের অনারারি কন্সাল জেনারেল ওমর ফারুকের শহর ক্যাথাভিতসে।

সেখানে থেকেই আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি আরেক পোলান্ডের জার্মান শহর ভ্রসলাভ, প্রাচীন লবনখনির যাদুঘর  আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুর্বিসহ স্মৃতি মাখা আশভিচ আর বির্কেনাও।

২২ এপ্রিল ২০১৯। ভ্রসলাভ যাওয়ার পথে

এর মধ্যে দুরাত সময় বের করে আমরা ঘুরে আসি ৯শ বছরের প্রাচীন শহর প্রাগ। সেখানে দেখা পাই পঞ্চপর্যটকের স্থায়ী ৬ষ্ঠ অশরীরী সদস্য রবীন্দ্রনাথেরও।

২০১১, এ্প্রিল। প্রাগ। পঞ্চপর্যট তাঁর অশরীরী ৬ষ্ঠ পর্যটকের সাথে

পোলান্ড ঘোরা শেষ হলে আমরা চলে আসি অস্ট্রিয়া, সেখানে সাউন্ড অব মিউজিকের নিসর্গ, প্রাচীন রাজাকাহন আর মোজার্টের স্মৃতিচিনহ ধারন করে পঞ্চপর্যটক দেশে ফিরে।

২০১১, এপ্রিল।সালসবুর্গ

২০১৩ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে দক্ষীন এশীয় স্থপতিদের মিলন মেলা বসলে এই দলের এক বড় অংশ সেখানেও যুক্ত হয়। আমরা প্রাণ ভরে অন্নপূর্ণা আর হিমায়লের সৌরভ উপভোগ করি।

২০১৩ সালের অক্টোবর। নেপালের পোখরা

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাপানের টোকিওতে এশীয় স্থপতিদের সম্মেলনে ও পঞ্চপর্যটকের বড় দল অংশ নেয়।

২০১৮ সালের অক্টোবর। টোকিও। ছবি তুলছেন তরিকুল লাভলু। ৫৬ তলার উপর থেকে জাপান দেখা
২০১৮ সালের অক্টোবর। টোকিও।
২০১৮ সালের অক্টোবর। টোকিও। দুই বাংলার স্থপতিকূলের জাপান সফর

টোকিওতে ৫ দিনের সেমিনার শেষে পঞ্চপর্যটক কলকাতার আরো পাঁচ স্থপতি পর্যটক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অসাকা, কিওতো, কোবে আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেক ভয়াবহ দুক্ষজাগানিয়া শহর হিরোসিমা দেখতে। সফর শেষে সমুদ্রের উপর গড়ে তোলা কান্সাই বিমানবন্দর দিয়ে আমরা ফেরত আসি দেশে।

২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর, সস্ত্রীক পঞ্চপর্যটকের ওশেনিয়া সফরের শুরুতে ঢাকা বিমানবন্দরে
১৬ নভেম্বর ২০১৯, ব্রিজবেনে নেমেই

২০১৯ সালে পঞ্চপর্যটক এক ব্যতিক্রমী সফরের ব্যবস্থা করে। এই প্রথমবার পঞ্চপর্যটক তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে ওশেনিয়া সফরে বেরোয়। পঞ্চপর্যটকের আরেক সহযোগী পর্যটক ডাক্তার মুনিরের আমন্ত্রণে ৪ রাতের জন্য এক ব্যাতিক্রমি দ্বীপ পাপুয়া নিউ গিনি দেখে আসে, যেখানে প্রায় সাড়ে আটশো ভাষার মানুষ বসবাস করে এবং এখনো অনেকেই আদীম প্রথার জীবন যাপন করে।

১৭ নভেম্বর ২০১৯। পাপুয়া নিউ গিনিতে ডাক্তার মুনিরের অভ্যররথনা
১৮ নভেম্বর ২০১৯। পাপুয়া নিউ গিনির এক গিরিখাদে পঞ্চপর্যটক
পাপুয়া নিউ গিনিতে, জোড়ায় জোড়ায়
১৯ নভেম্বর ২০১৯। পাপুয়া নিউ গিনির বিমানবন্দরে, বিদায়ের আগে

পাপুয়া নিউগিনি শেষে ২ সপ্তাহের জন্য আসে এক দ্বীপের এক মহাদেশ অস্ট্রেলিয়াতে, এসে নামি ব্রিজবেনে। গোল্ড কোস্ট দিয়ে শুরু হয় যাত্রা। এর পর সিডনী উড়ে এসে যুক্ত হয় এক্স ক্যাডেটের এক সম্মেলনে, এটা শেষ করে সড়ক পথে আসে মেলবোর্ন।

রিইউনিওনে আসা ক্যাডেটদের স্ত্রীরা রিসোর্টসংলগ্ন সমুদ্রতীরে জড় হলেন ফটোসেশনের জন্য , ২৩ নভেম্বর ২০১৯
ক্যানবেরাতে দুই দলের পঞ্চপর্যটক
এই মোর উল্লাস

মেলবোর্ণের রূপ ও প্রকৃতি দেখা শেষে রাজধানী শহর ক্যানবেরা দেখে পরদিন ফেরত আসি সিডনী। সিডনীতে আরো ৪ রাত থেকে ফেরার পথে সিঙাপুর এক রাত থেকে আমাদের তিন সপ্তাহের পঞ্চপর্যটকীয় সফরের আপাতত ইতি টানা হয়।

৩ ডিসেম্বর ২০১৯, সিঙ্গাপুর । বাড়ি ফেরার আগে

বিশ্ব জোড়া পাঠশালা আমাদের। নানা দেশ, নানা মানুষ, নানা জাতীর কাছে আমরা প্রতিনিয়ত শিখি, মিলি আর মেলাই। কিছু নেই, কিছু দেই। আর এসব আমরা কেউই একা ভোগ করতে চাইনা বলেই প্রিয়জনদের সাথে নিয়েই উপভোগ করতে আমাদের আনন্দ।

সফর শেষ করেও সে সফরের অভিজ্ঞতাগুলো আমরা কখনো লেখায়, কখনো চিত্রে, কখনোবা বানীচিত্রে প্রকাশ করি, এই আমাদের উল্লাস।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য
Loading...