আজকের ভ্রমণকাহিনী আগামীর ইতিহাসের উপকরণ

২২ অক্টোবর ২০২২, ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলার্স ক্লাব, গুলশানে মাহমুদ হাফিজ সম্পাদিত 'ভ্রমণগদ্য' প্রকাশনা অনুষ্ঠানের বক্তব্য

আমাদের সব লেখাই  আসলে একটি ভ্রমণকাহিনী

আমরা লেখায়, রেখায়, সুরে বা তালে যা কিছুই প্রকাশ করি না কেন, আসলে সবটাই আমরা আমাদের দেখা আর জানার জগত থেকে নেয়া। প্রকৃতির রং-রস বা অবয়ব দেখে দেখে আমরা তা অনুকরণ করে করে নিজের মতো প্রকাশ করি। যে যতো ছন্দোবদ্ধভাবে তার প্রকাশ ঘটাতে পারে সে ততো বড় শিল্পী।

এই প্রকাশ ঘটানোর কাজ সবচেয়ে বেশি করে আমাদের ঘর থেকে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপর একটি চমকা শিশির বিন্দুকে দেখে।

যেদিন থেকে মানুষ এই সুন্দরকে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলো, সেদিন সে পর্যটকে পরিণত হয়ে যায়। আর তার পর শুরু হয় ‘দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবের যাত্রা’।

আর এই দীর্ঘ যাত্রা পথে , একটা অনন্তপথের দিকে একমুখি ট্রেনের মতো মানুষের এই চলাচল কালে ঘাটে-ঘাটে, স্টেশনেবন্দরে নানা মানুষ, নানা রূপ, নানা রঙ দেখে যা অর্জন করলো তা-ই কখনো কাব্যে, কখনো গদ্যে তার প্রকাশ ঘটায়। এই পুরোটাই আসলে তাঁর একজীবনের ভ্রমণকাহিনীর খণ্ড খণ্ড উপস্থাপনা।

২২ অক্টোবর ২০২২, ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলার্স ক্লাব, গুলশানে মাহমুদ হাফিজ সম্পাদিত ‘ভ্রমণগদ্য’ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আগত ভ্রমণলেখকের একাংশ
ভ্রমণকাহিনী যখন ইতিহাসের নিয়ামক

ইতিহাসের জনক বলে পরিচিত গ্রিক দার্শনিক হেরোডিটাস ছিলেন প্রথমে একজন পর্যটকই ছিলেন

তাঁর বড় পর্যটন ছিলো মিশর নিয়ে। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি যে ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলেন এটা পরবর্তি দুই হাজার বছর পর্যন্ত ইতিহাসের ছাত্রদের মুখস্ত করার বিষয় ছিল।  সেই ভ্রমণকাহিনীকারের এতোই ক্ষমতা ছিলো যে মিশর সফর শেষে দেশে ফিরে সব কিছুর নামকরণ তাঁর নিজের মতো করলেনএর পর থেকে এই মিশরকে আর মিশর নাম কেউ চিনলো না, এর নাম হয়ে গেলো ইজিপ্ট। এমনকি ত্রিভুজাকারের সমাধী সৌধকে ফেরাউনেরা কী নামে ডাকতো আমরা আর জানিনা, হিরোডিটাসের দেয়া নাম পিরামিড, স্ফিংক্স, অবেলিস্ক, লুক্সর এসব নাম গোটা বিশ্বতো বটেই,  খোদ মিশরীয়দের গ্রহণ করতে আপত্তি ছিলো না। ভ্রমণকাহিনীর এমনই ক্ষমতা।

ইবনে বতুতা নামক মরোক্কীয় এক পর্যটক ২১ বছর বয়য়ে পায়ে হেঁটে মক্কামদীনা যাবার নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে পরবর্তি ৩০ বছরে ৪০টি দেশ ভ্রমণ করে বিশ্ব পর্যটকের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন।

ইবনে বতুতা কিন্তু ভ্রমণকাহিনী লিখেন নি। তিনি সম্ববত লেখা পড়া জানতেন না । ৪০টি দেশ সফর করে নিজ দেশ মরোক্কোতে ফেরার পর মরোক্কোর সুলতান তার ভ্রমণকাহিনীর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করার জন্য একজন কবিকে নিয়োগ করেন। সেটাই আমরা এখন পড়ি। আর এই ভ্রমণগদ্য প্রকাশ হয়েছিলো বলে আমরা চতুর্দশ শতকের পৃথিবীর একটা বড় অঞ্চলের ইতিহাস জানি। তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার রেফারেন্সে আমরা পাই তুর্কিতে রোমান সাম্রাজ্য হটিয়ে সুলতানী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। এমনকি আমাদের সিলেটের হজরত শাহ জালালের জীবনকালের ধারনাটি কিন্তু আমরা কেববলমাত্র এই পর্যটকের কাছ থেকে পাওয়া স্মৃতিকথার মধ্যে পাই।

এ ভাবে সে সময়ের মার্কোপোলা বা এর পরের ভাস্কো দা গামা, কলম্বাস একএকটা অজানা জায়গার কথা মানুষের কাছে প্রকাশ করে মানুষকে এই অপার বৈচিত্রের পৃথিবীর কথা জানিয়েছেন।

এর পর থেকেই মানুষ ক্রমশ ঘর ছাড়া হওয়া শুরু করে । ইবনে বতুতাকে ৪০টি দেশ দেখার জন্য টানা ৩০ বছর সময় দিতে হয়েছিল। এখন ৫-৭ বছরে বাংলাদেশের কেউ কেউ দেড়শোটার মতো দেশ দেখে ফেলেছেন, এমন নজীরও আছে।

আগের দিনের পর্যটকেরা ভ্রমণ কাহিনীর নামে যা লিখেছিলেন, এখনকার সময়ের পর্যটকের কাছে সেটা হচ্ছে ঐতিহ্যের অনুসন্ধান

ভ্রমণকাহিনীতে কাল্পনিক চরিত্র

যারা কল্পচরিত্র তৈরিতে ওস্তাদ, এঁদের আত্মজৈবনিক লেখাগুলো সুখপাঠ্য হয় বেশি, কিন্তু এতে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। আপনি যা যা দেখে এসেছেন এবং যা যা করে এসেছেন বলে লিখলেন, আপনার পাঠক তার সবটুকুই কিন্তু বিশ্বাস করে ফেললো।

গল্পের একটা কাঠামো আছে। সেখানে কাহিনী বিস্তৃত হবার পরেই একটা জটিলতা তৈরী করা হয়। এই জটিলতা কী করে ধীরে ধীরে ভাঙছে গল্পকার তা রসিয়ে রসিয়ে করেন, পাঠকও তা উপভোগ করে। তো ভ্রমণকালেও নানা রকমের জটিলতা তৈরি হতে পারে, এটা ভ্রমনেরই অংশ। কিন্তু এই বিষয়টা কতোটুকু সততার সাথে উপস্থাপনা করবেন একজন ভ্রমণলেখক, সেটা তাঁর নিজস্ব সততার উপর নির্ভর করে।

মুজতবা  আলী এক পাঠান বাবুর্চির হাতের আঙ্গুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, দুখানা হাত হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসে আঙুলগুলো দু কাঁদি মর্তমান কলা হয়ে ঝুলছে। পা দুখানা ডিঙি নৌকার সাইজ। কাঁধ দেখে মনে হল, আমার বাবুর্চি আবদুর রহমান না হয়ে সে যদি আমীর আবদুর রহমান হত তবে অনায়াসে গোটা আফগানিস্থানের ভার বইতে পারত। এ কান ও কান জোড়া মুখ- হ্যাঁ করলে চওড়াচওড়ি কলা গিলতে পারে। এবড়ো-থেবড়ো নাক-কপাল নেই। পাগড়ি থাকায় মাথার আকার-প্রকার ঠাহর হল না, তবে আন্দাজ করলুম বেবি সাইজের হ্যাটও কান অবধি পৌঁছবে।

রঙ ফর্সা, তবে শীতে গ্রীষ্মে চামড়া চিরে ফেঁড়ে গিয়ে আফগানিস্থানের রিলিফ ম্যাপের চেহারা ধরেছে। দুই গাল কে যেন থাবড়া মেরে লাল করে দিয়েছে- কিন্তু কার এমন বুকেট পাটা? রুজও তো মাখবার কথা নয়।“

এখানে কিন্তু দৈহিক শারীরিক বর্ণনার মধ্যে কাব্যময় অনেক উপমার ব্যবহার আছে যা পাঠকেরা মজার সাথে লুফে নিয়েছিল।

আমি একজন খ্যাতিমান কল্পলেখককে কথা জানি। তিনি খুব সুন্দর করে বানিয়ে কাহিনী লিখতে পারতেন। একবার তাঁর এক ভ্রমণকাহিনী পড়ে আমি খুবই মজা পেলাম। কিছুদিন পরে তাঁর সেই সহভ্রামণিকের সাথে আমার দেখা হলে আমি জানতে চাই, ঘটনাটা আসলে কী ছিল। তিনি জানান, এ রকম কোন ঘটনাই ঘটে নাই। যে দিনের গল্প লেখা আছে সেদিন তিনি ঐ জায়গায়ও যাননি।

ভ্রমণকাহিনী কখন লিখবো ?

ভ্রমণকাহিনী ভ্রমনের সাথে সাথেই লিখে ফেলা ভালো। তাঁতে মনে থাকে অনেক। ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনী লেখা হয় তাঁর প্রথম ভ্রমণের ৩০ বছর পর, তাও ৬ শ’ বছর আগে যখন মানুষের কাছে তথ্য রাখার ভালো ব্যবস্থা ছিলো না। সে কাহিনীর সবটুকুই আমরা সত্য বলেই জানি। কিন্তু আসলে তা কতটুকু ছিলো সেটা বলা মুশকিল।

আমাদের বাংলা ভাষার প্রথম ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলেন বঙ্কিমের বড় ভাই সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তরুন বয়সে এই ভ্রমণ করার পর তাঁর নিজের ভাষায়- বৃদ্ধ বয়সে বকবকানী করার মতো তিনি লিখেছিলেন। ১৮৮০ থেকে পরবর্তি ২ বছর ৬ কিস্তিতে এই লেখা ছাপা হয়েছিল একটি সাহিত্য পত্রিকায়।

বাঙ্গালীদের আরেক প্রিয় ভ্রমণ লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বিখ্যাত দেশে বিদেশে তিনি প্রকাশ করেছিলেন, ১৯৪৮ সালে, অথচ কাবুলে তাঁর সেই সফর ছিলো আরো কুড়ি বছর আগের।

এ দিক থাকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আলাদা। রোজনামচার মতো জাহাজে বসে বসেই তিনি জাপান, ইউরোপ, বা ইস্ফাহানের কাহিনী লিখে গিয়েছিলেন। এ কারণে রবীন্দ্রনাথের লেখা ভ্রমণকাহিনী পড়ার সময়ই মনে হয় এক অঞ্চলের বস্তুনিষ্ঠ পাঠ আমরা পাচ্ছি।

আজকের এই ভ্রমণগদ্য আগামীর ইতিহাসের অংশ

আমাদের এই নতুন সহস্রাব্দে এসে আমাদের ভ্রমণকাহিনী উপস্থাপনার মাধ্যম বদল হয়ে গেছে। সত্তর দশকের আগে প্রকাশ হয়েছে এমন কোন ভ্রমণকাহিনী আমার দেখা হয় নাই, যেখানে লেখার সাথে ছবির সংযুক্তি আছে।

রঙ্গিন ফিল্ম চলে আসার কারনে গত শতকের আশির দশক থেকে ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফির একটা অনুষঙ্গ চলে আসে। পৃষ্টার পর পৃষ্ঠা লিখে আমি যা জানাতে চাই, একটি আলোকচিত্র দিয়ে তাঁর থেকে সহজে ভ্রমণ বৃত্তান্ত বোঝানো সম্ভব হয়।

এরপর ছোট আকারের ডিজিট্যাল ভিডিও ক্যামেরা বাজারে চলে আসার পর ভ্রমণকাহিনী প্রকাশের ফরমেটের আমূল পরিবর্তন হয়, যা ফল স্বরূপ আমরা এখন মুঠোর ভেতর পেয়ে যাই ইউ টিউবে নানা রকমের ট্র্যাভেল ব্লগ। শুধু তাই না, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে আমি চাইলেই এখন এই গুলশানে বসে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের যে কোন অবস্থানের এই মুহূর্তের জীবন্ত চিত্র দেখতে পাবো।

আলাদা রূপ, আলাদা রস

একজন ব্লগার যখন তাঁর একটা ট্র্যাভেল স্টোরি দেখান, তখন কিন্তু তিনি নিজেই একা একা সফর করেন।

অথচ একজন ভ্রমণগদ্যকারের স্বাধীনতা ও সুযোগ আছে তাঁর পাঠককে তাঁর সাথে নিয়ে সফর করানো।

আজকের যুগে, এই গুগল আর উইকিপিডিয়ার কল্যাণে তথ্য জানার জন্য ভ্রমণকাহিনী কারো পড়া দরকার নাই। পার্থেননের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর স্থম্ভের সংখ্যা কিংবা ষাট গম্বুজ মসজিদে আসলে কয়টা গম্বুজ এই তথ্য জানার জন্য ভ্রমণকাহিনী আজ আর কেউ পড়বে না। যেটা পড়বে সেটা হচ্ছে সেই ভ্রামণিকের পর্যবেক্ষণটুকু। এবং এখানেই ভ্রমণগদ্যের সার্থকতা।

একই স্থানের তথ্য ১০০ জনকে দিয়ে লেখালে একই রকমের তথ্য পাওয়া যাবে, কিন্তু ১০০ পর্যটক যদি তাঁদের প্রত্যেকের পার্স্পেক্টিভ থেকে একটি জায়গার বর্ণনা দেন, তাহলে আমরা ১০০টি ভিন্ন রকমের বর্ণনা পেতে পারি। এমনকি একই জায়গায় দ্বিতীয়বার সফর করে যে ভ্রমণগদ্য লেখা হবে তা আগেরটার চেয়ে আলাদা।

এসব কথা গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাস বলে গেছেন আড়াই হাজার বছর আগে। তিনি বলেছিলেন, যে একই মানুষ কখনো দুইবার একই নদীতে স্নান করে না। প্রতিবারই নদীটা এবং মানুষ দুজনই আলাদা আলাদা থাকে।

হাজার বছর ধরে

আগেই বলেছিলাম যে, আমাদের সব লেখাই আমাদের আত্মজৈবনিক, সব লেখাই আমাদের নানা ভাবে দেখা, পৃথিবীর পথে হাজার বছর ধরে পথ হাটা নাবিকের বিচিত্র ভ্রমণেরই গল্প।

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে ঘুরে ঘুরে  বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
যিনি এক বনলতার সন্ধান পেয়েছিলেন, তিনি কিন্তু প্রেমের পদ্যের নামে এটা একটা ভ্রমণকাহিনীই লিখেছিলেন।

আজকের এই ভ্রমণদ্যের এই সংখ্যাগুলো থরে থরে সঞ্চিত হয়ে থাকবে আগামীর পাঠকের জন্য, এই কামনা।

মন্তব্য
Loading...