শিলচরের নারায়ণ ও একটি হাসপাতালের গল্প

করিমগঞ্জে ২১তম বইমেলার উদবোধন হবে, সেখানে বড় বড় অতিথির তালিকায় একজন ডাক্তারের নাম দেখে অবাক হয়েছিলাম। ডাক্তার হলেই যে তিনি লেখক হবেন না, এমন নয় নিশ্চয়। অনেক বড় বড় ডাক্তার বাংলাদেশেও আছেন যারা বড় লেখকও। আমার ধারনা অনেকটা সেরকমই ছিলো। তাঁর নামের আগে লেখা পদ্মশ্রী। এই পদকটি ভারতীয় সরকারের চতুর্থ শীর্ষ রাস্ট্রীয় পদক। শিল্পকলা, শিক্ষা, বাণিজ্য, সাহিত্য, বিজ্ঞান, খেলাধূলা, সমাজসেবা ও সরকারি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ভারত সরকার এই সম্মান প্রদান করেন। ভারতীয় সম্মাননার মর্যাদাক্রম অনুসারে, পদ্মশ্রীর স্থান ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ ও পদ্মভূষণের পরে। ২০২০ সালে তিনি এই পদক পান। তাঁকে সাথে করে ৩০ নভেম্বর করিমগঞ্জে আমরা বইমেলার ফিতা কাটি, উদ্বোধনী দ্বীপশিখা জ্বালি।

করিমগঞ্জে ২১তম বইমেলার উদবোধন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ডা রবি কান্নান

মঞ্চে যখন তাঁকে বক্তৃতার জন্য ডাকা হলো, বলা হলো- আমাদের কাছার তথা বরাকভ্যালীর ভগবানরূপী, আমাদের নারায়ণ ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রবি কান্নান এবার বক্তৃতা দিবেন।
তাঁর বক্তৃতায় বই নিয়ে কথা অল্প ছিলো, বেশিরভাগই ছিলো জীবনাচার শুদ্ধ হলে কী করে ৭০% ক্যান্সার ঝুকি কমিয়ে ফেলা যায় তা নিয়ে। একটা কথা আমার কানে বাজলো । তিনি বললেন, আমাদের কাছে আসা কোন রোগীকেই আমরা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে দেই না, তিনি যত দরিদ্রই হোক না কেন। আমরা সাধারণত নিম্ন আয়ের রোগিদের বেশি চিকিতসা দিয়ে থাকি। রোগি চিকিতসার খরচ দিতে পারবে কী না, সেটা আমাদের বিবেচনায় বিষয় না। রোগি এবং তাঁর সাথে থাকা সাহায্যকারীকেও আমরা খাবার দিয়ে থাকি এবং আমাদের সব ডাক্তার, রোগী এবং স্টাফেরা একই খাবার খাই।

বইমেলা উদবোধন মঞ্চে ডা রবি কান্নান ও লেখক

বক্তৃতা শেষে আমি তাঁর পাশে বসে তাঁর সাথে হালকা কথা বলি। তিনি চেন্নাইর বাসিন্দা। বাকী সবার মতো সিলেটি বলতে পারেন না। বাংলাও যা বলেন, তাঁর সাথে হিন্দি-ইংরেজি মেশানো। আমার বুঝতে খানিক সমস্যা হয়। আমরা ইংরেজীতে কথা বলি। জিজ্ঞেস করি, চেন্নাই ছেড়ে এই মফস্বলে কেনো এলেন ?
তিনি হাসেন। কথা বলেন না।
আমি বলি, আপনারা এতো সব ফ্রি চিকিতসা যে দিয়ে থাকেন, তার খরচ যোগান কী করে ?
তিনি আবারও হাসেন।
খানিক পরে বলেন, কাল কী আপনার একটু সময় হবে আমাদের হাসপাতালে একটু চা খাওয়ার ?
আমি বলি, এটা কোথায় ?
শিলচর শহর থেকে খানিক দূরে। কাছাড় ক্যান্সার হসপিটাল এন্ড রিসার্চ সেন্টার। করিমগঞ্জ থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূর। রাস্থা ভালো, সোয়া ঘন্টার মত সময় লাগে।
কিন্তু আমি যাব কী করে! চিনি নাতো !
ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি।

ব্যবস্থা হলো এমন যে, করিমগঞ্জের একমাত্র দৈনিক পত্রিকা ‘নববার্তা প্রসঙ্গ’-এর সম্পাদক হাবিবুর রহমান চৌধুরী আমাকে নিয়ে কাল বিকাল সাড়ে তিনটায় রওয়ানা দেবেন এবং আমরা সেখানে চা খাব।
ঠিক সে মোতাবেক, ১ ডিসেম্বর, ২০২২ বিকেল বেলা করিমগঞ্জ থেকে রওয়ানা দিলাম। পথে আমাদের সাথী হলেন এন সি কলেজের সহকারী অধ্যাপক বজলুর রহমান খান। সাড়ে পাঁচটায় আমরা পৌঁছে দেখি ১০-১২ জনের খাবার টেবিলের মতো একটা টেবিলের এক কোনায় কয়েকজন তরুনের সাথে বসে আছেন ডাক্তার কান্নান। অনেকের সামনে নানা রকমের নোটবুক। সেলফোনের ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসাব নিকাশ মেলাচ্ছেন দুইতিন জন মিলে। ডাক্তারের গায়ে খুব সাধারন মানের গলাকাটা টি শার্ট। দেখে মনে হয় যেনো এইমাত্র টেনিস বা ব্যাডমিন্টন খেলা রেখে উঠে এসেছেন এই ঘরে।
পরিসরটি ছোট ঠিক না, কিন্তু আড়ম্বরহীন। দুই কোনায় দুইজন ডেস্কটপ কম্পিউটার নিয়ে বসে আছেন। এক পাশে একটা সেলফ। তার মধ্যে নানা ডিজাইনের ট্রফি রাখা। সবগুলোই মানবতার দরদী এই চিকিতসককে নানা সংগঠনের দেয়া সম্মাননা স্মারক। এর মধ্যে আছে পদ্মশ্রী, মহাবীর পুরস্কারের মেমেন্টোও।
আমরা কফি খাই।
কফি খাওয়া শেষ হলে ডাক্তার বলেন, চলুন- আপনাকে আমাদের হাসপাতালটি দেখিয়ে আনি।
এর মধ্যে আমাদের সাথে যুক্ত হোন কাছার বিভাগের সুপারিন্ট্যান্ডিং ইঞ্জিনিয়ার রফিক আহমেদ চৌধুরী। আমরা হাসপাতাল সফরে বেরুই।

বেরুলাম ঠিক, কিন্তু বারান্দায় বেরুতেই রোগীর জটলা। সামনে ফার্মেসির কাউন্টার। সেখানে ওষুধ কিনতে এসেছেন অনেকে। ডাক্তারবাবুকে দেখেই প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে কয়েকজন দাঁড়িয়ে যান।

একটা বিশেষায়িত হাসপাতালের বারান্দায় হাসপাতালের সবচেয়ে বড় ডাক্তার এভাবে রোগী দেখবেন বা রোগীর স্বজনের সাথে কথা বলবেন, এমন দৃশ্য আমার আগে কখনো দেখা নাই।
আমরা হাসপাতাল ডিজাইন করার সময় অনেকগুলো প্রবেশপথ রাখি। আমাদের মাথায় রাখতে হয় যে হাসপাতালে ডাক্তার যেপথে প্রবেশ করবেন রোগীর চৌদ্দগোষ্টিও যেনো সেই পথ দিয়ে যেতে না পারে। তাঁর আগমন এবং নির্গমণ হবে একেবারেই আলাদা।
কিন্তু এখানে এসব নাই।
ডাক্তার কান্নান দুটো প্রেসক্রিপশন দেখলেন এবং হিন্দি ইংরেজী মিলিয়ে দুই রোগীকেই বললেন যে, আর ভয়ের কোন কারন নাই। সব ঠিক হয়ে যাবে। তিন মাস পরে যেনো আবার এসে ডাক্তারকে দেখানো হয়।
ডাক্তার বাবুকে নমস্কার করে রোগিরা বা রোগীর স্বজনেরা চলে যেতেই আমরা একটা করিডোর দিয়ে হাঁটতে শুরু করি।

যেতে যেতে থেমে যাই একটা নোটশ বোর্ডের কাছে। যেখানে লেখা আছে এই হাসপাতালের মিশন আর ভিশন।
ডাক্তার বাবু এই নোটশের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেন, দেখেন আমরা চাই কোন রোগীই যেনো অর্থাভাবে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে। মৃত্যু তো মানবের জন্য অবধারিত। কিন্তু এই মৃত্যুটাকেও আমরা সহনীয় করে দিতে চাই সকল রোগীর জন্য। আর এটা হচ্ছে ব্যাথানাশক ঘর । আমাদের হাসপাতালে প্রথম ভর্তি হওয়া রোগীরা সাধারণত অনেক ব্যাথা নিয়ে আসে। আমরা চিকিৎসা শুরুর আগে প্রথম যে কাজটা করি তা হলো, এই চেম্বারে রেখে তাঁর শরীরকে ব্যাথামুক্ত করি। এর পাশেই আছে সকল ধর্মের প্রার্থনার উপযোগী একটা ঘর। আমরা সেই কোরিডর দিয়ে আবার চলতে থাকি। এক পাশে কতগুলো ছোট ছোট কেবিন আছে। এক রোগী বা দুই রোগীর কেবিন। প্রায় ভালো হয়ে যাওয়া রোগিরা এই কেবিনে থাকেন। কেবিনের ভাড়া দৈনিক ১৩০০ রুপি। এর সাথে রোগী এবং তাঁর একজন সহকারীর খাবার যুক্ত আছে।

সাধারন ওয়ার্ড

তার উল্টাদিকে বড় ওয়ার্ড। নারী-পুরুষ মিলে মিশে থাকেন এখানে। এই ওয়ার্ডে সেসকল রোগী থাকেন, যাঁদের দীর্ঘদিন থাকার প্রয়োজন। খারাপ রোগী, যাঁদের আর বেশিদিন বাঁচার সম্ভাবনা নাই, তারা যেনো যথাযথ চিকিৎসা নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন, সেই আয়োজন এখানে আছে।
ডাক্তার কান্নান বলেন, কোয়ালিটি অব লিভিং এন্ড কোয়ালিটি অব ডাইয়িং বোথ আর ভেরি ইম্পোর্ট্যান্ট।

আমাদেরকে দোতালায় নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার কান্নান বলেন, আজই আমাদের এই শাখার এক বছর মাত্র পুরো হলো। আমরা একটা ব্লাড ব্যাঙ্ক চালু করেছি এখানে।
পরিচয় করিয়ে দেন এক তরুনী ডাক্তারের সাথে। তার নাম ডাঃ শবনম বাহার বারভূইয়া। ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর এই হাসপাতালে ব্লাড সেন্টার চালু হয়েছিল। এখন ডাঃ শবনম এই সেন্টারের দায়িত্বে।

ব্লাড ব্যাঙ্ক ইঞ্চার্জ ডাঃ শবনম বাহার বারভূঁইয়ার কাছ থেকে কথা শুনছেন লেখক ও অন্যরা

অত্যন্ত মেধাবী এক চিকিতসক ২০১৫ সালে এম বি বি এস আর ২০২১ সালে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্যাথলজিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেন। এর মধ্যে তাঁর চাকরিও হয়ে গিয়েছিলো শিলচর সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে যাননি। ভালোবেসে ফেলেছেন এই গরিবের হাসপাতালকে। তিনি ব্লাডব্যাঙ্কের বিভাগটি দেখছেন। আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো চত্বর দেখান। কখন কিভাবে মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে কোথায় মজুত রাখা হয় আর কিভাবে প্রয়োজনীয় রোগিদের কাছে তার ব্যবহার হয় তার সমূহ বৃত্তান্ত আমরা শুনি।
ডাক্তার কান্নান বলেন, যার যখনই রক্তের প্রয়োজন হয় আমরা দিয়ে দেই। আমরা কখনোই এর রিপ্লেসমেন্ট ব্লাড কারো কাছেই চাই না। আমাদের এই বিভাগটি ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে, কারন এর কোন টাইম টেবিল নাই। ঘড়ি ধরে তো মানুষের রোগ আসে না, আমরা ঘড়ি ধরে চিকিৎসা করি না। আমাদের চিকিৎসা সেবা দিন রাত ২৪ ঘন্টাই উন্মুক্ত থাকে। আছে আধুনিক ল্যাবরেটরি

আছে আধুনিক ল্যাবরেটরি

আমাদের কাছেও অনেক মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে আসে। আমরা তাঁদের রক্তও সংরক্ষণ করে রাখি। একজন মানুষ বছরে ৪ বার রক্ত দিতে পারে, তাতে তাঁর নিজেরও উপকার হয়।

ডাঃ শবনমকে বলি, আচ্ছা বলেন তো, এই ডাক্তার কান্নানকে কেনো সবাই তাঁদের নারায়ণ হিসাবে ডাকে ?
শবনম বলেন, এটা মূলত এই ডাক্তারের সততা, একাগ্রতা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারনে। আমাদেরকে তিনি শিখিয়েছেন যে রোগীর কোন জাত-ধর্ম-অর্থ-বিত্ত দেখার নাই। সকল রোগীকেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারাটাই আমাদের ব্রত।
তিনি বলেন, এই ব্লাড ব্যাঙ্কের ধারনাটাও তিনি নিয়ে এসেছিলেন মাত্র এক বছর আগে। আমরা যেহেতু রক্ত তৈরি করতে পারি না, আরেকজনের রক্ত নিয়েই আমরা এক রোগীকে দিতে পারি। আমরা বলি যে, তোমার লালটুকু নিয়ে আমি অপরের জীবনকে সবুজ করে দিতে পারি।
আর রক্ত পাওয়ার সাথে সাথে আমরা এর পাঁচ রকমের নিরীক্ষা করি। এইচ আই ভি, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ম্যালেরিয়া আর সিফিলিস। সুতরাং যিনি রক্ত দিতে এলেন তাঁর এই পাঁচটি পরীক্ষার ফলাফল তিনি বিনাখরচায় আমাদের কাছ থেকে পেয়ে গেলেন। সাধারণত এই পরীক্ষাগুলো কোন লক্ষণ না দেখা গেলে কেউ করাতে চায় না। এই সুবিধাটা ব্লাড ডোনাররা পেয়ে যান এখানে।
আমরা ব্লাড ব্যাঙ্কের নানা জায়গা ঘুরে দেখি।

বা থেকে দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গ সম্পাদক হাবিবুর রহমান চৌধুরী, লেখক শাকুর মজিদ, কাছার বিভাগের সুপারিন্ট্যান্ডিং ইঞ্জিনিয়ার রফিক আহমেদ চৌধুরী, ডাঃ রবি আর কান্নার, ডাঃ শবনম বাহার বারভূঁইয়া।

একসময় ডাক্তার কান্নান বলেন, একটা ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট আজ শুরু হবে ৭টায় আমাকে সেখানে যেতে হবে।
আপনি নিজেও খেলেন ?
অবশ্যই। আমি সবাইকে তো বলি, শরীর ঠিক রাখার জন্য পরিমিত খাবার আর পরিমিত শরীরচর্চা খুব বেশি দরকার। আমি নিজেই চালু করেছি এখানে এই খেলাধুলার জায়গা। সন্ধ্যা হলেয় আধাধন্টার জন্য খেলে আসি।
ডাক্তার চলে গেলেন। আমাদেরকে হাসপাতালের নানা জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতে শুরু করলেন কল্যান কুমার চক্রবর্তি।

হাসপাতালের নিবেদিতপ্রাণ প্রশাসক কল্যান কুমার চক্রবর্তি

তিনি এই হাসপাতালের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি জানান, এই হাসপাতালের প্রথম চিন্তা আসে ১৯৯২ সালে। তিনি নিজে এবং কয়েকজন সমাজসেবি অতি সাধারন মানুষের জন্য একটা হাসপাতাল নির্মানের কথা ভাবেন এবং ভাঙাচোরা ঘরে কাজও শুরু করে দেন। এর বছর ৪ পরে , ১৯৯৬ সালে সরকার থেকে ১১ বিঘা জায়গা পেলে এখানে দালান উঠতে শুরু করে। হাসপাতালের কোন মাস্টারপ্ল্যান ডিজাইন হয় না। যখন যার কাছ থেকে কিছু অর্থ সাহায্য পাওয়া যায়, তার কাজ করা শুরু হয়। এভাবে গত ২৬ বছরে হাসপাতালটি এই অবস্থানে এসেছে।
হাসপাতালটি নতুন মাত্রা পাওয়া শুরু করে চেন্নাই থেকে আসা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রবি কান্নানের আগমনের পর থেকে । ২০০৭ সালে চেন্নাই-এর বিখ্যাত ক্যান্সার হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে সস্ত্রীক চলে আসেন শিলচরে, মূলত দরীদ্র মানুষকে চিকিৎসা দিতে আর ক্যান্সার সম্পর্কে মানবমনের ভীতি কাটিয়ে ওঠাতে। সে সময় কল্যান চক্রবর্তিও শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তাঁরা দুইজন দিনরাত এক সাথে কাজ করা শুরু করেন।
ডাক্তার হয়তো রাত জেগে কোন রোগির চিকিৎসা করছেন, কল্যান পাশের চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছেন। তাঁকে ডাক্তার কান্নান প্রায়শই বলেন, আপনি হচ্ছেন নন-মেডিক্যাল ম্যাডিকেল অফিসার।

কাছার ক্যান্সার হাসপাতালের কর্মীবৃন্দ । ছবি – ইন্টারনেট

১৯৯৬ সালে ২৩ জন ডাক্তার-কর্মচারি নিয়ে ২০ বেডের এই হাসপাতাল চালু হয়েছিল। এখন ৪০০র মতো ডাক্তার-কর্মচারি আছেন, বেডের সংখ্যা ১৪০। বছরে এখন ৪ হাজারের বেশি নতুন রোগী দেখা হয়, ২৫ হাজারের বেশি রোগির চিকিৎসাউত্তর সেবা দেয়া হয়।
মজার ব্যাপার, এই হাসপাতালের ৮০% রোগীই দিনমজুর, ৬০% রোগীর মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নীচে এবং এঁদের ৪০% এর আয় মাসে ৬ হাজার টাকার নীচে। মাত্র ৬০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে সারা জীবন এখানে চিকিৎসা নেয়া যায়। স্বচ্ছল নন, অথচ ক্যান্সার রোগ আছে এমন যে কেউ একটা ইনকাম সার্টিফিকেট, একটা পঞ্চায়েত সার্টিফিকেট, ৫ কপি ফটো, একটা ফটো আইডি এবং অটল অমৃত অভিযান কার্ড হলে প্রায় ৯০ভাগ খরচ বেচেঁ যায়। রোগী এবং রোগীর সঙ্গীর খাওয়া ফ্রী। প্রয়োজনে রোগীর সহযোগীকে অস্থায়ী কাজ দেওয়া হয় এবং রোজকার মজুরিও দেওয়া হয়। রোগীর সহযোগী এখানে থেকে রোগীর সাহায্য করার পাশাপাশি নিজেও দিন চুক্তিতে কাজ করে উপার্জন করতে পারেন । সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি দাতারাও এখানে সাহায্য করে থাকেন। বরাক উপত্যকার সর্বস্তরের জনগণ এবং প্রতিটি ক্লাব,সংঘটন,মহিলা সমিতির অবদান আছে।

হাঁটতে হাঁটতে ডাঃ শবনম বলেন, আমাদের হাসপাতালের এই অবস্থার পেছনে আসলে সবচেয়ে বড় অবদান এই কল্যান চক্রবর্তীর। সেই ৯২ থেকেই আছেন। ২০০৭ পর্য্যন্ত আশা যাওয়া করতেন, ছোট একটা রুমে থাকতেন, নিজে রান্না করে খেতে্‌ সঙ্গে মৃত বিজয় দাস এবং শ্রী সমীরণ নাথ ছিলেন। ২০০৭ সালে স্কুল শিক্ষকের চাকুরি থেকে অবসর নেয়ার পর যতসামান্য সম্মানীর বিনিময়ে তিনি এই হাসপাতালেই তাঁর সংসার গড়েছেন। শুধু তাই নয়, গত ৪ বছর ধরে তিনি নিজেও ক্যান্সার আক্রান্ত। কিন্তু তাঁকে দেখে সেরকম মনেই হয় না। অস্বাভাবিক মনের জোর তাঁর। আর আছে সামাজিক বন্ধন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে প্রধান চিকিতসক, মুটে মজুর থেকে বড় রাজনৈতিক নেতা সকলের সাথেই তাঁর সুসম্পর্ক, সকলেই তাঁকে সম্মানের চোখে দেখে।

হাসপাতালে ঘন্টা খানেক ঘুরে বেড়ানোর পর আমরা খানিক ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ডাক্তার কান্নান চলে যাবার পর আমাদের সাথী আছেন হাসপাতাল প্রশাসক কল্যান চক্রবর্তি আর ডাক্তার শবনম। আমরা আবার চা খেতে বসি। খেতে খেতে আরো অনেক গল্প শুনি। এবং এটা বুঝে ফেলি যে ছোটবেলা রচনা বইয়ে ‘জীবনের লক্ষ্য’ লিখতে গিয়ে ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে গরিব মানূষের চিকিৎসা করবো বলে যত কথাই আমরা লিখি না কেনো, বেশিরভাগই তা পারে না। কেউ কেউ পারে।
এই হাসপাতালের পলেস্তারা খসা দেয়ালের দিকে তাকালেও বুঝতে পারা যায় যে এখানে বাণিজ্য নয়, মূলত মানব সেবার জন্য এমন মানবতাদরদি লোকের সমাগম হয়েছে এখানে।

আমাদের যাবার সময় হয়ে যায়। গাড়িতে উঠে দেখি আমাদের গাড়ি অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন।

মন্তব্য
Loading...