মহাজনের নাও- উজ্জ্বল দাশ

বিলেতে মহাজনের নাও

পূর্ব লন্ডনের ব্র্যাডি আর্ট সেন্টারে মহাজনের নাও। ছবি: রায়হান জামিলবাউল আবদুর রহমান (আমিরুল ইসলাম) অন্যলোকের যাত্রী করিমকে বুকে জড়িয়ে দরাজ গলায় গাইছেন ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, ছেড়ে যাবে যদি’। মঞ্চে বাউল করিম দেহত্যাগ করেছেন, অঝোরে কাঁদছে তাঁর ভক্তকুল। কুশীলবের কান্নার রোল ছড়িয়ে পড়ল দর্শক সারিতে।
দর্শক সারিতে ছিলেন সালেহা বেগম (৫৪)। নাটক শেষ হওয়ার পর তিনি বললেন, ‘নাটকটি দেখার সময় কেমন নাড়িছেঁড়া টান অনুভব করেছি। আমার বাপের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলায়। শাহ আবদুল করিমের গানের সঙ্গে ভাব অনেক দিনের। এ দেশে বেড়ে ওঠা আমার ছেলেও তাঁর গান শোনে। মহাজনের নাও শুধু নাটক নয়, করিম ভাইয়ের স্মৃতিতর্পণের অনন্য প্রয়াস।’
এমনি করে ৮৫ মিনিট করিমময় ছিলেন বাঙালি-অবাঙালি হলভর্তি দর্শক। পূর্ব লন্ডনের ব্র্যাডি আর্ট সেন্টারে যেন সেদিন বাউল করিম এসেছিলেন।
মহাজনের নাও নাটকটি বিলেতবাসীদের দেখার কথা ছিল নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিল আয়োজিত ব্রিটেনে বাংলা নাটকের বড় উৎসব ‘সিজন অব বাংলা ড্রামা ২০১৪’-এর উদ্বোধনী প্রযোজনা হিসেবে। সেই সময় সেটি হয়ে ওঠেনি, তাই চাপা খেদ ছিল নাট্যামোদী দর্শকদের। এবার তা দূর হলো।
১৬ ডিসেম্বর টেমসে নোঙর ফেলে মহাজনের নাও। নাটকপ্রিয় দর্শকদের খুশির ঝিলিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ স্থানীয় বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে ব্যাপক প্রচার মানুষকে আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে।
সুবচন নাট্য সংসদের ৩৩তম প্রযোজনা মহাজনের নাও। নাট্যকার শাকুর মজিদ ও নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী। ভাটি বাংলার অযত্ন লালিত শালুক, বাউল শাহ আবদুল করিমের জীবন, সাধনা, দর্শন ও কর্ম উপজীব্য করে নাটকের গল্প এগিয়েছে। গত ২১ ও ২২ ডিসেম্বর লন্ডনে হলভর্তি দর্শক উপস্থিতিতে নাটকের দুটি প্রদর্শনী হয়।
নাটকে বাউল শাহ আবদুল করিমের ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠা, গানের প্রতি ভাব, মুর্শিদের চরণ আশ্রয়। সহজ সাবলীল নাট্যসংলাপে নানা টানাপোড়েন নিয়ে এগিয়ে যায় করিমের জীবন। ভালোবাসার জোরে মানুষকে আপনার করে নেওয়ার নিরন্তর শক্তি ছিল তাঁর জীবনের প্রতিটি পরতে। হাল ছাড়েননি করিম, আপসহীন ছিলেন, খিদের জ্বালা ছিল কিন্তু তাঁর ভেতরে শক্তি বিত্তবৈভবের ঝোঁককে আমলে নেয়নি। কোনো কিছুই করিমের একার ছিল না, সবার জন্য লড়েছেন সব সময়।
নাটকে শাহ আবদুল করিমের জনপ্রিয় গানগুলোর সঙ্গে পূর্বপরিচয় দর্শকদের আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলে। ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের প্রবর্তক এনাম আলী বলেন, ‘বাউল করিম আমাদের আত্মার আত্মীয়। তাঁকে কোনোভাবেই ভুলে থাকা যাবে না। তাঁর কর্ম ও যাপিত জীবনের দর্শন বর্তমান প্রজন্মের প্রেরণা।’
প্রদর্শনী শেষে হলের বাইরে দর্শকদের জমজমাট প্রীতিসম্মিলনী, হইহুল্লোরের মাঝেই কথা বলছেন সুবচনের অধিকর্তা আহাম্মদ গিয়াস। বললেন, ‘দর্শকদের ভালোবাসা আমাদের আপ্লুত করেছে।’
নাটক দেখতে আসা বাংলাদেশিমাত্রই করিমের গানের সঙ্গে আপন আবেগ কিংবা টুকরো স্মৃতি। কিন্তু ভিনদেশির চোখে কেন জল? জানতে চাই ক্রিস্টোফার মার্লোর (৭৬) কাছে কেমন লাগল মহাজনের নাও? ‘আহ! অদ্ভুত। নাটকের ভাষা সবই তো এক। একজন জাত শিল্পীর মহাপ্রয়াণের দৃশ্য। নির্দেশকের বুনন ও কুশীলবদের অভিনয়শৈলী নাট্য মুহূর্তগুলোকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। একটু আবেগ তাড়িত হয়ে উঠেছিলাম। মোদ্দা কথা, ব্রিলিয়ান্ট প্রোডাকশন।’
কুতুব আফতাব বললেন, ‘সহজ করে করিম ভাই আমাদের কথাই বলে গেছেন। তাঁর জীবন ও কর্মের অনন্য ক্যানভাস নাটক মহাজনের নাও; অসাধারণ প্রযোজনা।’
নাটকটির নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী মাস তিনেক আগে এসেছিলেন দক্ষিণা সুন্দরী নিয়ে। এবার তিনি বললেন, ‘ব্রিটেনের নানা প্রান্ত থেকে শাহ আবদুল করিম আর নাটকের প্রতি ভালোবাসায় দর্শকেরা জড়ো হয়েছেন। এখানে দূরত্ব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।’
মহাজনের নাও দেশে ফিরেছে, কিন্তু ব্রিটেনে করিম মহাজনের ময়ুরপঙ্খী নাওয়ের রেশ থাকবে অনেক দিন।

উজ্জ্বল দাশ, লন্ডন

২৫ ডিসেম্বর ২০১৪, ০১:৫৭

মন্তব্য
Loading...