১০ সদর স্ট্রিট ঃ রবীন্দ্রনাথের কলকাতা-উদয়ন পাঠক

ঠাকুরের শহরকথা

গ্রন্থ আলোচনা ঃ ১০ সদর স্ট্রিট ঃ রবীন্দ্রনাথের কলকাতা – শাকুর মজিদ, প্রকাশক – প্রথমা, মূল্য ৪৫০ টাকা

উদয়ন পাঠক

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পশ্চিবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাবাশ্রয়ী ও আবেগনির্ভর প্রীতির ও সখ্যের সম্পর্ক।এই দুযোর্গের কালেও যে বহমান তার প্রধান সাঁকো রবীন্দ্রনাথ। পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও বাংলাদেশের মনন ও প্রজ্ঞা সেই মহাজীবনের সঙ্গে অনেক বেশি সংসক্ত ও সম্পৃক্ত থেকে খুঁজে নেয় বাঙালি জাতিসত্তার আইডেনটিটি,যেটা প্রাদর্ভুত তমিস্রার আবহে কোন মোহআবেশ নয় বরং এক দৃঢ় অবলম্বন, আর্তিময় নির্ভরতা।

স্থপতি,চিত্রনির্মাতা,নাট্যকার শাকুর মজিদ কর্মসুত্রে বার পঁচিশেক কলকাতা সফরে এসে শহরটার বর্তমান ছুয়ে খুঁজেছেন তার ইতিহাস, সাম্রাজ্যবাদ পুষ্ট সংস্কৃতি, দৈনন্দিনতা ও যৌথ মানসকে। পেশাগত কারণে কোনো শহরে গিয়ে তার যাপনের সঙ্গে, তার জৈবনিক অনুরণনের সঙ্গে, ওতপ্রোত হয়ে ওঠা একেবারেই সহজ ব্যাপার নয়, স্বাভাবিকও নয়। কলকাতার প্রতি তার আগ্রহ ও আতিশয্য, কনডাকটেড সাইট সিয়িং উপজাত নয়, বার্ডস আই ভিউও নয়, তিনি চিনতে চেয়েছেন তার ঠাকুরের সময়, সমাজ আবহ ও ব্যবহারিকতাকে।

“১০ সদর স্ট্রিট,রবীন্দ্রনাথের কলকাতার” সুচনাতেই তাই তার অনুসন্ধান পৌছে যায় পঞ্চদশ শতাব্দীর যশোর জেলার চেঙিগুটিয়া গ্রামে। যেখানকার জমিদার শুকদেব রায়চৌধুরীর কন্যার সঙ্গে বিবাহের ফলে পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথের অপরাধ তিনি যে পরিবারে বিবাহ করেন সেই পরিবারের দু’জন পর্বেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। এই জগন্নাথ কুশারীর এক উত্তর পুরুষ পঞ্চানন তার কাকা শুকদেব কুশারীর সঙ্গে কলকাতার গোবিন্দপুর গ্রামে থাকতে থাকতে সদ্যাগত জোব চার্নকের সঙ্গে ব্যবসাসুত্রে জড়িত হন। ব্রাহ্মণকে গ্রামের তথাকথিত নিম্নবর্ণের লোকেরা এখনও ‘ঠাকুর’ বলে। সেই থেকে ঠাকুর আর ইংরেজি কান ও জিভের দৌলতে টেগোর।

২৭২ পাতার বইটির প্রায় পুরোটাই জুড়ে আছেন রবীন্দ্র ও তার অনুষঙ্গ,এ শহরের কথা ও কাহিনী। কয়েকটি অধ্যায় এরকম: ঠাকুরের গ্রাম,ঠাকুরের নগর,কলকাতার ঠাকুর,ঠাকুরের গ্রন্থনগরী,ঠাকুরের সিনেমা.নাটক পাড়ায় ঠাকুর,ঠাকুর বাড়ির গান,১০ সদর স্ট্রিট:চারুলতার নষ্টনীড়”। আনন্দের কথা এই যে, প্রতিটি বিষয়ের গভীরে তিনি প্রবেশ করেছেন অতুল আগ্রহ ও আকর্ষণ নিয়ে। ওপর ওপর গল্পকথা বা কাহিনী খাড়া করার রঙ্গপ্রিয়তা তাকে প্ররোচিত না করায় বইটি হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক, তথ্যনির্ভর ও বিশ্বস্ত। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথ ও বিশেষ করে রবীন্দ্রমিথ ও রবীন্দ্ররোমান্স নিয়ে যেসব নাটুকে বিশ্রী বই তথ্য সমৃদ্ধতার ভান নিয়ে আবির্ভুত হয় সেসবের সঙ্গে শাকুর মজিদ এর বই এর যোজন তফাত। আসলে এ বাংলায় ইতিহাস ও উত্তরাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা নেই,আছে ছ্যাবলামো মেশানো সাংবাদিকসুলভ অপকৌতুহল। অথচ আলোচ্য লেখক নানা বাস্তব অসুবিধার সম্মুখীন হয়েও চেষ্টা করেছেন যতটা সম্ভব ইতিহাসনির্ভর উনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথমার্ধের জীবন অনুভব ও অনুশীলনের ছবি ধরে রাখতে। রবীন্দ্রে আপ্লুত ও বিস্ময়মুগ্ধ হলেও লেখক কলকাতার অন্য সব বিষয়েও উৎসাহী হয়েছেন, আর অদ্ভুত সব ক্ষেত্রেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন বা তার আসক্ত আগ্রহে ধরা দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও তার পরিবারের আলোকিত অনুষঙ্গ।

বাবুদের দরদালান থেকে সাহেবদের প্রাসাদনগর,ফুর্তির শহর,গঙ্গাপারের খাবার,কলকাতা দর্শন, এসব নানা বিষয় নিয়ে লিখতে তিনি খুঁজে পেয়েছেন নানা ঘটনা, কল্পকাহিনি, লোককথা। একটি শহরকে সত্যিকাররের ভালবেসে না ফেলতে পারলে এমন লেখা সম্ভব নয়। এটিকে কেবল ট্রাভেলগ বা ভ্রমন কাহিনি বললে বইটি সম্পর্কে কিছুই বলা হয়না। কেবল বাংলাদেশের পাঠক নন, এ বাংলার তো বটেই খোদ কলকাতায় বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষই অবগত নন কলকাতার বহুমাত্রিক রুপ ও রঙ্গবৈচিত্রের বিপুল উপাদান সম্পর্কে। ইতিহাস বিষয়ে তো নয়ই, নয় সমকাল নিয়েও।

পার্ক স্ট্রিট নিয়ে তিনি লিখছেন: “পার্ক স্ট্রিট তার পোশাকি নাম হারিয়েছে। একসময় তার নাম ছিল কবরস্থান সড়ক (বেরিং গ্রাউন্ড রোড)। এর পর এলিজা ইম্পে এসে ‘ডিয়ার পার্ক’ বানালে তার নাম হয় পার্ক স্ট্রিট। এখন সড়কটির নাম হয়েছে ‘মাদার তেরেসা সরণি’। পার্ক স্ট্রিটে খানদানি দালানের অভাব নেই। ইংরেজ আমলে কলকাতাকে জ্ঞান বিজ্ঞানে পেস্টিজিয়াস শহর হিসেবে গড়ে তুলতে তখন ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ ও ‘সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ’ স্থাপিত হয়েছিল এখানেই। পার্কস্ট্রিট বিখ্যাত হয়ে আছে তার পুরোনো পার্ক ও রাস্তাগুলোর জন্যই। পিটার ক্যাট এ ইন্ডিয়ান ক্যুজিন খেতে গিয়ে মনে হয়েছে ইউরোপের কোন শহর কিংবা নিউ ইয়র্কের কোন ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে বসে আছি। এখনো কলকাতার নাইট লাইফ পার্ক স্ট্রিটের ক্লাব পাব ও কফিশপগুলোকে ঘিরে উদযাপিত হয়। এ সড়কটি এখনো ঘুমোয়না। এমনও বলা হতো, নিউইয়ার্কের টাইম স্কয়ার কিংবা লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিট বা শহরের মতোই কলকাতার এই পার্ক স্ট্রিটও চিরবিনিদ্র সরণি হিসেবেই দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল।

লেখকের পিতামহ ও মাতামহ তাদের জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন খিদিরপুর অঞ্চলে। জাহাজে কাজ করতেন তাঁরা। তাদের সেই হারানো বাসা খুঁজতে গিয়ে লেখক বিধৃত করেছেন শ্রীহট্রের বহু মানুষের জাহাজে খালাসি হিসেবে কাজ করার কথা, তাদের অনেকের ইউরোপ আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের কাহিনি, আর তার সঙে বর্তমান খিদিরিপুরের হতশ্রী, নিরালম্ব অবস্থানের কথাও।

কলকাতার নানা খাবারের সঙ্গে মান্নাদে, পুলক বন্দ্যোপাধ্যয়, সুধীন দাশগুপ্ত, কলকাতার ছায়াছবি থেকে সাহিত্য, গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ, কলকাতায় আড্ডায় অসামান্য সব কথা লেখক চমৎকার সরল ভাষায় লিপিবদ্ধ করে কলকাতাকে পাঠকের কাছে করে তুলেছেন সুরুপা ও আকর্ষনীয়।

এমন সুন্দর এই উপস্থাপনায় তথ্যগত কিছু ত্রুটি বা অনবধানজাত ছাপার ভুল বিসদৃশ লাগে যদিও। আর একটি কথা, তিনি স্থপতি হয়েও কেন কলকাতার ঔপনিবেশিক প্রাসাদ ও দালানগুলিকে ‘শাসকবর্গের রচিত প্রতিফলন’ ‘অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল’ বলে অভিহিত করলেন তা আমাদের বোধগম্য হলনা। জোয়ানে টেলার এর ‘দ্যা গ্রেট হাউসেস অব ক্যালকাটা’ ও ‘দ্যা ফরগটন প্যালেসেস অব ক্যালকাটা’ কিন্তু অন্য কথা বলে।

ভারতের নবজাগ্রতির (তা সে আংশিক হলেও) শহর কলকাতার সে কালকে ও সেকালের মহৎ মানবদের প্রতি লেখকের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ তার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসাকেই অপরুপ বর্ণময়তা দেয়।

লেখক- প্রন্থ সমালোচক, কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘আরম্ভ’এর সহযোগী

২০/১১/২০১৬

মন্তব্য
Loading...