তাঁকে আমার অনেক ভয়

২০১৯ সালে 'পাতাদের সংসার'-এ প্রকাশিত

ফারুক ভাইর সাথে আড্ডায় আমি থেমে থেমে কথা বলি। মেধাবী লোকদের আমার খুব ভয় করে। এরা সামনাসামনি আড্ডার সময় চুপ করে কথা শুনে, মিটিমিটি হাসে, বেশি কথা বলে না। ফারুক ভাই এমন।

এই লোকটিকে নিয়ে আমি মাঝে মাঝে ভাবি। একটা কাট-খোট্টা চাকরি করে। সুদের ব্যবসা। আধুনিক নাম ব্যাঙ্কিং। টাকা জমা রাখিয়ে অন্যকে ধার দেয়। যারা জমা দেয় তাঁরা অল্প মুনাফা পায়, কিন্তু নিরাপদে তাদের টাকা থাকে। আর তাদের টাকা নিরাপদে রেখে এই টাকা অন্যকে ধার দিয়ে সুদ খায় ব্যাঙ্ক। এই থেকে তাদের আয় করে। এই আয় করানোর চাকরি করেন তিনি, এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে করেও আসছেন। টাকাপয়সাকে কী নীতিতে চালানো যায় এ নিয়ে  তাঁর  প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনাও আছে।এবং নিতান্ত মেধাবী বলেই, এই শাখাতেও তাঁর ব্যাপক দখল।

আড্ডায় মৃদুভাষী ফারুকভাই মিটিমিটি হাসেন শুধু

থাক তাঁর চাকরির কথা। তিনি দেশের নামকরা এক ব্যাঙ্কের প্রধান ছিলেন, এখন আরেক ব্যাংকে আছেন, পরে নাহয় আরেক ব্যাংকে যাবেন , নাহয় বাংলাদেশ ব্যাঙ্কেরইবা গভর্নর হবেন, তাতে আমার অল্প যায় আসে, আমি তাঁর অন্য প্রতিভায় মুগ্ধ। এ কারনে আমাদের আড্ডায় যখন তিনি কথা কম বলে মিটিমিটি হাসেন, আমি ভয় পেয়ে যাই।

ফারুক মঈনুদ্দিন আসলে একজন লেখক। তাঁর যা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার ইতিহাস, তা যেনেই বলছি, তিনি ডাক্তারি পড়লে দেশের নামকরা বড় সার্জন হতেন, ওকালতি পড়লে নামজাদা ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে অনেক টাকা নানাভাবে কামিয়ে দেশের বড় ইঞ্জিনিয়ার তিনি হয়ে যেতে পার‍তেন, ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকেছেন, দুই বড় ব্যাঙ্কের এমডি পর্যন্ত হয়েছেন- কিন্তু তিনি আর যা-ই হতেন বা না হতেন, তিনি আসলে লেখকই হতেন, সেটাই তিনি হতেও চেয়েছিলেন এবং হয়েছনও।

সুদকষার হিসাবনিকাশে পাকা ব্যাংকার, আসলে তিনি লেখকই

কিন্তু লেখালেখিটাও তাঁর নির্দিষ্ট কোন সাধনার বিষয় নয়। এই বিষয়েই বড় লেখক তাকে হতেই হবে এমনটি তিনি ভাবেনও নি। যেকারনে সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর অগোছালো বিচরণ। কবিতা দিয়ে প্রায় সবাই লেখা শুরু করে, তিনিও তাই করেছেন। সেখানে থিতু হননি। গল্প লিখতে চেয়েছেন- লিখেছেনও কিছু। আবার দেখি অর্থিনীতির নানা বিষয়ে তাঁর অনেকগুলো বই। এটা তাঁর পেশার কারনে লিখেছেন। তিনি মনেপ্রাণে অর্থনীতি নিয়ে লিখতে চাননি বলে আমার ধারনা। নানা পত্রপত্রিকার অনুরোধে লিখেছেন , সেসব লেখা জমা করে কয়েকটা বইও তাঁর হয়ে গেছে।

তাঁর সাথে আড্ডা-আড্ডির বয়স আমার বেশি না। খুঁজে পেলাম, ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির পুকুরপাড়ে কোন এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে বাইরে বসে প্রথম আমাদের আড্ডা হয়

আরো অবাক হয়ে দেখি তিনি কতোগুলো ইংরেজী ভাষার বই নিঃস্বার্থভাবে অনুবাদও করে ফেলেছেন। অনুবাদের বই আমিও পড়ি ঠেকায় পড়লে, কিন্তু কষ্ট করে আরেকজনকে অনুবাদ করে পড়াবো কোন দুঃখে? এমনিতে অনুবাদ করা মানে মূল লেখককে বাংলায় এনে দেয়া, সে হেমিঙ্গওয়ে হোক বা ক্লিন্টন বি সিলি, আমি বড় জোর কষ্ট করে ইংরেজিতে পড়ে নেবো, কিন্তু অনুবাদ করতে যাবো না। বরং এই সময়ে পারলে আরো দুইটা বই পড়ে নেব। কিন্তু আমাদের ফারুক ভাই অবলিলায় এ কাজটি করেই যাচ্ছেন। কেন করেন ?

তিনি অনেক ভালো ইংরেজি জানেন এটা বোঝানোর জন্য ?

বাইরের মানুষদের ঘরে এনে চিনিয়ে দেবার আয়োজনে এসব লেখা তাঁর

আসলে না।কেন করেন আমি জানি, একটু পরে বলছি।

আমাকে কেউ কেউ প্রশ্ন করেন- বাংলাদেশের জীবিত ভ্রমনলেখকদের মধ্যে আপনার প্রিয় কে ? আমি খুব দ্রুত নাম বলি – ফারুক মঈনুদ্দিন

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা একসাথে বসেছিলাম। বিষয়-ভ্রমণসাহিত্য। উপস্থাপক দীর্ঘ ভূমিকা দিয়ে আমাদের প্রশ্ন করা শুরু করলেন। প্রথম প্রশ্ন, ফারুক ভাইকে- আপনি কেন ভ্রমণকাহিনী লিখেন।

ফারুক ভাই জবাব দেন, আর আমি ভেতরে ভেতরে ঘামি।

কারন, আমার মনে হয়েছিলো, একই প্রশ্ন এরপরে আমাকে করা হবে। কিন্তু আমিতো নতুন কিছুই বলতে পারবো না। আমি যাযা বলবো বলে মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, দেখি হুবহু একই কথা ফারুক ভাই বলে ফেলেছেন।

মহাবিপদে পড়লাম।

এরপর এলো আমার পালা। প্রশ্ন করা হলো- ভ্রমণকাহিনী লেখার সময় আপনি কীকী বিষয় বিবেচনা করেন ?

আমি যাযা বিবেচনা করি তার ফিরিস্তি দিতে থাকি এবং কিছুক্ষণ বলার পরে দেখি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ফারুক ভাই একই কথা বলে আমার পালা শেষ করালেন।

ঘুরে বেড়ানোটাকে একান্ত নিজের করে রাখেন নি, ছড়িয়ে দিয়েছেন সবার জন্য

তাঁরসীমান্তহীন ইউরোপ বা নির্ঘুম নিউইয়র্কে আমি তাঁর সাথে হেঁটে বেড়িয়েছি, কেনিয়ার সাফারিতেও গিয়েছি প্রায় একই সাথে। মজার ব্যাপার, শ্রীলংকা নিয়ে আমার ভ্রমণের বই লিখতে জীবনানন্দের সাথে আমি বেড়িয়েছিলাম, নামও দিয়েছিলাম তাঁর থেকে নিয়ে সিংহল সমুদ্র থেকে।  মজার বিষয় একই দেশ নিয়ে ফারুক ভাই যখন বই লিখেন তার নামও দিয়ে দেন সেখান থেকে। আমার দেয়া নামের সাথে বাকী দুই শব্দ (মালয় সাগরে) যুক্ত করে তিনি তাঁর বইয়ের ও নাম দিয়েছেন।

তবে একটা জিনিস লক্ষ করেছি, তাঁর ভেতরে জীবনানন্দ বড় বেশি বাসা বেঁধে আছেন। এই কবিকে নানা আঙ্গিকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে করতে নিজের কবিতা লেখাটা ছেড়ে দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর বই, এমনকী ভ্রমনের বইয়ের নাম ঠিক করতেও তিনি যখন লিখেন ‘সুদুরের অদূর দুয়ার বা ‘বিশ্বজোড়া অনন্ত অঙ্গনে, তখন মনে হয়, কবিতা তাঁর ভেতরে রয়েই গেছে।

তবে তিনি আসলে লিখেন কেন ?

তিনি লিখেন তাঁর একান্ত ভালোলাগাগুলো আরেকজনের কাছে পৌছাতে। যেকারনে কাজের জন্য থেকে যাওয়ার সময় মোহিনী মুম্বাইয়ে ঘটমান নানা ঘটনার কথা অবলীলায় তিনি আমাদের  শোনান, যেমন শোনান আর্নেষ্ট হেমিংওয়ের প্যারিসের স্মৃতিকথা বা তাঁর চলমান ভোজের শহরের গল্প।

নিজে যা দেখলেন, যা বুঝলেন যা পর্যবেক্ষণ করলেন তা কিংবা নিজে যা পড়লেন, নিজের যা ভালোলাগলো তা আরেকজনকে ভালোলাগাতেই তাঁর অনুবাদ করা। এজন্যই তিনি এমনটি করেন।

আর এসব জিনিস লিখতে হলে অনেক জানতে হয়। আর জানা মানুষেরা বলে কম, শুনে বেশি। ফারুক ভাইও তাই। আড্ডায় বসলে চুপ করে বসে থাকেন, কথা শুনেন আর মিটিমিটি হাসেন। তাঁর এই হাসিটাকে আমার অনেক ভয়। আমি জানি, এই হাসির সময় তিনি ঠিকই একটা কিছু বিচার করে বসে আছেন, বলছেন না।জ্ঞানীরাএমনই হয়।

ফারুক ভাইসহ আমাদের নির্মল আড্ডার একটা দলও আছে

অংকের হিসাবে ফারুক ভাই আমার৬-৭ বছরের বড় মাত্র। কিন্তু লেখা পড়লে মনে হয় অনেক বেশি বড়। যতো বড়ই হোন না কেন ফারুক ভাই, বয়স পঁচিশের পর কিন্তু আমরা আর ক্যালেন্ডারের হিসাবে বাড়ি না। এই জন্মদিনে আপনি ষাট পেরুবেন, খুব ভালো কথা। বেশি দিন নাই, আমরাও সিক্সটিস ক্লাবে সহসাই যোগদিচ্ছি।

ভালবাসা অফুরান।

(এই লেখাটি হারুন পাশা সম্পাদিত ‘পাতাদের সংসার’ নামক ফারুক মঈনুদ্দিন সংখ্যার জন্য লিখেছিলাম ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে।)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য
Loading...