নাইওরী- শুটিং এর গল্প

স্পটে বসে লেখা শুটিং কাহিনী

সুটিং ইজ এ ওয়ার

‘সুটিং ইজ এ ওয়ার। যুদ্ধ করতে বন্দুক দিয়ে শুট করতে হয়। নাটক বানানোও একধরনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের অস্ত্র হচ্ছে ক্যামেরা-’ তৌকির সাহেব মাঝে মাঝে এ বাণী শোনাতেন। কিন্তু ২৩ অক্টোবর (২০০০) রাত ন’টায় সুটিং স্পটে গিয়ে

আমার বুঝতে বাকী রইলো না যে যুদ্ধটা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।

এর মধ্যে টানা দু’দিন কাজ হয়ে গেছে। ২০ তারিখে এক বাস সৈন্য সামস্ত নিয়ে পরিচালক সাহেব ছুটে এসেছেন গুনিয়াউক গ্রামে। আমারও আসার কথা ছিলো, কিন্তু হয়ে ওঠেনি দুটো ঝামেলার কারণে।  মাত্র ৪ দিন আগে আমি দ্বিতীয় সন্তানের (ইবন) বাবা হয়েছি। স্ত্রী-পুত্রকে হাসপাতালের বিছানায় রেখে আমার পক্ষে টেলিফিল্ম বানাতে যাওয়ার চিন্তা করা অন্যায়। দ্বিতীয়টি ছিলো অফিসের ঝামেলা। দুই-পার্টনারের অফিসে দুজনই যদি অনুপস্থিত থাকেন, ব্যবসা লাটে উঠা ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না। সুতরাং ঠিক হলো তিনদিন পরেই আমি যাবো, সাথে যাবেন বাবার চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা রহমত আলী।

বামে মনিটার দেখছেন পরিচালক তৌকীর, তাঁর পাশে আমি, ইউসুফ আর সাংবাদিক আরিফ। ডানের ছবিতে হাকিম ভাই, আমি, বিপাশা আর রুনা ভাবী

রহমত ভাই নাটক নিয়ে পড়াশুনা করে এসেছেন ভারত থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক পড়ান। আমার পড়াশুনা ঘরবাড়ি বানানোর কারিগরি বিষয়ে। সুতরাং গাড়িতে তার পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমাদের সাথে সহযাত্রী হয়েছিল পাক্ষিক ‘আনন্দধারা’র সাংবাদিক আরিফ খান। তিনি তাঁর পত্রিকায় ‘লোকেশন থেকে’ বিভাগে এ নিয়ে একটা প্রতিবেদন করবেন। রহমত ভাইর সাথে তাঁর পূর্বপরিচয় আছেন। সুতরাং আলাপ-সালাপ দুজনের মধ্যে চলতে থাকলো ভালো। আমার সাথে কথা হচ্ছেন কম। কিন্তু খানিক পরেই আমি অভয় পেলাম যখন রহমত ভাই বললেন, ‘আমি একটানা দু’বার পড়েছি আপনার স্ক্রিপ্ট…এটা ডাবল ক্লাইমেক্সের একটা ফিল্মের স্ক্রিপ্ট………’ বলে নানারকম মিস্টি মিস্টি কথা বলতে শুরু করে দেন।

প্রশংসা শুনতে সবারই ভালো লাগে। আমিও সবারই মতো। সুতরাং তাঁকেও খাতির করা শুরু করে দিলাম। কিন্ত বেশিক্ষণ খাতির করতে পারলাম না। মন খারাপ হয়ে গেলো মাধবপুর খানায় পৌছে।

সুমাইয়া শিমুর ছিলো এ নাটকে প্রথম অভিনয়। তখন সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বিপাশার ছোট বোনের চরিত্রে অভিনয় ছিলো তাঁর। প্রথম নাটক করতে এসেই বিপাশার সাথে অভিনয় ! তার অনেক আনন্দ তখন ।

আমাদের ইচ্ছা ছিলো সকাল ন’টার মধ্যে ঢাকা ছাড়বো। বিকেলের মধ্যে পৌছাবো গুনিয়াউক। কিন্তু রহমত ভাইর মিটিং প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে বেলা দেড়টায়। এ মিটিং শেষ করে যখন গাড়ি ছাড়ি তখন বেলা আড়াইটা। মাধবপুর থানায় পৌছালাম সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায়। এর আগে, লোকেশন দেখতে যখন গুনিয়াউক এসেছিলাম, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো বেশ ভালো। ভালো- মানে বর্ষা তখন ভালো ছিলো। পশ্চিমবাজার থেকে একটা ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে সরাসরি গুনিয়াউক চেয়ারম্যান বাড়ি। আমাদের টেলিফিল্মের প্লটটা এমন যে এখানে বর্ষার হাওড়কে যতটা পারা যায় এক্সপ্লয়েট করে নিতে হবে। পানি নেমে গেলে নাইওরী বাপের বাড়ি যাবে কী করে !

কিন্তু এখন যখন শুনলাম যে, পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে।  ট্রলার যদিও খানিকটা চলে অনেক পথ ঘুরিয়ে, তবে সন্ধ্যার পরে কোনো ব্যবস্থা নাই।

মাধবপুর থানার ওসি সাহেব খাতির যত্ন করা শুরু করে দিলেন। তাঁর বাসা থেকে চা এলো, বিস্কুট এলো। এ কথা সে কথার পর তিনি যে উপদেশ দিলেন তা হলো – ‘এ সময় আপনাদের ওদিকে যাওয়া ঠিক হবে না। আপনারা বরং রাতে মাধবপুর থেকে কাল ভোরে গুনিয়াউক যান।’

আরিফের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এলো। ও এসেছে রাতের সুটিং দেখে পরদিন সকাল বেলা ঢাকা ফেরত যাবে বলে। রহমত ভাই দেরী করে রওয়ানা দিলেন বলে এ অবস্থা । এরপর ওসি সাহেব এলাকার আইন-শৃংখলার বিষয়ে বক্তৃতা দিলেন। উপদেশ দিলেন, যদিও কোনোভাবে যেতে হয়, তবে ফোর্স ছাড়া যেন না যাই। উনি ফোর্স দিতে পারে দুজন আর্মড পুলিশ, কিন্তু তারা আবার ফেরত আসবে কেমনে? সেক্ষেত্রে গাড়ি থানায় রেখে টেম্পু ভাড়া করে দুজন পুলিশ নিয়ে যাওয়া যায়।

গাড়িরও নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আরিফ তাতেও সায় দিলো। কিন্তু ওসি সাহেব আবার একটু বেঁকে বসলেন।  বলেন -গুনিয়াউকের রাস্তার ৮০ ভাগ হচ্ছে নাছিরনগর থানায়। তিনি তাঁর সীমানাটুকুর নিরাপত্তা আমাদের দিতে পারেন। বাকীটা নয়।  সামান্য পথ মাত্র মাধবপুরের পুলিশ স্কট করতে পারে।

এবার আমাদের মত , আল্লাহ ভরসা সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্ধকার পথে, কাঁচা রাস্তা দিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম আমাদের গাড়ি নিয়েই। হরিণবেড বাজারে এসে চেয়ারম্যান আবু লালমিয়ার (খুবই কৃষ্ণকালো চেহারার চুনরাঙা ঠোঁটের আপ্যায়ণপ্রিয় রসিকজন) দপ্তরে তিনকাপ চা খেয়ে ওখানে গাড়ি রেখে আরো তিন মাইল রিকশা করে যখন আমরা স্পটে গিয়ে পৌছি, তখন দেখি তৌকির সাহেব তার সামন্ত নিয়ে সত্যি সত্যি যুদ্ধে মেতেছেন। এ যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি রফিকুল বারী চৌধুরী। গুনিয়াউক-নাছিরনগর সড়কের উপর বেশ বড় একটা কালভার্ট। তার নিচ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট নদী (কিংবা বড় একটা খাল)। এ খালের ওপাশে একটা বটগাছ। বটগাছের নিচে বসে এক লোক বাঁশি-বাঁজানোর ভঙ্গি করছে। খানেক দূরে বড়সড়ো একটা ক্যাসেট প্লেয়ার। সেখান থেকে মূলত: বাঁশির সুর বাঁজছে। হাজার খানেক লোক কালভার্টের উপর দাঁড়িয়ে।

এ পর্যায়ে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেখানে বড়ই বিপর্যস্ত এক সৈন্য। কালভার্টের উপর থেকে দেখি সেনাপতি রফিকুল বারী চৌধুরী কামান তাক করে আছেন। এক ধূতি পরা মাঝির উপর। মাঝি নৌকা বেয়ে যতোই সামনে যাবার চেষ্টা করছে, নৌকা ততোই বাঁক নিয়ে নিয়ে উল্টা দিকে চলা শুরু করেছে। পরিস্থিতি এমন দেখে সর্বাধিনায়ক তৌকির সাহেব ধমকের সুরে বলেন ‘কাট, কাট।’

রাতে গিয়ে দেখি গাছ তলায় বাঁশি বাজাচ্ছেন হাকিম ভাই। বিপাশা বাঁশি শুনছে। পরদিন হাকিম ভাইর সাথে তুললাম ছবি

অমনি চারদিকে হাসির রোল। বিষয়টা বুঝতে সময় লাগলো খানিকটা। যখন দেখলাম জাহিদকে নৌকাসহ উদ্ধার করতে আরেকটি নৌকা নিয়ে একজন এগিয়ে গেল। পরে জানলাম- জাহিদকে যে এ চরিত্র দেয়া হবে, সেটা সে জানতো না। এক দৃশ্যে অভিনয় করার জন্য জীবনবাজি রাখতো না। সে স্ক্রিপ্টে পড়েছে কুচা নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার দৃশ্যে সে অভিনয় করবে, নৌকার কথা লেখা নাই। জীবনে নৌকা চালাতে সে দেখেছে, কিন্তু কোনোদিন নৌকা চালায় নি। কিন্তু জীবনের ভয়টা তার তখনই শুরু হয়েছে, যখন সে বুঝতে পারলো নৌকা চালিয়ে খালের ওপাড়ে যাওয়ার চেয়েও নৌকার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা তার অনেক বেশি জরুরী। কেননা, নৌকা থেকে ভারসাম্য হারিয়ে যদি সে পড়েই যায় কোনো কারণে, তবে আর জীবনের মতো অভিনয় করা লাগবে না। সে সাতার জানে না।

অবশেষে জাহিদ রণে ভঙ্গ দিলো। ঠিক হলো নৌকা দড়ি দিয়ে টেনে টেনে অন্ধকারের ভেতর সে নিয়ে আসবে। গলুই থেকে নামার পর সে ফ্রেমে ঢুকবে।

এবার আর তেমন অঘটন ঘটলো না।

মনারূপী আজিজুল হাকিম একমনে বসে বাঁশি বানাচ্ছেন। রাত। এ রাতের পরিবেশ তৈরি করার জন্য গোটা ছয় বেবি লাইট সাজিয়েছেন বারী ভাই। পুরো বটগাছে এক ধরনের আবছা আলো। পেছনে একটা মাছ ধরা জাল। এ জালটা ফ্রেমে ধরার জন্য একজন লোক আড়ালে বসে জালটা উঁচিয়ে রেখেছে। আলো পড়েছে জালের উপরও। মিল্কীর হাতে ক্যাসেট প্লেয়ার। বাঁশি বাঁজছে, আসল বাঁশি বাঁজিয়েছেন গাজি, নকল বাঁশি আজিজুল হাকিমের।

এই দৃশ্য কাট হবার পরেই আমার সাথে প্রথম কথা হলো হাকিম ভাইয়ের সাথে । সিলেটী ভাষায় কথা। ‘কিতা ভাই, বালা আছইননি।’

হাকিম ভাই ক’দিন আগে লন্ডন গিয়েছিলেন। মাস খানেক ছিলেন। লন্ডনের সিলেটীদের আতিথেয়তায় থেকে ভাষাটাও কব্জা করে এসেছেন। হাকিম ভাইর চরিত্র এক বংশিবাদক, ঘরকামলা। বিপাশাদের ঘরে কাজ করে। বিপাশা বাঁশি শুনলে রাতের বেলা গাছের তলায় এসে যায়। এ রকম তিন চারটি দৃশ্য আছে এই বটগাছকে কেন্দ্র করে।

গুনিয়াউক গ্রামের মানুষজনের ঘরে রাত আসে বলে মনে হয় না। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে পুরুষেরা, তাদেরকে খানিক আড়াল করে ঝোপঝাড়ের আড়ালে মহিলা।

রাত বারোটার দিকে সুটিং প্যাকআপ হয়। শুরু হয় খাবার আয়োজন। আমাদের নারায়ণ মাঝি রূপী- জাহিদ প্রকৃত পক্ষে আমাদের সৈন্যদলের রসদের জোগানদার। তার নেতৃত্বে ছুট্টু মামী কয়েকজন মাহিলাকে নিয়ে ৫০/৬০ জনের রান্না তৈরি করেন। ৫-৬ জন করে খাবার চলতে থাকে এক দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত।

ছোট্টু মামার বাড়ির উঠান , আমাদের শুটিং স্পট

গুনিয়াউক গ্রামের কয়েকটি বাড়ি আমরা মোটামুটি দখল করে নিয়েছি। সিলেট থেকে এসেছেন রুনাভাবী, তার স্বামী মনির ভাই। রুনাভাবী অভিনয় করবেন বিপাশার মা’র চরিত্রে। মনির ভাই হবেন মাঝি। কিন্তু মনির ভাইর কাজ শুরু হবে না। ২৬ তারিখের আগে। ২৬ তারিখে রুনাভাবীর কাজ শেষ। তিনি চাইলেই সিলেট চলে যেতে পারেন। কিন্তু স্বামীকে ফেলে একা যাবেনই বা কিভাবে।

এটা যত বড় সমস্যা তারচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের সামনে দেখা দিল মনির ভাইকে নিয়ে। মনির ভাই কী পরিমান অভিনয় পারেন, তা কখনো দেখিনি। কিন্তু শুকনা-শাকনা এই ষাটোর্ধ মানুষটাকে যখন লুঙ্গি পরিয়ে, খালি গা করা হলো, মনে হলো অর্ধেক অভিনয় তাঁর করা হয়ে গেছে। কিন্তু বিপদে ফেললেন বৈঠা হাতে নিয়ে। বৈঠা ঠেললে কী করে নৌকা সামনে যায়, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তার জানা থাকলেও তিনি এই ষাট বছরের জীবনে তা কখনো পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। জিগ্যেস করলাম- মনির ভাই, আপনি সাতার জানেন তো?

মনির ভাই ভাঙা চোয়াল নিয়ে হাসেন। হাসলে তার গালের ভেতর গর্ত হয়ে যায়। এই গর্তগালে মুচকি হাসির রেখা টেনে বলেন, ‘ছোটবেলা দু-একবার সাতার দিয়েছি। এখন বোধ হয় ভুলে গেছি।’

কি বিপদ!

তাই বলে এই সময় নতুন করে একজন অভিনেতামাঝি জোগাড় করা সহজ নয়। এর আগে আরো দুজন মাঝিকে অভিনয় করতে হয়েছিল। একজন সত্যি সত্যি মাঝি। যে লোকটির ছইওয়ালা ইঞ্জিনছাড়া নৌকাটি তিনগ্রাম দূর থেকে তিনশো টাকা রোজে সাতদিন ধরে আটকে রাখা হয়েছিল, সেই মাঝি। তাকে নিয়ে ঝামেলা করতে হয়নি, কেননা, তার বৈঠা আর পিঠ ছাড়া তেমন কিছু ক্যামেরায় ধরা হয়নি।

দ্বিতীয় যে মাঝিকে নেয়া হয়, সে আমাদের ফুলমিয়া। মূলত: সে রিকশা চালায়। তৌকির-বিপাশা সে চেনে না। কিন্তু সিনেমা-নাটক দু-একবার দেখেছে। ঢাকা থেকে লোক এসেছে ফিলিম বানাতে তাদের গ্রামে, সুতরাং রিকশা চালানো বন্ধ। ফুলমিয়া তার রিকশা নিয়া চেয়ারম্যানবাড়ির পুকুরপাড়ে বসে থাকে। ইউনিটের লোক এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাবে, ফুলমিয়া রেডি। বাজার করতে যাবে জাহিদ, ফুলমিয়া- চলো। বৃষ্টি হচ্ছে খুব, বাজারের রিকশাওয়ালার কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে- ফুলমিয়ার প্যাডেল চলছে।

ফুলমিয়ার সখ একবার লম্বা ক্যামেরায় তার ছবি উঠানো। ঠিক হলো পিয়ারী (বিপাশা)র ছোটভাইকে যে মাঝি গ্রামে নিয়ে আসবে, ফুলমিয়া তার চরিত্রে অভিনয় করবে। সেখানে তাঁর একটা ডায়ালগও থাকবে।

ফুলমিয়াকে নিযে তৌকিরের কী যে বিড়ম্বনা। ‘ঐ যে নারকেল গাছটা দেখা যায়, ঐটা অইলো মাতবর বাড়ি’ – এই একটি মাত্র সংলাপ। তাও আবার ক্লোজ শটে ধরার চেষ্টা। ফুলমিয়া নারকেল গাছকে একবার বানায় তালগাছ, একবার বটগাছ, একবার সুপারী গাছ। আড়াই ঘণ্টা সময় নিয়ে তিনি তবে উদ্ধার করলেন পরিচালক সাহেবকে।

সাঁতার নাজানা নায়িকাকাহিনী

চিত্রনাট্যের অনেক অংশ জুড়ে নৌকা, হাওড়, শাপলা তোলার দৃশ্য ছিলো। এ ক্ষেত্রে পিয়ারী আর তার দুই ভাইবোনের অনেক দৃশ্য ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায়- বিলে, হাওরে। প্রথম দিকে পিয়ারীর ভাই ও বোনের চরিত্রে কাষ্ট করার সময় আমাদের প্রথম জিগ্যেস ছিলো-সাঁতার জানো? যে সাঁতার জানতো না, তাকে ডিঙ্গি নৌকায় নদীতে অভিনয়ের কথা বলতেই কেটে পড়তে। পড়লাম বিপদে। এর মধ্যে সময় চলে গেছে অনেক, টেলিফিল্মটি বানানো হবে কী হবে না, এ নিয়ে চললো দোদোল্যমানতা। ততোদিনে বর্ষার থৈ থৈ পানি নেমে এসেছে অনেকটুকু। সাঁতার সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে আর বেশি দূর ঘাটাঘাটি করলাম না, যখন শুনলাম কেন্দ্রীয় চরিত্র বিপাশাই সাঁতার জানে না।

সিলেটের টিটু- ‘লন্ডনি কইন্যা’ নাটকে স্কুল ছাত্রের চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছিল। তাঁকে যখন টেলিফোনে যোগাযোগ হলো, সেতো খুশি, অভিনয় করবে। কিন্তু স্ক্রিপ্ট পাঠানোর পর তার মার ফোন!

ভাই, আপননার স্ক্রিপ্টে নৌকা বাওয়ার সিন আছে, হাওড়, নদী অনেক, আমার ছেলেতে সাঁতার জানে না। আমি তো রিস্ক নিতে পারবো না।’

এক্ষেত্রে ওকে বাদ দেয়ার ইচ্ছা থাকলে এ কথার সুযোগ নেয়া যেতো। যেমন শিউলীর চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে অনেক মেয়ে এসেছিল। যাদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছিল ওরা পারবে না, তাদেরকে প্রথম প্রশ্ন- সাঁতার জানো?

বামের ছবিতে সাঁতার না জানা তিনজন। টিটো, শুমু আর বিপাশা। ডানের ছবিতে তাঁদের দিয়ে আমি ও বারী ভাই

যদি বলতো- ‘না’। তবেই ভালো। তারপর পানিতে অভিনয় করার কথা বললে দৌড়ে পালাতো। আমাদের আর ‘না’ করার ভয়াবহ বিরক্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। তবে টিটুকে এ মুহূর্তে হারিয়ে ফেললে- ৩দিনের মধ্যে বলা হলো। কিশোর যোগাড় করা কঠিন। টিটুর মাকে বলা হলো। পানি নেমে গেছে অনেক। আর হাওড়ই নাই, কোথায় অভিনয় করবে। নদীর দৃশ্য বাদ দেয়া হয়ে গেছে। আর বিপাশা যখন সাঁতার জানে না, তখন ভাইবোন মিলে পানিতে নেমে সাাঁতার কাটার দৃশ্য থাকবে না, আপনি নিশ্চিত থাকুন।

টিটুর মা নিশ্চিত হলেন বলে মনে হলো না। বাবাকে দিয়ে পাঠানো হলো টিটুকে। নির্দেশ ছিলো, ছেলে যেনো হাওড়ে না নামে।

ছেলেকে নিয়ে প্রথম সমস্যা দেখা দিলো বৈঠা বাওয়া নিয়ে। এই ছেলে কোনোদিন বৈঠা বায় নি। বৈঠা বিপাশা ও বায় নি। তার বাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু বারীভাই ক্যামেরা তাক করে বসে আছেন, টিটু পানিতে বৈঠা ডুবিয়ে কি করে ধাক্কা দিতে হয় তা জানে না। এর মধ্যে সে আঙ্গুল কেটে ফেলেছে কী করে। তৌকির সাহেব নির্দেশ দিলেন ভাইর হাত থেকে বৈঠা নিয়ে বড় বোন নৌকা বেয়ে বাড়ি ফিরবে। হলোও তাই।

হাওড়ে একটা সিলুয়েটেড লং শট দরকার। এ জায়গায় টিটুর কাপড় চোপড় পরিয়ে ওর বয়েসী একটা ছেলেকে বসিয়ে দেয়া হলো গলুইয়ে। কিন্তু নৌকা যখন ঘাটে ফিরবে তখন বেশ ক্লোজ শটে ধরা আছে বিপাশাকে। এবং এ জায়গাটায়। পানি বেশ গভীর। বিপাশার ভেতর সাঁতার না জানার ভয়ে খানিকটা যে কাঁপছে তা একটু টের পাওয়া গেলো। ওর এই ভয়কে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে তৌকির বলে উঠলো- ‘তোমার মেজর পার্ট হয়ে গেছে, বাদবাকী গুলা কিন্তু ম্যানেজ করা যাবে। ডুবে গেলে আমাদের খুব ভয় নাই, বৈঠা ধরো।‘ এ কথায় হাসির রোল পড়ে যায় ইউনিট জুড়ে। কিন্তু বিপাশা ঘাবড়ালো না, পড়লোও না। বৈঠা বাওয়া দেখে কখনো মনেও হলো না। যে পানি-বৈঠা-নৌকা দিয়ে এই প্রথম সে নিউটনের তৃতীয় সূত্র প্রমাণ করতে যাচ্ছে।

শুটিং ব্যবস্থাপনার দুই অন্তপ্রাণ তরুন। বায়ে অয়াকি টকি হাতে ডানে খোকন

গুনিয়াউকে আমাদের শেষ দিনের শেষ সুটিং হলো হাওড়ে। বেশ ভেতরে চলে গেলাম দু-দুটো ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে। পেছনের ইঞ্জিন নৌকার সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা আমাদের একটি মাত্র ইঞ্জিনছাড়া নৌকা। এই একটি নৌকাকেই তিনটি ভিন্ন দৃশ্যে তিনটি নৌকা হিসাবে দেখাতে হয়েছে। দর্শক হিসাবে আমি নিজেও সুটিং এ উপস্থিত না থাকলে বুঝতে কষ্ট হতো এই চাতুরী। নৌকাটির কখনো সামনের কবাট খোলা হয়েছে, কখনো কাপড় দিয়ে মুড়ে দেযা হয়েছে, কখনো পর্দা লাগানো হয়েছে।

হাওড়ে পৌঁছলাম পরিকল্পনা মাফিকই সন্ধ্যার খানিকটা আগে। এখানে ভোরের দৃশ্যের ও চিত্রায়ণ হবে, সন্ধ্যারও হবে। তৌকির আর বারী ভাই মিলে মিশে একের পর এক বিদ্ধ করছেন ভাটি অঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপ।

যে চরটায় আমরা নৌকা ভিড়ালাম, সেটি মূলত: একটা শ্বশান ঘাট। এটা মনে হতেই একটু ভয় ভয় শুরু হয়ে গেলো। বিস্তীর্ণ এই চরে একটি পাতাছাড়া মরা ডালওয়ালা গাছ এবং একটা আধভাঙা ইটের বাউন্ডারি করা ওয়াল ছাড়া আর কিছু নাই। আর যা আছে, তা হচ্ছে নরম ঘাস। পানি সরে যাওয়ার পর মরা ঘাস থেকে কচি ডগা গজিয়েছে।

তিনদিকে পানি। হাওড়। জেলেরা মাছ ধরছে। দূরে গ্রাম দেখা যাচ্ছে। দিগন্তের কাছাকাছি। সূর্য ডোবার আগে অনেকগুলো শট। এখানেও বিপাশা নৌকায় বসে থাকবে। একা। এর আগের রাতে মনার সাথে তার দেখা হয়েছে গেছে বাউলের আসরে। যার জন্য প্রতীক্ষায় থেকে তার দ্বিতীয় স্বামীর ঘরকে কায়-মনে গ্রহণ করতে পারলো না, তার সাথে যখন দেখাই হয়ে গেলো তখন তার প্রেমিক সংসারবিদ্বেষী বাউল। তার পরামর্শ- ‘ঐ স্বামীর মধ্যেই যেন সে তাকে আবিষ্কার করে’ এমন একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে সে ফিরছে স্বামীর ঘরে। কিন্তু যে মাঝি তাকে নিয়ে এসেছিল স্বামীর বাড়ি থেকে আজ সকালে তাকে ছুটি দেয়া হয়ে গেছে। মনির ভাই চলে গেছেন দলবলে সিলেট। সুতরাং প্রকৃত মাঝিকে পরানো হলো মনির ভাইর লুঙ্গি ও গামছা। একটা লং শট ছাড়া আর কোথাও তাকে ক্যামেরায় এক্সপোজ করা হলো না। এখানেও নৌকার ভিতর বসিয়ে রাখা হলো খোকনকে। সামনের গলুইয়ের কাছাকাছি বসে বিপাশা যদি কখনো পা ফসকে পড়েই যায়, উদ্ধারের জন্য অন্তত: একজন লোক তো নৌকায় থাকতেই হয়। সূর্য ডুবে যাবার পরও কিছু আলো থাকে। তৌকিরের ইচ্ছা ছিলো আরো কিছু মিউট শট নিয়ে রাখবে। এর মধ্যে একজন শুভানুধ্যায়ী এসে খবর দিলেন- ‘আপনারা তাড়াতাড়ি চলে যান- এ সময় ডাকাত আসে।’

এ অঞ্চলের এটাই সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা। আসার সময় মাধবপুর থানার ওসি সাহেবও এদের কথা বলেছিলেন। বারী ভাই এ বিড়ম্বনার সাথে পরিচিত। সুতরাং সন্ধ্যার আলো ম্লান হয়ে আসার আগে আগেই আমরা পাততারি গুটালাম চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে।

বিয়েবাড়ি শুটিংবাড়ি

ছুট্ট মামার উঠানে প্যান্ডেল বসেছে। ডেকোরেটার এনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে উঠান। লাল-নীল কাগজ তিনকোনা করে করে কেটে সুতলির উপর আঠা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বারী ভাই যে ঘরে থাকেন, সে ঘরের চৌকিতে সাজানো হচ্ছে কনে কে। সে ঘরের ভেতরেও বেশ সাজসজ্জা। বাড়ির সব তরুণীরা মিলে সারাদিন ধরে বিয়ের আয়োজন চূড়ান্ত করেছে। সন্ধ্যায় এখানে বিয়ে হবে তৌকির আর বিপাশার।

সন্ধ্যা ৮টার দিকে লোকেশনে গিয়ে দেখি মুখে রুমাল আঁটা পাগড়ি মাথায় পরা তৌকির সাহেব বসে আছে । তাকে ঘিরে চৌকির উপর গুনিয়াউক গ্রামের মরুব্বিরা। সামনে ডেকোরেটর থেকে ভাড়া করা চেয়ারে জনাবিশেক বিভিন্ন বয়েসী গ্রামবাসী।

তৌকির-বিপাশার বিয়ের এ দৃশ্য দেখার জন্য গ্রামবাসীর আগ্রহের সীমা নেই কয়েকজনকে বলা হয়েছিল কনের পাশে বসার জন্য। যারা সেজেগুজে এসেছেন তাদের সবাইকে বসাতে হলে অন্তত দশটা বিয়ের আসর করাতে হয়। আবার তারা যে পোশাক পরে এসেছেন সেটা এই সময়ের, হিন্দি সিরিয়েল শেখা পোষাক, গল্পের সময়কার পোশাক নয়।  সুতরাং ৪/৫ জনকে রেখে বাকীদের অপেক্ষা করতে হলো উঠানে। বিয়ের জন্য কাজীর চরিত্রে অভিনয় করতে রাজী হয়েছেন আমাদের হোস্ট ছুট্টমামা নিজেই। মামার প্রথম জীবনে মঞ্চে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছাড়াও তাঁর আরো পরিচয় আছে। তিনি বিটিভির প্রতিষ্ঠা লগ্নেই এসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান হিসাবে ক্যামেরা অপারেট করা শুরু করেন। আমাদের বারীভাই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যার হাত দিয়ে ১৯৬৫ সালে রামপুরার বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন থেকে প্রথম অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। সুতরাং বিটিভির এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী বহনকারী ঐ ক্যামেরাম্যানের সংস্পর্শে থেকে তারই মামা ছুট্টু মিয়া রামপুরায় কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বারীভাই রামপুরা ছেড়ে এফডিসি মুখী হওয়ার কারণে ছুট্টু মামা টেলিভিশনে একা হয়ে যা। তাঁর আর টিকে থাকার ইচ্ছা হলো না। গ্রামে চলে আসেন। এখনও আছেন। বড় ভাই চেয়ারম্যান। কিন্তু তিনি থাকেন ঢাকায়। চেয়ারম্যানের অবর্তমানে তিনি ‘চেয়ারম্যানী’ দেখাশুনা করেন। খেতখামার নিয়ে থাকেন। ছেলেপুলেরা বিদেশ।

শুটিং দলের অংশ

ছুট্টু মামা বিয়ে পড়ালেন। ছেলে যখন ‘কবুল’ বললো- দৃশ্যের সমাপ্তি সেখানেই। কিন্তু মামা থামলেন না। ক্যামেরা ধরা আছে মাস্টার শটে। মামা হাত তুলে মোনাজাত শুরু করলেন। পরিচালক সাহেব ‘কাট’ বলা বাদ দিয়ে দু’হাত তুলে মোনাজাতে যোগ দিলেন। তার সাথে পুরো দর্শক এবং গ্রামবাসীও বিয়ের মোনাজাত শেষ হতেই পরিচালক ‘কাট’ ঘোষনা দিয়ে পাগড়ি খুলেন। হাসির রোল পড়ে যায়। উঠান জুড়ে।

দিলারা জামান এ দৃশ্য আড়ালে দাঁড়িয়ে মজা করে দেখছিলেন। ছেলে বিয়ে করে ফেললো- মাকে বলে আসেনি, সালাম করেনি, এ কেমন ছেলেরে বাবা- বলেই আসর জমিয়ে ফেললেন।

তৌকিরের দৃশ্য শেষ হতেই বিপাশার ঘরের দিকে ক্যামেরা ছুটলো। এবারও বিয়ে পড়াবেন ছুট্টু মামা। কিন্তু তার আগে বিরোধ বেঁধে গেলো। সাজুগুজু করে আসা মেয়েরা, যারা ভেতরে ঢোকার জন্য জায়গা করতে পারছে না, তাদের একদফা এক দাবী, তারা বিয়ের মিষ্টি খাবে। চিত্রনাট্যের কোথাও মিষ্টি খাওয়ার দৃশ্য রাখা হয়নি। কিন্তু মিষ্টি তাদের খাওয়াতেই হবে। ছুট্টু মামী বললেন- মিষ্টি না খেয়ে কোনো মেয়ে বাড়ি যাবে না বাবা, তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করো।

মিষ্টি এলো ৫ কেজি। মিষ্টি ভাগাভাগিতে ব্যস্ত রইলো উৎসাহী তরুণ-তরুণীরা। এর মধ্যে একটা কঠিন বিয়ের দৃশ্যের চিত্রায়ণ শেষ হচ্ছে। যে বিয়েতে মেয়েটি তার নিজের মুখে ‘কবুল’ বলে না। এই কবুল না বলা নিয়েই কাহিনীর পরবর্তী অংশ। এই দৃশ্যের উপর অভারল্যাপ করবে ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখরে’ গানটি। আমি নিশ্চিত- এ দৃশ্যটি যখন পর্দায় দেখাবে, তখন কারো মনে মিষ্টি খাওয়ার আনন্দ জাগবে না।

তৌকির সাহেবের তখন খুব তাড়া। সূর্য পড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আরেকটি সিলুয়েটেড শট নিতে হবে। বর যাত্রার দৃশ্য। মনা ভাইর বিরহী গান- এই আলোতে এই সময়ে নেয়া হয়ে গেছে। সূর্য ডোবার পরপর খুব দ্রুত অন্ধকার নেমে আসে। এই আলো না পাওয়া গেলে ‘টেকনিয়ান্স’ এর আলো দিয়ে সূর্যাস্তের পরের দৃশ্য নেয়া যাবে না। সুতরাং এখন কারো দম ফেলার সময়  নাই।

বৃষ্টি, এফডিসির বৃস্টি

পান্ডুলীপিতে বৃষ্টির একটা দৃশ্য আছে দৃশ্যটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। টেলিফিল্মটির অন্যতম প্রধান চরিত্র মনা নায়িকা আর তার মাকে বৃষ্টি ও ঝড়ের ভিতর নৌকা করে েিয় আসে। বৃষ্টি ভেজা মনাকে দেখে পিয়ারীর খুব মায়া হয়। সে তার গামছাটি দিয়ে দেয় মনাকে গা মোছার জন্য। এ গামছাটি পরবর্তীতে এ সম্পর্কের একটা যোগসুত্র হিসাবে কাজ করে। শুধু গামছাই নয়, বৃষ্টিতে ভেজে মনা অসুস্থ হয়ে পড়ে। অপরাধবোধ থেকেই পিয়ারী অসুস্থ মনাকে দেখতে তার ঘরে যায়। সেই থেকে সম্পর্কের সূত্রপাত।

পান্ডুলীপি পড়ে তৌকির বললো- ‘বৃষ্টি যাবে এফডিসি থেকে।’ আমি বলি-, ‘কেন- আবহাওয়া রিপোর্ট দেখে সুটিং ডেট ঠিক করলে হয় না? অরিজিনাল বৃষ্টি পাওয়া গেলো।‘

তৌকির হাসলো। বুঝলো- মেকিং-এর কিছুই আমি বুঝি না।

১৭ অক্টোবর ইউনিট যখন ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছির নগর থানার গুনিয়াউক গ্রামে গেলো, তার সাথে দুজন অপারেটরসহ বৃষ্টির সরঞ্জাম ও সঙ্গি হলো। বৃষ্টিতে শুধু ‘পিয়ারী’ ভিজলেই হবে না, এ দৃশ্যে ‘মা’ ও থাকবেন। ‘মা’ রওশন আরা মুনির (রুনা ভাবী) সিলেট থেকে আসবেন ২২ তারিখ। সুতরাং বৃষ্টি নামবে ২৩ তারিখের পর।

ইউনিটের অন্যতম মহাব্যবস্থাপক – কামরুল আহবাব টিপু। ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ফকির চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন।

২৪ তারিখ বিকেলে গুনিয়াউকের পুলপারে ৩টা নজল থেকে বৃষ্টি ঝরলো। মনারূপী আজিজুল হাকিম বৃষ্টিতে ভিজলেন। ছাতা মাথায় পিয়ারী (বিপাশা হায়াত) আর ‘মা’ আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে নৌকা পার হলেন। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে নৌকা বাওয়ার ভঙ্গি করছেন হাকিম ভাই। ক্যামেরাম্যান রফিকুল বারী চৌধুরী শুধু মাঝে মাঝে এঙ্গেল বদলাচ্ছেন আর ক্যামেরার পজিশন সরাচ্ছেন। তিনজন লোক তিনটা নজল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ক্যামেরার সামনে। মনিটরে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা নকল বৃষ্টি। শুধু তাই নয়, বৃষ্টির পানি ছাতার উপর পড়ে যে মিষ্টি মধুর শব্দের সমাহার তৈরি করছে, তাও বুম ধরে রেকর্ড করা হচ্ছে। নায়ক হাকিম ভাইর রক্ষা নেই। এফডিসির বৃষ্টির পানিতে তাকে ভিজতেই হলো। দর্শকরা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়েও বৃষ্টির ছিটেফোটা গায়ে মাখার সুযোগ পেলো না। প্রচন্ড ঝড়ের বাদলার মধ্যে থেকেও মা-মেয়ে দুজন হাসতে হাসতে ছাতা সরিয়ে শুকনা কাপড়ে বেরিয়ে গেলেন। এ বৃষ্টিতে কারো জ্বরও এলো না। কিন্ত টেলিফিল্মের প্রেমকাহিনী শুরুই হয় এই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধানোর কাহিনী নিয়ে।

‘নাইওরী’ টেলিফিল্মটির বৃষ্টি নিয়ে উপরের প্রসঙ্গ লেখার প্রয়োজন হতো না, যদি ২৬ অক্টোবর রাতে এ ঘটনাটি না ঘটতো।

টেলিফিল্মে মোট ৪টি গান। তিনটে গানই সংগ্রহ করা। দুটি রাধারমণের লেখা, একটি জসিম উদ্দিনের। অপর গানটি টেলিফিল্মটির কাহিনীকে কেন্দ্র করে। যে গানটি শুনে বহু বছর পর নায়িকা তার হারানো বংশীবাদক প্রেমিককে বাউল হিসাবে আবিস্কার করতে পারে। গাওয়া হবে বয়াতির আসরে। সেইভাবে ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যার পরপরই গুনিয়াউক গ্রামের কম্যুনিটি সেন্টারের সামনের খোলা জায়গায় আসর বসানো হয়েছে । একজন বাউলকে তার দলসহ আমন্ত্রনও জানানো হয়েছে। তিনি সন্ধ্যা থেকে আসর জমিয়ে রেখেছেন। হাকিম ভাইকে মেকআপ দিচ্ছেন ফারুক ভাই। তার লম্বা দাঁড়ি, কাঁধ ছড়ানো চুল, লম্বা গোঁফ। গায়ে গেরুয়া পাঞ্জাবী, গলায় মাফলার।

এমন সময় খবর এলো মসজিদ কমিটির কাছ থেকে। ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে তাঁরা অনুরোধ জানিয়েছেন- আজ শবে মেরাজের রাত, এ রাতে গ্রামে সুটিং না করলে তাঁরা খুশী হবেন।

সিদ্ধান্ত হলো আজ আর সুটিং হবে না। কিন্তু হাকিম ভাই আর রহমত ভাই, যাদের দুজনই ২৬ তারিখ বিকেলে ঢাকার পথে রওয়ানা দেবেন তাদের নিয়ে দেখা দিলো সমস্যা। এক ঘণ্টা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো, ২৬ তারিখ সারারাত কাজ করে তাঁদের কাজ শেষ করা হবে। ২৭-এর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তারা বিদায় নেবেন গুনিয়াউক। সকাল ১০ টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন ঢাকা।

রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে লুডু খেলা হচ্ছে। প্রধান খেলোয়াড় দিলারা জামান।

২৬ তারিখ ভোর থেকেই কাজ শুরু। সন্ধ্যায় পিয়ারীদের বাড়ির কয়েকটা দৃশ্য চিত্রায়ন হলেই কম্যুনিটি সেন্টারের পাশে চিত্রনাট্যের ক্লাইমেক্স দৃশ্যটির চিত্রায়ণ হবে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুতের এই আছি এই নেই খেলা চললো ঘণ্টা খানেক।

রাত সাড়ে দশে বয়াতির গান স্যুট করার কথা থাকলেও ক্যামেরা খুললো রাত সোয়া একটায়। ‘হুনেন হুনেন ভাই বোনেরা হুনেন দিয়া মন, অচিন দেশের কইন্যার কথা করিব বর্নন…’ হোসনে আরা জলীর লেখা গান, সুর করেছেন সুজেয় শ্যাম, শিল্পী সেলিম চৌধুরী। ক্যাসেট রেকর্ডারে গান বাঁজছে, হাকিম ভাই ঠোঁট মিলাচ্ছেন। আসর জমে গেলো। পাবলিক বারবার শুনতে চায়। বারী ভাই এদিক, ওদিক, লং, ক্লোজ, করে ৬ বারে গানটির টেক যখন শেষ হলো, তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির পরিমান বাড়তে শুরু করেছে। কম্যুনিটি সেন্টারের ঘাটে নৌকা বাঁধা। ৬ দিন ধরে ছইওয়ালা এ নৌকা বেঁধে রাখা হয়েছে। এ অঞ্চলে অবশ্য এখন আর এই নৌকা পাওয়া যায় না। রঞ্জু যোগাড় করেছে, ওর ভাষায়- ৩ গ্রাম দূর থেকে। নৌকার পাশে আরো ৪/৫ টা ছোট ডিঙি রাখা । দৃশ্যটি ছিলো এ রকম যে, এ গানটি শুনে নাইওরী কন্যা পিয়ারী মাঝিকে পাঠিয়ে বয়াতিকে নিয়ে আসবে। নৌকার পাটাতনে মনা, ছইয়ের ভেতর পিয়ারী, মাঝখানে পর্দার দেয়াল। পিয়ারী মনাকে অনুরোধ করবে গানটা আবার গাইতে। মনা গাইতে চায় না। পিয়ারী হালকা করে পর্দা ফাঁক করে। মনা আলো আঁধারীতে দেখে বলে, ‘অবিকল যেন সেই’।

এরপর মনা ফিরে গিয়ে একটা জিনিস উপহার দিতে চায় পিয়ারীকে। পিয়ারী পেয়ে যায় তার সেই গামছাটি। গল্পের ক্লাইমেক্স। পিয়ারী এখন বিবাহিত, মনা বাউল, পিয়ারীর বাপের বাড়িতে তার কোনো জীবিত রূপ নেই, খবর রটানো আছে সে মারা গেছে। এ রকম একটা দৃশ্যের যখন চিত্রায়ণ শুরু হয়েছে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো অনেকটা ঝমঝম করে। নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়েছেন হাকিম ভাই। ভিজতে শরু করেছেন। ভিজছেন পরিচালক তৌকির, ক্যামেরাম্যান, ক্রু উপস্থিত দর্শক সবাই। তৌকির বললো- হাকিম ভাই, আমরা একবারে পুরো শট নিয়ে নেবো। হাকিম ভাই, কখনো না বলেন নি,। এখন বললেন, ‘আমাকে একটু প্রম্পট করতে হবে, আমি ডায়লগ ভুলে গেছি।’

বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে গেছে বিপাশা ও তৌকিরের শরীর। পাড় ধরে নামতে গিয়ে টিপু চিৎ পটাং হয়ে গিয়ে কাঁদায় একাকার। জোরে বাতাস বইছে। অরনেটের ক্যামেরা প্যাকেটের মধ্যে পুরিয়ে রাখা হয়েছে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য। এর মধ্যে আরেকটি শট বাকী। পাটাতনে বসে শেষ কথা বলছে পিয়ারী ও মনা। পিয়ারী অশ্রুসিক্ত। বৃষ্টির পানিতে চোখের জল আলাদা করা যাচ্ছে না। এ দৃশ্য মনিটরে দেখে মনে হলো, যে চিত্রনাট্য রচনার সময় আমি ওদের যে ছবি দেখেছিলাম, এ দৃশ্য তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি আবেগবহ। ঝড় ও বৃষ্টির মধ্যে প্রচন্ড আবেগ নিয়ে কথা বলছেন দুজনই। ঝড় ও বৃষ্টির সাথে যোগ হয়েছে বিয়োগান্ত নাটকের ইমোশন। হাকিম ভাইর শেষ সংলাপ শেষ হতেই বৃষ্টি ভেজা পরিচালক চিৎকার করে উঠলেন ‘শট ইজ ওকে, সুটিং প্যাক-আপ।’

বাতিওয়ালারা লাইট গুছালো, ক্যামেরা সরালো, ধরাধরি করে হাকিমভাইও বিপাশাকে তুলে আনা হলো নৌকা থেকে রাস্তায়। রাস্তার পাড়ে আমরা সবাই বসে বসে এ করুণ দৃশ্য দেখছিলাম। যেখানে বসে সুটিং দেখা হচ্ছিলো তার পাশে কতগুলো দোকান। বাড়িও আছে। যে কেউ জোরে হেঁটে কোনো ছাদের তলায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে পারতো। কিন্তু কেউ তখনও সরে পড়েনি। ইউনিটের লোকজনের প্রতি সহকর্মিদের ভালোবাসার টানে সবাই মিলে বৃষ্টিতে একাকার। কয়েকজন মহিলা ও এ দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। দৃশ্য শেষে দেখি বসে আছেন, নড়ছেন না। একজনের দিকে তাকাতেই দেখি, চোখে পানি। তিনি বললেন, ‘আপনি ওদের মিলিয়ে দিলেন না কেন?’

এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। সুটিং প্যাকআপ করে এখন আমাদের ঘরে যাবার পালা। একটা দুটা ছাতা যা-ও আছে, কেউ আর মাথায় দেবার ইচ্ছা করছে না। ম্যাকআপ রুমে সবাই মিলে বসলাম। হাকিমভাইর নকল গোঁফ দাঁড়ি এরমধ্যে খসে পড়েছে অর্ধেক। বাকীটা উঠাতে উঠাতে শুধু বলছিলেন- ‘আমি তৌকিরকে আগে থেকেই বলে আসছি যে এই ইম্পর্টেন্ট সীনটা আগে করে নাও- আমার কথা শুনলো না।’

এরপর শুধু আফসোস কিভাবে কখন কিসের পর কি করলে এই ঘটনা ঘটতো না। রাত বাজে সাড়ে চারটা। সাড়ে পাঁচটায় হাকিম ভাই আর রহমত ভাই রওয়ানা দেবেন ঢাকায়। হাকিমভাইকে কোনো শক্তি আর গুনিয়াউক আটকে রাখতে পারবে না। ২৭ তারিখ দশটার ধানমন্ডির চমক-উ-কুটিরে এক ইউনিট তার জন্যে ক্যামেরা পেতে বসে থাকবে। সেভাবেই কথা দেয়া।

শুটিং এর ফাঁকে বিপাশা

বৃষ্টি বাড়তেই থাকে। সাথে ঝড়ও। বারী ভাই সিগারেট ফুকতে ফুকতে বলেন- শাকুর ভাই, চিন্তা কইরেন না, আপনার বড়জোর এক শিফ্ট যাবে। ঢাকা গিয়ে আশুলিয়ার কাছাকাছি কোথাও এক সন্ধ্যায় আমরা এই সিন করে ফেলবো। হাকিম ভাই এক ফাঁকে বলেন, আগামী ১৫ দিন তার কোনো সিডিউল নাই। মন আরো খারাপ হয়।

এর মধ্যে ধীরে ধীরে ভোর হয়ে আসে। মসজিদে আযান হয়। কিন্তু ভোরের কোনো আভাস পাওয়া যায় না। অনেকটা বৃষ্টি মাথায় নিয় সকাল সাড়ে পাঁচটায় তিনটা রিকশা করে রওয়ানা হন ঢাকায় রহমত ভাই হাকিম ভাই, শিমুল ও তার মা, সিলেটের পথে ময়না ভাই আর রানাদা।

সকালে ঘুম যখন ভাঙলো তখনও বৃষ্টি। বিদ্যুত নেই। সবার কান রেডিওতে। নিম্নচাপ হালকা হয়ে এসেছে। এখন সেটা ঢাকা ছাড়িয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপর দিয়ে উড়িষ্যার দিকে চলে যাচ্ছে। ব্যাটা যাবিতো যা, এতো ঢং কেন।

সকাল থেকেই বিদ্যুত নাই, শোনা গেলো ন্যাশনাল গ্রিডে নাকি বিপর্যয় ঘটেছে, কোথায় একটা খুঁটি উড়ে গেছে এ দিনে। মাথায় হাত, মন খারাপ। বৃষ্টি। ঝড়ো হাওয়া। এর মধ্যে যে বাড়িতে আমরা থাকছি তার সামনে একটা গাছ উপড়ে পড়ে গেছে ঝড়ে।

বায়েরটা বিপাশার তোলা আমার ছবি, ডানেরটা আমার তোলা বিপাশার ছবি

এরই মধ্যে বিপাশাকে বের করে এনেছে তৌকির? ক্যামেরা ইউনিট নিয়ে বারী ভাই। দুটো ছাতা দিয়ে কোনো মতে ক্যামেরাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। বাকী সবাই ভিজছি বৃষ্টিতে। যে বৃষ্টি ঢাকা থেকে নিয়ে আমার জন্য ছিলো যান্ত্রিক আয়োজন, সেই বৃষ্টি যখন হামাগুড়ি দিয়ে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে, তাকে আমরা নিতে পারছি না। কিন্তু তাও কি হয়। বিপাশার ঠোঁটে ওরই নিজের গলায় গাওয়া একটা বিরহের গান আছে এ টেলিফিল্ম-এ। রাধারমণের লেখা- ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া…।’ দেখি এই গানের চিত্রায়ণ শুরু হয়েছে বৃষ্টির মধ্যে। বিপাশার বিরহি মনের যন্ত্রণা। ঝড়ের ভেতর গাছের ডাল ও পাতার অস্থিরতা। এর মধ্যে বাঁশের বেড়া ধরে তার কাছে বিরহী মনের আকুতি প্রকাশ করছে পিয়ারী।

দেখলাম- কিভাবে কখনো কখনো লায়াবিলিটিও এসেট-এ পরিণত হয়। আমাদের সীমাবদ্ধতাই আমাদের সম্পদ। এই নিয়ে এগিয়ে চলছে নাইওরীর সুটিং। দেখা যাক এর কপালে কি আছে।

শুটিং শেষে ঢাকা ফেরার পথে। বায়ের ছবি তুলেছে টিপু, ডানেরটা বিপাশা
গুনিয়াউক ২৯/১০/২০০০

 

পুণশ্চঃ

গুনিয়াউক  থেকে সুটিং শেষে যখন ঢাকায় ফিরবো, ছুট্টু মামা হাত ছাড়েন না।

–         মামা, একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?

–         কি, মামা, বলেন

–         টিভিতে প্রচারের আগে আমাদের গ্রামে যদি এটার একটা শো করতে পারেন, আমরা আর কিছু চাইনা।

ছুট্টু মামার মুখের উপর বললাম- ঠিক আছে মামা, দেখি। মনে মনে বললাম- এটা কি সম্ভব!

এডিটিং শেষ করে তৌকির বললো- কাল চলেন, গুনিয়াউক শো করে আসি।

যেই কথা, সেই কাজ।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রজেক্টরসহ ভাড়া করা হলের ২০ সিটের মাইক্রোবাস। ১৭ নভেম্বর (২০০০ সাল) ভোরবেলা ‘নাইওরী’র পরিচালক তৌকির আহমেদ, চিত্রগ্রাহক রফিকুল বারী চৌধুরী, প্রোডাকশন- ম্যানেজার মনিরুজ্জামান রঞ্জুকে নিয়ে রওয়ানা হলাম গুনিয়াউকের পথে। সাথে ভোরের কাগজের রাসেল (ও’নীল), যুগান্তরের সোহেলও। রাস্তা থেকে উঠলেন গুনিয়াউকের বর্তমান চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন আহমেদ। সম্পর্কে তিনি বারীভাইয়ের চাচা ও মামা। গুনিয়াউক গ্রামটি নির্বাচন করা হয়েছিল রফিকুল বারী চৌধুরীর চাপাচাপিতে। পান্ডুলীপি পড়েই বারী ভাই রায় দিয়ে বসলেন-এটা সুটিং হবে, গুনিয়াউক। ঢাকা-সিলেট সড়কে ঢাকা থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরে মাধবপুর। সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নাছির নগর থানার গুনিয়াউক গ্রাম। সেই গ্রামে তাঁর জন্ম। এবং নানার বাড়িও। গ্রামের চেয়ারম্যান তাঁর চাচা এবং মামা। সুতরাং সুটিং এ কোনো সমস্যা নেই।

গুনিয়াউক গ্রামে এর প্রথম প্রদর্শনী করতে যাওয়ার পথে সদলে, বামে। ডানে গ্রামে প্রদর্শনীর ছবি।

বারীভাইর অতিরিক্ত আগ্রহের পেছনে যে সকল যুক্তি ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া গেলো লোকেশন দেখতে যেয়ে। পরবর্তীতে সুটিং এর সময় পাওয়া গেলো অফুরন্ত সহযোগিতা। ফেরার পথে পেছনে ফেলে এলাম গ্রামবাসীর কাছে সুটিং চলার স্মৃতি। আর পুনরায় টেলিফিল্মটি দেখানোর প্রতিশ্রুতি। আমাদের নয় সদস্যের টিম যখন গুনিয়াউক পৌঁছালো তখন বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসী যার সাথেই দেখা হয়, তার প্রথম কথা- ‘আপনারা সতি –সত্যি আসবেন, এটা বিশ্বাস করিনি- অনেকেই বলার সময় অনেক কিছু বলে, পরে কথা রাখে না…।

সূর্য ডোবার পরপর কম্যুনিটি সেন্টারের সামনের খোলা জায়গায় নাড়া বিছিয়ে বসে পড়েছেন গ্রামের মানুষ। সামনে মহিলা, পেছনে পুরুষ। আকাশে মিটমিট করে জ্বলছে তারা। যে জায়গাতে ভিডিও প্রদর্শণীর আয়োজন সেখানেই সুটিং হয়েছিল একটা বাউল গানের আসর। তার পাশেই ছোট্ট খাল, নদী, সড়ক, বটগাছ। সন্ধ্যা ৬ টায় শুরু হলো প্রদর্শণী। ইউনিটের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানালাম গ্রামবাসীকে। তার সাথে এই প্রিমিয়ার শো’টি উৎসর্গ করা হলো গুনিয়াউক গ্রামবাসীকে।

 

মন্তব্য
Loading...