যদি কিছু মনে না করেন…আনিসুল হক

লন্ডনী কইন্যা' নাটক নিয়ে ১১ মে ২০০০ দৈনিক প্রথম আলো'র গদ্যকার্টুন উপসম্পাদকীয়

আজ আর গদাকার্টুন নয়, প্রিয় পাঠক, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু কথা বলতে চাই।

১। শাকুর মজিদ রচিত আর তৌকির আহমেদ পরিচালিত প্যাকেজ নাটক ‘লন্ডনী কইন্যা’ বিটিভিতে প্রচারের পর বেশ হইচই শুরু হয়ে গেছে। জাতীয় সংবাদপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ‘সিলেটের অনেকেই নাটকটি দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা ১০০ সদস্যবিশিষ্ট ‘লন্ডনী কইন্যা প্রতিরোধ কমিটি’ গড়ে তুলেছেন।

সভা-সমাবেশ সভায় নাট্যকারকে সিলেটে ‘অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পত্রিকায় এমন খবরও ছাপার অক্ষরে বেরিয়েছে— একজন বক্তা শাকুর মজিদকে ‘কুকুর মজিদ’ বলে অভিহিত করেছেন (প্রিয় পাঠক, এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহারের জন্য আমি আপনাদের কাছে ও শাকুর মজিদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী)।  বক্তাদের একজন এমনও বলেছেন, শাকুর মজিদ নিজে লন্ডনী কইন্যা বিয়ে করতে না পেরে ক্ষোভবশত যারা লন্ডনী কন্যা বিয়ে করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের বিদ্রূপ করেছেন। এছাড়া বলা হচ্ছে, নাটকটিতে সিলেটবাসীকেই প্রকারান্তরে অপমানিত করা হয়েছে।

বিভিন্ন পত্রিকায় (আঞ্চলিক পত্রিকায় নয়, জাতীয় পত্রিকায়ই) এ ধরনের খবর পড়ে মনটা বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। একটা নাটক লিখে, একটা শিল্পপ্রয়াসে অংশ নেওয়ার জন্য কেউ এ ধরনের অবমাননাকর উক্তির শিকার হতে পারে?

২। অবশ্য যে কোন শিল্পকর্ম, সাহিত্যকর্ম, সৃজনশীল কাজ যে কোন মানুশকেই ক্ষুব্ধ করতে পারে। শাকুর মজিদের লন্ডনী কইন্যা নাটক দেখে যে কেউ ক্ষুব্ধ হতে পারেন, নাটকটা তার খুবই খারাপ লাগতে পারে, এমনকি তিনি মনে করতে পারেন তার মানহানি ঘটেছে, এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সংবিধান প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা দিয়েছে, সেজনা বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল সব কিছুই করা যাবে। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষাটা তো গণতান্ত্রিক, বিধিসম্মত ও সভ্যতাসম্মত হতে হবে! নাট্যকারকে ‘কুকুর’ বলাটা কি সভ্যতার সঙ্গে মানানসই? নাট্যকারদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা কি আইনসম্মত?

কিন্তু প্রতিবাদের ভাষাটাতো গণতান্ত্রিক, , বিধিসম্মত ও সভ্যতাসম্মত হতে হবে। নাট্যকারকে ‘কুকুর’ বলাটাকি সভ্যতার সঙ্গে মানানসই ? নাট্যকারকে অবাঞ্চিত ঘোষনা করাটা  কি আইনসম্মত? অথচ সিলেট কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন বিবৃতিটা  এসেছে –  পাঠিয়েছেন ১৫ জন।  যুবক তারা বলেছেন এর প্রতিবাদ করার দরকার হলে লিখে করা হোক।

হ্যাঁ, এটাই হলো সুবিবেচনা প্রসূত কথা । কোন সৃজনশীল কাজের যারা সমালোচনা করতে চান প্রতিবাদ করতে চান তারা যেন দয়া করে তা লিখে করেন। একটা টিভি নাটকে হুমায়ূন আহমেদের এক খুনী চরিত্র বারবার নিজেকে ঘোষনা করে – সে নান্দাইলের ইউনুস। সংলাপটি এতো জনপ্রিয় হয় যে , লোকের মনে ধারনা হতে পারে যে নান্দাইল অতি কুখ্যাত জায়গা, ওখানকার লোক খুনী হয়। স্বভাবতই নান্দাইল্বাসীরা এতে দুঃখিত হয়। কারণ নান্দাইলবাসীরাতো আসলে খুনি নয়, তাঁরা নীরিহ-শান্ত ভদ্রলোক।

৩. হ্যাঁ, শোভন আরেকটা পদ্ধতি আছে প্রতিবাদের। মামলা করে দেওয়া। নাট্যকার, নির্দেশকসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করাও হয়েছে। মাননীয় বিচারক বিষয়টা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মামলার উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। এখন এখনো গৃহীত হয়নি। সংস্কৃতদের এই মাননীয় বিচারকরা সিদ্ধান্ত নেবেন বিচার হবে কিনা, বিচার হলে অভিযুক্তরা অপরাধী কিনা, অপরাধী হলে তাদের শাক্তির মাত্রা কী হবে!

৪. তবে এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সিলেটবাসীর প্রত্যেকেই নাটকটির ওপরে ক্ষেপে গেছেন। না, প্রতিক্রিয়া আসলে মিশ্র। নাটকটিতে ‘লন্ডনী কন্যা’ বিষয়ে সত্য তুলে ধরা হয়েছে, এ ধরনের অপ্রীতিকর সত্য আরো আরো তুলে ধরা হোক—এ ধরনের বিবৃতিদাতাও আছেন। বৃহত্তর সিলেট নারী পরিষদের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদিকা, সিলেট নারী অধিকার সংস্থার সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদিকা এমন সময়োপযোগী নাটক উপহার দেওয়ার জন্য নাট্যকার শাকুর মজিদকে ধন্যবাদ ও বিটিভি কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। জালালাবাদ লেখক ফোরামও লন্ডনী কইন্যার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। যারা নাটকটি নিয়ে ক্ষুব্ধ, তারা বলছেন, নাটকে যা দেখানো হয়েছে, সচরাচর তা ঘটে না, এক-দুজনের বেলায় ঘটলেও ঘটতে পারে। তবে সেটা ব্যতিক্রম।

এখানে আমার একটা কথা আছে। কথাটা হলো, ভালো নাটক বা শিল্পসাহিত্য প্রায়ই ব্যতিক্রমী ঘটনা বা চরিত্র নিয়েই রচিত হয়। এটাকে সবার বেলায় প্রযোজ্য ধরে নেওয়ার দরকার কী? ধরা যাক, রবি ঠাকুরের পোস্টমাস্টার গল্পের কথা।

একজন পোস্টমাস্টার গ্রামে পোস্টিং পেয়েছে। সেখানে রতন নামে এক গ্রাম্য বালিকা তার সেবা-শুশ্রূষা করেছে। তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট বাৎসলা আর অস্পষ্ট প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর মানে কি এই যে, পোস্টমাস্টারই গ্রামে গিয়ে গ্রামাবালিকার শুশ্রূষা গ্রহণ করে! না, তা নয়।

‘লন্ডনী কইন্যা’ নাটকটি আমি দুবার দেখেছি। আমার কিন্তু ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি যে, নাটকটিতে বলা হয়েছে, সিলেটের সবাই এমন করে। এ নাটকে সব সিলেটীকে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে, এটাও সতা নয়। দাদা বা রঞ্জুর চরিত্র তো খুবই ইতিবাচক। এই নাটক দেখে সিলেটবাসী অন্তরে বাধা পেতে পারেন, এই সন্দেহও আমার মনে উঁকি দেয়নি। শুধু আমার কেন, কারো প্রসঙ্গত একটা বইয়ের কথা মনে পড়ছে। আহমেদ ফখরুদ্দিনের লেখা ‘নান্দাইলের ইউনূস।’ একটা টিভি-নাটকে হুমায়ূন আহমেদের এক খুনি চরিত্র বারবার নিজেকে ঘোষণা করে— সে নান্দাইলের ইউনূস। সংলাপটি এত জনপ্রিয় হয় যে, লোকের মনে ধারণা হতে পারে, নান্দাইল অতি কুখ্যাত জায়গা, ওখানকার লোক খুনি হয়। স্বভাবতই নান্দাইলবাসীরা এতে দুঃখিত হন। কারণ নান্দাইলবাসীরা তো আসলে খুনি নয়, তারা নিরীহ-শান্ত ভদ্রলোক। এর প্রতিবাদ হিসেবে তারা মিটিং মিছিল করেননি, জ্বালাও-পোড়াও করেননি। আহমেদ ফখরুদ্দিন সাহেব নাটকের প্রতিবাদ করার দরকার হলে তা মনেই উঁকি দেয়নি। এর আগে সিলেটে এই নাটকের প্রেস শো হয়েছে। তখন উপস্থিত সাংবাদিকসহ দর্শকেরা নাটকটির ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। সিলেটের দুজন এমপিও নাটকটি দেখেছেন। স্থানীয় সংবাদপত্রে  কলামের পর কলাম জুড়ে সপ্রশংস রিপোর্ট বেরিয়েছে।

ঢাকাতেও ব্রিটিশ কাউন্সিলে এ আলোচনা হয়েছে। প্রদর্শনী শেষে আলোচনা হয়েছে। কই, কেউ তো আপত্তি করেননি। অথচ শাকুর মজিদ-তৌকির আহমেদদের সম্পর্কে দুঃখজনক সব উক্তি করা হচ্ছে। শাকুর মজিদ লন্ডনী কন্যা বিয়ে করতে না পেরে মনের ঝাল মেটাতে নাটক লিখেছেন, এটা অত্যন্ত আপত্তিকর উক্তি। শাকুর মজিদকে আমি চিনি। তিনি নিজেও বাংলাদেশ  প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। এখন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই আর্কিটেকচার পেশার সঙ্গে জড়িত। নিজ যোগ্যতায় তিনি দেশ- বিদেশ ঘুরে এসেছেন। তৌকির আহমেদও তাই।

এদিকে লিফলেট বেরিয়েছে, বিদেশীদের টাকা খেয়ে এই নটিক নির্মাণ করা হয়েছে। আমি শাকুর ও তৌকিরকে যতদূর জানি এবং এই নাটক রচনা থেকে নির্মাণের ইতিহাসের সঙ্গে আমার যতটা যোগাযোগ, তার ভিত্তিতে বলতে চাই, এটাও অত্যন্ত অন্যায় উক্তি। অপমানকর। এই নাটক কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ নয়। বরং আমাদের নাট্যশিল্পে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বিটিভির প্যাকেজ নাটক যখন সস্তা জনপ্রিয়তা ও বাণিজ্যিক সাফল্যের মোহে জীবনবিমুখ চাকচিকা ও অগভীর প্রেমের প্যানপ্যানানিতে দেখার অযোগ্য হয়ে উঠছিল, তখন বেশকিছু সংখ্যক অঙ্গীকৃত নাট্যকার ও নির্মাতা নাটককে বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতে এগিয়ে আসেন। শাকুর মজিদ ও তৌকির আহমেদ যে সেই কাতারেই যোগ দিয়েছেন, এ জন্য তারা অভিনন্দনযোগ্য। এবং তারা যে টিভি-নাটককে ঢাকার গণ্ডি পেরিয়ে সিলেট পর্যন্ত নিয়ে গেছেন, এ জন্য আমি তাদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই।

৫. তাই বলে আমি সিলেটের যে নাগরিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাদের বিক্ষোভকে মূল্যহীন মনে করছি না। তাদের আবেগ-অনুভূতির প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। শুধু বিক্ষোভ প্রকাশের পদ্ধতি নিয়ে আমার আপত্তি। আমি সিলেটের সেই ১৫ জন যুবকের কথারই প্রতিধ্বনি করি।

প্রসঙ্গত একটা বইয়ের কথা মনে পড়ছে। আহমেদ ফখরুদ্দিনের লেখা ‘নান্দাইলের ইউনুস’। এর প্রতিবাদ হিসাবে তাঁরা মিছিল মিটিং করেনি, জ্বালাও-পোড়াও করেনি। আহমেদ ফখরুদ্দিন সাহেব একটা বই লিখেছেন। তাদে তিনি লিখেছেন যে, আসলে নান্দাইলবাসীরা খারাপ নয়।

বিক্ষোভকারীদের নানা বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে ব্রিটিশ ভিসা পেতে অসুবিধা হতে পারে, এই আশঙ্কাও তাদের বিক্ষোভের একটা কারণ। বিশেষ করে, যারা প্রবাসী মেয়ে বিয়ে করেছেন এবং বিলাত যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন, তদের অসুবিধা হতে পারে বলে হয়তো দুশ্চিন্তা করা হচ্ছে। আমি মনে করি, এ নাটক প্রচারের জন্য ভিসা পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বরং নাটকটি প্রচারের পর অতিরিক্ত হইচই করে বিক্ষোভকারীরা নিজেরাই ভিসাদাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টা জটিল করে তুলছেন।

৬. সবশেষে আমি বলব লেখকের স্বাধীনতার কথা, শিল্পীর স্বাধীনতার কথা। লেখকের অধিকার আছে যেকোনো বিষয় নিয়ে নাটক রচনার, ফিকশন রচনার। এমনকি ফিকশনকে যে সত্য হতে হবে, বাস্তোবোচিত হতে হবে, এ দায়ও তার নেই। তিনি তার দেখা জগৎ ও জীবনকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করবেন, অন্য কারো উপদেশ-আদেশ-হুমকি লিখবেন না। সভ্যতা শিল্পীকে, লেখককে এ স্বাধীনতা বহু আগে থেকেই দিয়ে রেখেছে।

এই নাটকে সিলেটের বাস্তব প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেনি—এ কথা যদি বলা হয়, তাহলেই নাট্যকার ও নির্মাতা যথেষ্ট শরমিন্দা হবেন। এটা তাদের ক্রিয়েটিভ ব্যর্থতা। কিন্তু এ জন্য তারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে পারেন না।

আমরা জানি, বাংলাদেশে একটা গ্রাম আছে গাওদিয়া নামে। কিন্তু ওই গ্রামে যে শশী ডাক্তারকে থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। কাল্পনিক চরিত্রকে বাস্তব স্থানে শিল্পীর স্বাধীনতা, লেখকের স্বাধীনতা যেন স্থাপন করার অধিকারও লেখকের আছে। কিছুতেই ক্ষুণ্ন না হয়।

আনিসুল হক : কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

 

 

মন্তব্য
Loading...