ক্লাস সেভেন ১৯৭৮- হুমায়ূন আহমেদ

শাকুর এখন ক্লাস সেভেনে

আমার দখিন হাওয়ার বাসায় অনেক দিন ধরে একটা বই পড়ে আছে। লেখকের নাম শাকুর মজিদ। বইটির নাম – ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’।
বইটির ভুমিকা পড়লাম। মুক্তধারার চিত্তবাবুকে নিয়ে লেখা অংশটা পড়ে যথেষ্টই মজা পেলাম। নবীন কোন লেখকের লেখা পড়ার আমার কিছু নিয়ম আছে। প্রথম পড়ি লেখক নিজের সম্পর্কে কি লিখছেন। এই লেখাটা সাধারণত ফ্ল্যাপে থাকে। লেখক নিজেই অতি যতেœ লিখেন। তবে ভাব ধরেন যেন লেখা অন্য কেউ লিখেছে। একজন লেখক নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন-“তাঁর প্রতিটি রচনা কালজয়ী। তিনি টলস্টয় ঘারাণার লেখক।”
শাকুর মজিদ নিজের সম্পর্কে লিখেছেন – আচ্ছা এই অংশ থাকুক। পাঠক পড়ে নেবেন।
ফ্ল্যাপের লেখা পড়ার পর, আমি যাই উৎসর্গ পত্রে। তারপর ভূমিকায়।

হুমায়ূন আহমেদের হাতে লেখা মূল কপি

মূললেখা এক সিটিং এ প্রথম দশ পাতা পড়ি। যদি ভাল লেগে যায় তবেই পুরোটা পড়া হয়। শাকুরের বইয়ের পঞ্চম লাইনটি পড়ে আমি বুঝলাম লেখাটা ভাল হবে। পঞ্চম লাইনে লেখা – “অফিসে ইত্তেফাক পত্রিকা এলেই আমি শফিক স্যারকে জিজ্ঞেস করতাম, স্যার আমার রিজাল্ট বারইছেনি?” ’বারইছেনি’ খাঁটি সিলেটি শব্দ। সিলেটবাসীরা নিজেদের কথ্য ভাষা নিয়ে সামান্য সংকুচিত থাকেন। শাকুর সরাসরি এই ভাষা ব্যবহার করছে। তারচেয়েও বড় কথা, মূল গদ্যে হঠাৎ হঠাৎ সিলেটি ভাষা ঢুকিয়ে তিনি গদ্য ধারায় ঢেউ এর মত তৈরী করেছেন। এই কাজ তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে করেছেন না-কি অজান্তে করেছেন তা আমি জানি না। যে ভাবেই থাকুন এতে তাঁর গদ্য স্বাদু হয়েছে। বাংলা ভাষার কিছু বড় লেখক এ ধরনের পরীক্ষা অতীতে করেছেন। চলতি ভাষার লেখা গদ্যে হঠাৎ হঠাৎ তৎসম শব্দ ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যেমন – “তখন রাত্রি হয়েছে।”

বইটিতে শাকুর তার কথা আন্তরিক ভঙ্গিতে বলেছে। সে সহজিয়া ভঙ্গিতে তার স্বপ্ন এবং স্বপ্ন ভঙ্গের কথা, আনন্দ এবং বেদনার কথা লিখে গেছে। আমি তার চোখে পাবলিক স্কুলের ছবি দেখতে পেয়েছি। খেলার মাঠ, দুরের পাহাড়। অন্যকে নিজের দেখা ছবি গল্পের মাধ্যমে দেখানো সহজ কর্ম না।
পাবলিক স্কুল নিয়ে বিদেশী কিছু পড়েছি। ছবি দেখেছি। বাংলা সাহিত্যে জরাসন্ধের একটা লেখা আছে – পাবলিক স্কুল ঠিক না, বরস্ট্যাল স্কুল। দুষ্টু এবং অপরাধী ছেলেদের জেলখানা টাইপ স্কুলের কাহিনী। শাকুর মজিদ সম্ভবত প্রথম ক্যাডেট কলেজের গল্প শুনাতে এসেছে। এবং ভাল শুনিয়েছে।
কেউ যদি আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, বইটির কোন দিকটা আমার সবচে ভাল লেগেছে – আমি বলব, লেখকের সাবলাইম হিউমার।

গদ্য লেখক হিসেবে আমি জানি, গদ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা কত কঠিন। এই কাজটি লেখক করতে পেরেছেন। গদ্যের কাঠিন ভূমিতে তাঁকে জানাচ্ছি সুস্বাগতম।
পরম করুনাময়ের করুনা তার উপর বর্ষিত হোক এই তার প্রতি আমার শুভ কামনা।*

*পুনশ্চ।
একটা কথা বলতে ভূলে গেছি। শাকুর মজিদ ক্যাডেট কলেজ থেকে অসাধারণ রেজাল্ট করে ঝঝঈ এবং ঐঝঈ পাশ করেছিল। মূল বইতে এই সাফল্যের কথা সে একবারও উলে­খ করেনি। এই সংযম সে দেখাতে পেরেছে এটাও অনেক বড় ব্যাপার।

২০০৮ সালের মে মাসে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত
মন্তব্য
Loading...