হুমায়ূননামা ট্রিলজি- মাহফুজুর রহমান সজীব

হুমায়ূননামা

ট্রিলজি
___________
হুমায়ূননামা ঠিকাছে, কিন্তু ট্রিলজি কেন!
শাকুর মজিদ হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আগে লিখেছিলেন:
১.হুমায়ূন আহমেদ, যে ছিল এক মুগ্ধকর
২. নুহাশপল্লীর এইসব দিনরাত্রি
৩. অভিনেতা হুমায়ূন ও অন্যান্য
এই তিনটি বই ই একসাথে মিলে হুমায়ূননামা। ট্রিলজি; ৩ টা বই একই মলাটে।
বই ১ ও বই ২ স্বতন্ত্র। বই ৩ এ রিপিটেসনই বেশি কারণ বই ৩ আসলে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্রিকায় শাকুর মজিদ এর লেখা খণ্ড খণ্ড ঘটনার সংকলন।
১ ও ২ পড়ার পর ৩ পড়ার উৎসাহ হবে না। ১ আর ২ তে ৩ এর বেশিরভাগেরই বিস্তারিত বর্ণনা আছে। সুতরাং ট্রিলজি থেকে ১ ও ২ নিয়ে কিছুটা বলা এখানে।
_____
ভালো লেগেছে। অনেকদিন পর টানা ২ দিন যতটুকু নিজের সময় পেয়েছি ততটুকুতে বইটা টেনেছে, পড়ে ফেলেছি। লেখকের পরিমিতি বোধটা আমি খেয়াল করে দেখলাম। মূলতঃ এই কারণে বেশি ভালো লেগেছে বইটি৷ সোজা বাংলায় বললে মাখামাখি নেই এখানে।
লেখক নিজেই বইয়ের শুরুতে ৩ টা পয়েন্ট বলে রাখেন। যেটা পড়েই বুঝতে পারি কেমন হবে বইটা। হুমায়ূন আহমেদের লেখার সাথে প্রথম পরিচয় থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ৩২ বছরের পরিচয় লেখকের। এতে তিনটা পর্যায় আছে। লেখকই বলেন,
১. “একসময় তিনি আমার কাছে ছিলেন দূর আকাশের তারার মতো,”
২ “তারপর এই মর্ত্য-চরাচরে আমার সামনে বিচরণ করা আর দশজন মানুষের একজন।”
৩. “শেষে আমার গায়ের সাথে গা লাগিয়ে, পায়ে পায়ে হেঁটে যাওয়া কোনো এক সহযাত্রী।”
লেখক আরও বলেন,
“এই তিন স্তরে আমি তাঁকে যে সময় যেভাবে দেখেছি, সেভাবেই সে সময়ের কথা লিখেছি।”
এবং আসলেই! তাই পড়ে দেখলাম! লেখক প্রথম হুমায়ূন আহমেদের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়েনে ১৯৮০ সালে যখন ক্লাস নাইনে পড়েন। বিমুগ্ধ হন, ঘোরগ্রস্থও।
১৯৮৬ সালে জীবনের প্রথম সাক্ষাৎকার নেন হুমায়ূন আহমেদেরই, সেদিন প্রথম দেখেন তাঁকে। এরপর ছাড়া ছাড়া কয়েকবার কাছে থেকে, দূর থেকে দেখে যান। সেই ১৯৮০ সালের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ থেকে আর বের হন নাই। তাই বলে হুমায়ূন আহমেদের পাই টু পাই সব লেখা, সিনেমাতে গলে গলে ছিলেন লেখক তাও না। সমালোচনার জায়গাটাও প্রচুর বাট সেটুকুও পরিমিত বয়ানে।
২০০৮ সালে মূলতঃ লেখক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন হুমায়ূন আহমেদ এর সাথে ঘরের মানুষের মতন। এই সময় থেকে দেয়া বর্ণনায় স্পষ্ট দেখা যায়, সুন্দরবন ভ্রমণ, দখিন হাওয়া ফ্ল্যাট, নুহাশপল্লী।
ইন্টারেস্টিংলি পাঠক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে জানার নতুন করে তেমন আগ্রহ না থাকলেও এই বইটা টানটান পড়ে গেছি। পাঠককে কমফোর্টজোনে রাখতে লেখক ছোট ছোট অধ্যায় করে লিখেছেন।
আমি ভাবি, এত আড্ডা কেন দিতেন হুমায়ূন আহমেদ? ভুলে থাকতে চাইতেন ভীষণ কিছু? কী জানি!
তবে দারুণ লেগেছে আমার বইয়ের শুরুর দিকেই যখন হুমায়ূন আহমেদ দূরবর্তী তারা লেখকের কাছে। ক্যাডেট কলেজের নিয়মের দেয়ালে ঠেশে থাকা এক কিশোর পাঠক আচ্ছন্ন হয়ে গেছেন তখন ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এ। এর পাশাপাশি সেই সময়ের হুমায়ূন আহমেদের যাপন কিছুটা টের পাওয়া যায়। সেই সময়ের ঢাকা শহরকেও অনুভব করতে পারা যায়।
১৯৮৬ সালে লেখকের প্রথম সাক্ষাৎকারের সময়ে, লেখক হুমায়ূন আহমেদকে জানান যে তাঁর হোস্টেলের একজন তরুণ ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ১৮ বার পড়েছে। তো সাক্ষাৎকার শেষে লেখককে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর তখন প্রকাশিত উপন্যাস ‘প্রথম প্রহর’ এর দু’টি কপি দেন। একটি লেখকের জন্য। অপরটি আগেরবার সাক্ষাৎকার নিতে আসার সময় লেখকের সাথে থাকা লেখকের একজন বন্ধু ছিলো; তাঁর জন্য।
এরপর হুমায়ূন আহমেদ আরেকজন মুগ্ধ তরুণ পাঠক যিনি কিনা লেখকের হোস্টেলেই থাকেন তাঁর জন্য ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এর ১ কপি নিয়ে আসেন। জানতে চান সেই মুগ্ধ পাঠকের নাম। লেখক বলেন, “স্যার, নাম লিখতে হবে না, শুধু সই করে দিলেই হবে।”
হুমায়ূন আহমেদ তখন বইতে লেখা থামিয়ে লেখকের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, “আপনার নাম কী?” লেখক; যিনি তখন সাক্ষাৎকার নেয়ার দায়িত্বে; বলেন, “শাকুর মজিদ।” হুমায়ূন আহমেদ তখন শঙ্খনীল কারাগার’ বইতে লিখে দিলেন, ‘শাকুর মজিদ, আমার বইয়ের মুগ্ধ,পাঠক।”
এই জায়গায় এসে আমি কেন জানি বইটা এক ঝটকায় বন্ধ করে ফেলি। কেমন সূক্ষ্ম এক বিমূঢ় বোধ চলে আসে আমার ভেতরে। আর চোখে পানি চলে আসতে চায়। সংবরণ করি খানিক বিমূঢ়তায় নিজেকে। আমাকে পাঠক হিসেবে সবচেয়ে নক করে এই জায়গাটা। এটা আমার ভেতরে গেঁথে থাকবে।
লেখকের বয়স তখন ২১; যখন ১ম সাক্ষাৎকারটি নিতে যান হুমায়ূন আহমেদের। সেই বয়সে হুমায়ূন আহমেদকে দেখার মুগ্ধতা চাপিয়ে প্রকাশও করতে পারছিলেন না এই তরুণ গুমোট মেঘে থেকেও যে, কতটা মুগ্ধ তাঁর শঙ্খনীল কারাগারে তিনি!
এই যে বইয়ের সাথে পাঠকের এক যাপন হয়ে যায়। এই যে একটা প্রকাশ্য বা দূর থেকেই অদৃশ্য সম্পর্ক হয়ে যায় লেখার সেতুতে পাঠকে লেখকে তা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। জাস্ট লিখেও একজন মানুষের সমুদয় মনে জায়গা করে ফেলা যায়!
৭ ডিসেম্বর ২০২১, লেখকের ফেইসবুক ওয়ালে প্রকাশিত
______
মন্তব্য
Loading...