প্রথম আকাশে ওড়া
নীল স্যুটকেস - দ্বিতীয় অধ্যায়
জুন, ১৯৮৪
চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে সিলেটের বিয়ানীবাজারে আমাদের মাথিউরা গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি মাত্র এক সপ্তাহ আগে। বাড়ি আসার আগে শখ করে ঢাকা দেখতে চাইলাম। আগে কোনো দিন ঢাকা যাওয়া হয়নি। শহর বলতে চিনি সিলেটের সুরমা গাঙ্গের এইপার, যেদিকে রেল স্টেশন আর চট্টগ্রাম। ঢাকা রাজধানী শহর। না জানি কতো কিছু আছে সেখানে। দেশে থেকে বাদ বাকি পড়াশোনা করলে তো ঢাকাতেই করতে হবে! সুতরাং শহরটা চেনা দরকার।
ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরোলাম মে মাসে। জুন মাসের মাঝামাঝি পযর্ন্ত ঢাকায় থাকলাম রায়হানের বাসায়। ঢাকা দেখলাম, আইএসএসবি পরীক্ষা দিলাম। মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম আবার ঢাকায় আসতে হবে। বুয়েটে বা মেডিক্যালে পড়তে হলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে এখানে।
ঢাকায় আমার দুই আত্মীয় আছেন। একজন নানা, তিনি মায়ের চাচা, থাকেন মীরপুরে। আমি তাঁর ঠিকানা জানিনা। আরেকজন দাদা, তিনি বাবার চাচা, থাকেন মহাখালী। ঠিকানা জানিনা। সুতরাং কারো সঙ্গেই আমার কোন যোগাযোগ থাকেনা। আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই, সিনেমা দেখি আর বুয়েট-মেডিক্যালে ভর্তির খোঁজ খবর নেই। দিন পনেরো থাকার পর আমি বাড়ি চলে যাই।
এক বিকেলে আমার বড় চাচা আমাকে ডাকেন। দেখি পুকুর পাড়ে তিনি দাঁড়িয়ে, হাতে একটা চিঠি। আমাকে দেখে বলেন, ঢাকা থেকে একটা চিঠি এসেছে। চিঠি লিখেছেন মতছিন (ভালো নাম- হাজী মুতাছীম আলী) দাদা।
বড় চাচার চোখে কিছু সমস্যা। ভাল করে লেখা পড়তে পারেন না। তার চোখে চশমাও নেই। তিনি লেখাটির মর্মার্থ খুব ভালো বুঝতে পারছেন না। খামের ভেতর থেকে চিঠির কাগজ বের করে চিঠি পড়তে পড়তে আমাকে বলেন, তোর বাফ এখন ঢাকাত। মতছিনচা’য় লেখছইন।
বলেন কি ! আমি অবাক।
মাসখানেক আগেই আম্মার কাছে চিঠি এসেছে। লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনী থেকে। জাহাজ যাবে মাল্টায়। কিন্তু এখন ঢাকায় কেন?
আমি হাত থেকে চিঠি নেই। মতছিন দাদা খুব ছোট ছোট হাতে লিখেন। তার হাতের লেখা ভালো করে পড়া যায়না। চিঠি লিখেছেন আং হেকিমকে উদ্দেশ্য করে, যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে- আং মজিদ একটু অসুস্থ। জাহাজ থেকে ডাক্তার সঙ্গে করে তাকে ঢাকায় এনেছে। এখন তাঁর বাসায় আছেন। আমাকে যেন পাঠানো হয়। সঙ্গে তাঁর বাসার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার।
আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে ফোন নাম্বার টুকে নিলাম। এলাম ঘরে, ঠিক করলাম এখনি বিয়ানী বাজার গিয়ে ফোন করতে হবে বাবাকে। কিন্তু কী কারণে বিয়ানী বাজার যাবো এটা ঘরের কাউকে জানানো যাবেনা।
মা যদি জিজ্ঞেস করেন? মাকে সে সুযোগ দেওয়া যাবেনা। আমার কাছে ৫শত টাকা আছে। সুতরাং টাকার সমস্যা নাই। আমি পলিথিনের ব্যাগের মধ্যে একটা জিন্সের প্যান্ট ভরে লুঙ্গি পরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম।
হেটে হেটে ৩ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যা সাতটার দিকে পৌঁছালাম নিউমার্কেটের টিএন্ডটি অফিসে। এর আগে এখান থেকে লন্ডনে ফোন করেছি আমি। ঢাকায়ও করেছি। কিন্তু সময় লাগে অনেক। অপারেটরকে নাম্বার দিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। একসময় হ্যালো আলফা-বিটা-চার্লি-ডেলটা…টাইপের নানা কথা বলার পর লাইন পায়। এই লাইনের সংযোগ দেয়া হয় অন্য টেলিফোনে। সেখান থেকে কথা।
কিন্তু আজ আমার কপাল খারাপ। বৃষ্টির কারনে লাইন যাচ্ছেনা। চারখাই পযর্ন্ত সংযোগ আছে। তারপর নেই। অনেক কষ্টে ভৈরব পর্যন্ত লাইন পেলো কিন্তু ঢাকা পাওয়া গেলোনা। আমি বৃষ্টির মধ্যে কাদামাখা পথ পেরিয়ে ছাতা মাথায় নিয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফেরত এলাম। বাড়ির কেউ কিছু জানেনা। পরদিন ফোন করার জন্য যেতে হবে সিলেট। আমার পকেটে সেই পাচশ’ টাকার নোট।
তখন বর্ষা কাল। গয়না নৌকা দিয়ে ঢাকাদক্ষিন বাজার পযর্ন্ত গিয়ে বেবিট্যাক্সিতে গোলাপগঞ্জ। সেখান থেকে সিলেটের বাস পাওয়া গেলো। ভোর সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, সিলেট পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা প্রায় একটা। ফোন করার জন্য গেলাম টেলিফোন অফিস। সেখানে লম্বা সিরিয়াল, অনেক সময় লাগবে। টিএন্ডটি থেকে ফোন করতে পারলে খরচ কম। ঢাকায় ট্রাংক কল করা যায়, বারো টাকা মিনিট। একজন পরামর্শ দিলো পাশে গুলশান হোটেল আছে। তাদের ফোন থেকে ডাইরেক্ট কথা বলা যায়। সময় কম লাগে। কিন্তু রেট একটু বেশি। বিশ টাকা মিনিট। আমি হেঁটে হেঁটে গুলশান হোটেলের কাউন্টারে যাই। রিসিপশনে তালা দেয়া ফোন নিয়ে বসে আছেন ম্যানেজার। আমি তাকে ফোন নাম্বার দেই। তিনি ফোনের তালা খুলে ডায়াল করেন এবং এক ডায়ালেই আমি পেয়ে যাই মতছিন দাদাকে। তিনি ডেকে আনেন বাবাকে। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলি।
বাবার স্বরটা আমার কাছে একটু অন্যরকম লাগে। কথার মাঝখানেও শুনি তিনি কাশছেন, গলার আওয়াজ ভাঙ্গা। আমি জিজ্ঞেস করি – কিতা অইছে আফনার?
বাবা ধীরে ধীরে বলেন- বুকে সামান্য একটা টিউমার হয়েছে তাঁর , সেঁক দিলে কমে যাবে। এ জন্য কয়দিন থাকতে হবে ঢাকায়। জানতে চান, আমি কি ঢাকায় আসতে পারবো ?
আমি বলি যে- আমি আজ আসবো ঢাকায়। রাতের বাসে।
বাবা জিজ্ঞেস করেন, আমার কাছে টাকা আছে কিনা।
আমি বলি, আছে পাঁচশ টাকা।
বাবা বলেন, সাড়ে চারটায় একটা ফ্লাইট আছে সিলেট থেকে। দেখো টিকেট পাও কিনা। পেলে প্লেনে চলে আসো।
আমি এর আগে কখনো প্লেনে চড়িনি। ট্রেন আমার প্রধান বাহন। চট্টগ্রাম যাই সেকেন্ড ক্লাসে, ভাড়া ১৩ টাকা। ঢাকার ভাড়া কত হবে জানিনা। ঢাকা কখনো ট্রেনে যাইনি। শুনেছি নতুন একটা বাস এসেছে সিলেটে, নাম- মিতালী পরিবহন। খুব আধুনিক। রাস্তায় লোক ওঠায় না। যদিও ৫টা ফেরি পার হতে হয় ঢাকা যাওয়ার জন্য কিন্তু আরাম অনেক। ট্রেনের চেয়ে ভাড়া বেশী, ৬০ টাকা ভাড়া। কিন্তু এখন এটাতেই সবাই যায়। আমি ভেবেছিলাম রাত ৯টায় মিতালী পরিবহনের যে বাস ছাড়বে কদমতলী থেকে সেই বাসে করে চলে যাবো ঢাকা। কিন্তু হলোনা। কিন্তু প্লেনেট টিকিট কাটতে হয় কোন কাউন্টার থেকে আমি তো জানি না ।
আমাকে সাহায্য করেন হোটেলের ম্যানেজার। বলেন, বিমানের টিকেট কাটতে হয় বিমান অফিস থেকে। কিন্তু এখন বিমান অফিসে টিকেট বিক্রি করবে না। আমি যদি সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যাই, এবং ‘চান্স’ এ যদি টিকেট পেয়ে যাই, তবে দুইশ’ পঁচিশ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে চলে যেতে পারবো। ৩৫ মিনিটে ঢাকা। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, রিস্ক নেব। আবার ২০ টাকা খরচ করে আরো এক মিনিট কথা বলি ঢাকায়। জানাই, আমি এয়ারপোর্ট যাচ্ছি, প্লেনে টিকিট পেলে সাড়ে ৪ টার ফ্লাইটে আসবো, না পেলে রাতে।
বিমান অফিসে আমি প্লেনের টিকেট পেয়ে যাই আর দুরুদুরু বুকে প্লেনের ভেতর প্রবেশ করি।
বাবাকে নিয়ে একদিকে এক অজানা আশংকা, অন্যদিকে আকাশের উপর পাখির বুকের ভেতর লুকিয়ে ওড়ার মত রোমাঞ্চ -আমাকে বিহ্বল করে ফেলে। এই আমার প্রথম বিমান চড়া। এই আমার আকাশ পথে ওড়াওড়ির সূচনা।
প্লেন নামলে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই দেখি বাবা আর মতছিন দাদা দাড়িয়ে। আমাকে বলেন – তোর ব্যাগ কোথায়?
আমি বলি যে ব্যাগ নিয়ে আসিনি। আমি সিলেট আসার জন্য বাড়ি থেকে এসেছিলাম। ফোনে কথা বলে ঢাকা এলাম।
বাবা চিন্তিত হয়ে পড়লেন আমাকে নিয়ে। বাড়িতে কী করে খবর দেয়া যায় যে আমি ঢাকা এসেছি? মতছিন দাদা বলেন, তিনি বিয়ানী বাজারে রড সিমেন্টের এক পরিচিত দোকানদারকে ফোন করে বলে দেবেন। সেই লোক তার কোনো কর্মচারীকে বাড়ি পাঠিয়ে জানাবে।
(আত্মজৈবনিক ধারাবাহিক উপাখ্যান – ‘নীল স্যুটকেস’ থেকে )