আমিরাত ১৯৯৭
গ্রন্থিত পুস্তকের ডিজিটাল সংস্করণ
আমি যে গান গেয়েছিলাম – সে জন্য এই পোর্টাল
আমার ভ্রমণকাহিনী লেখার একটা ইতিহাস আছে। এর সূচনা হয়েছিল ‘আমিরাতে তেরোরাত’ দিয়ে, ২০০৩ সালে।
তারও একটা কাহিনী আছে। সেটা হচ্ছে- ১৯৯৭ সালে কেবল ছবি তোলার ধান্ধা নিয়ে, দুইটা স্টিল ক্যামেরা কাঁধে করে ১৪ দিনের টুরিস্ট ভিসা নিয়ে গিয়েছিলাম আরব আমিরাতে । এক ক্যামেরায় রঙিন ফিল্ম, আরেক ক্যামেরায় স্লাইড বা সাদাকালো ফিল্ম। এই ছিলো আয়োজন। যা দেখবো তার ছবি তুলবো। ট্রান্সপারেন্সিতে ছবি তুললে কেলেন্ডারের জন্য ছবি বেচা যায়, এটাও ছিলো ধান্ধা। কেউ কেউ তখন আমার কাছ থেকে ছবি নিয়ে ক্যালেন্ডার ছাপে, আমাকে টাকাও দে (যেমন আবিদ এ আজাদ)।
দেশে ফেরত এসে ছোট্ট একটা পোর্টেবল স্লাইড প্রজেক্টর নিয়ে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে স্লাইড শো করে দেখাতাম (স্বাক্ষী- আজিজুল পারভেজ)।
এ সময় বেক্সিমকো থেকে একটা সুন্দর সাহিত্যপত্রিকা বেরুতো, ট্যাবলয়েডে, সম্পূর্ণ রঙীন। এটা দেখতেন আবু হাসান শাহরিয়ার। তাঁর কাছে এই ছবিগুলো নিয়ে একদিন দেখালাম। তিনি এখান থেকে একটা ফটোস্টোরি করে দিতে বলেন। আমি লিখলাম এক বেদুইনের ঘরবাড়ি ছেড়ে এসে পাহাড়ের তলায় তাবু টাঙিয়ে বসবাস করার গল্প। তিনি বড় বড় ছবি দিয়ে দুই পাতায় এই স্টোরি ছাপেন।
এরপর একদিন ইকবাল করিম নিশান তাঁর সম্পাদিত একটা মাসিক পত্রিকার ঈদসংখ্যার জন্য আমার কাছে লেখা চাইলো। সে ক্যাটাগরিকেলি আমার আমিরাত সফরের জন্য লিখতে বলে। আমি শুরু করি আমিরাতে তেরো রাত কাটানোর গল্প। ৬-৭ রাতের কাহিনী লেখার পর দেখি ঈদসংখ্যার জন্য যত শব্দসংখ্যা বলা হয়েছিল তা হয়ে গেছে। কিন্তু দেখি এ পর্যন্ত আমিরাতের শুধু আল-আইন শহরের কাহিনী আমার লেখা হয়েছে। বাকী আছে আবুধাবী, দুবাই, শারজাহ, রাস-আল খাইমাহ, ফুজিয়ারাহ বেড়ানোর গল্প। কিন্ত এটা আমার আর লেখা হয় না।
আমি লেখার কথা ভুলে গিয়ে ছবিগুলো নিয়ে মেতে উঠি। এর মধ্যে আমার ৩ টা দেশ সফর হয়ে গেছে। ভারতের একটা অংশ, নেপালের দুইটা শহর আর আরব আমিরাত। তিন দেশের ছবির ভাণ্ডার আমার হাতে। তিন দেশের ভূমিরূপ আলাদা, মানুষের ধর্ম আলাদা, জলবায়ূ আলাদা, ইতিহাস-ঐতিহ্য আলাদা। সুতরাং এই আলাদা উপকরণগুলোর কারনে কেনো মানুষের ঘরবাড়ি আর দালানকোটা আলাদা হলো, পোষাকপরিচ্ছদ কেনো আলাদা হলো তার একটা তুলনামূলক চিত্রবিচার করার জন্য আমি ‘ট্র্যাভেলারস ক্লিক্স’ নাম দিয়ে একটা ফটো এক্সিবিশন করি আলিয়াস ফ্রাসেসে, দুই সপ্তাহ ধরে। এটা উদ্ভোধন করেন জাতীয় সংসদের স্পীকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী।
তখন কেবল বিটিভি। এটা ভালো প্রচার পায়। আমার অনুরাগিদের আগ্রহে এই প্রদর্শণীটি সিলেট সুলেমান হলে এবং বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক মিলনায়তনে ৭+৩ দিন ধরে হয়।
কাহিনী এখানে শেষ হয় না। এর মধ্যে ঢাকা অভিবাসিত হয় আমার খালাতো ভাই মোস্তফা সেলিম। সে বই ছাপার ব্যবসা শুরু করবে। শুরু করেছে সিলেটের একটি দুস্প্রাপ্য পুরনো বই মুদ্রণ দিয়ে। তার কিছু নতুন বইও লাগবে। আমাকে একদিন বলে, ভাইয়া, আমারে একটা বই দাও। আমি ছাফমু। আমি বলি আমার কাছে আরব আমিরাত নিয়ে কিছু লেখা আছে। সে বলে – এইটাই দেন।
২০০৩ সালের বইমেলায় ছোট ছোট সাদা কালো কিছু ছবি দিয়ে আমার বই বেরুলো, নাম দিলাম ‘আমিরাতে তেরোরাত’ । সাইজে বেশ ছোট। ৫ ফর্মার মতো আকার। এটা ভ্রমণ কাহিনী ক্যাটাগরিতে ক্যাটালগে এলো। এই হচ্ছে আমার প্রথম ভ্রমণগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাস।
২০০১ সাল থেকে আমার ভ্রমণসঙ্গী হিসাবে স্টিল ক্যামেরার সাথে যুক্ত হলো একটা নতুন ডিভি ক্যামেরা। আমি স্টিল থুয়ে ভিডিও করি। আমেরিকার ৮ রাজ্য ঘুরে ২২ ঘন্টার ফুটেজ নিয়ে আসি। দেশে ফিরেই প্রামাণ্যচিত্র বানাই- ‘স্বপ্নের দেশে স্বপ্নভঙ্গের দেশে’। আমার আকর্ষণ ভ্রমণের বই লেখার চেয়ে ভ্রমণচিত্র বানানোর। কিন্তু এই ডকুমেন্টারির জন্য স্ক্রিপ্ট লিখতে লিখতে দেখি অনেক পাতা জমা হয়ে গেছে।
সেলিম আবার ফোন দে। ভাইয়া, আপনার আগের বই শেষ, রিপ্রিন্ট করবো। নতুন বই দেন।
আমি তাঁকে দিলাম আমেরিকা নিয়ে লেখা বই- ‘কাছের মানুষ দূরের মানুষ’ ।২০০৩ সাল থেকে পঞ্চপর্যটকের সাথে বিশ্বভ্রমণ শুরু হয়। আমি আছি, আমার ক্যামেরা নিয়ে। আমি বানাতে থাকি ‘পৃথিবীর পথে পথে’ (প্রথম পেট্রন- খ ম হারুন), ইতিহাসের শহর, দূরে কোথাও, দূর দূরান্তে, ভূবণ ভ্রমিয়া শেষে, মসজিদের ইতিকথা, ইসলামের দুনিয়া এসব নামে আরটিভি, বিটিভি, মাছরাঙ্গা, বৈশাখী, চ্যানেল আই এর জন্য। এ নিয়ে সাড়ে তিনশো পর্বের মতো প্রচার হয়েছে আর এইসব স্ক্রিপ্টের বাই প্রডাক্ট হিসাবে এসেছে ২২ টি ভ্রমণগ্রন্থ এবং আরো কিছু পুরস্কারও।
আমার প্রথম ৮টি ভ্রমণগ্রন্থের অধিকাংশের প্রকাশক উৎস প্রকাশন। ২০১১ সালে এই ৮ টি এক মলাটে নিয়ে ‘অষ্টভ্রমণ’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ হয়। সে সংকলনে বইয়ের ক্রম অনুসরন করতে আমি রিভার্স অর্ডারে করার জন্য চাপাচাপি করি প্রকাশককে। আমি জানি আমার প্রথম বইটি অনেক দুর্বল লেখা। নিজে পড়লে নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। এজন্য প্রকাশককে বলি, প্রথম বই শেষে, আর শেষ বই সবার আগে, এই ভাবে দিয়ে দে। সে সেভাবেই দে।
‘আমিরাতে তেরোরাত’ সেখানে দ্বিতীয়বার প্রকাশ হয়। আরো কিছু ছবি, সাদাকালোই, তবে একটু বড় সাইজে এই আর কী।
২০১৬ সালে আমার সাথে পরিচয় হয় কথা প্রকাশের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিনের সাথে। তিনি আমার একটি ভ্রমণগ্রন্থ প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমার কাছে মনে হলো এই প্রকাশককে মুরগী বানাতে পারলে আমার লাভ আছে। আমি ইনিয়ে বিনিয়ে তাঁকে বলি- ভাই, আমার ভ্রমণের বই ১৭টি, তারমধ্যে ১০/১২টি বাজারে নাই। আর যা আছে তা আমার পছন্দও না। সব সাদাকালো। আমি ফটোগ্রাফার মানুষ। লিখিও। আমি চাই আমার বইগুলো হবে অর্ধেক লেখা অর্ধেক ছবি, পুরো রঙিন, আর বইয়ের আকার একটু বড়, রয়েল সাইজে, পুরো ১৭ টা বই যদি ৪ খন্ডে যদি আপনি বের করেন, আমার বইগুলো যত্নে সংরক্ষিত থাকবে। তিনি আমাকে বলেন, আপনি আমাকে এক দিন সময় দেন। আমি আপনাকে কাল জানাই।
পরদিন তিনি ফোন করে বলেন, আপনার ১৭ টা বইয়ের ওয়ার্ড ফাইল আমাকে মেইল করেন। আমি এগুলো আমাদের সম্পাদকের কাছে পাঠাবো।
২০১৭ সালে আমার ৫২তম জন্মদিনের উপহার হিসাবে একটা বড় অনুষ্ঠান করে কথাপ্রকাশ (অনুষ্ঠানের পুরা খরচ, ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা দিয়েছেন জসিম উদ্দিন)। ৪ খন্ডে ছাপা হয় ভ্রমণসমগ্র ১, ২, ৩, ৪। সেখানে প্রথম খন্ডের প্রথম বই ‘আমিরাতে তেরোরাত’। অনেকগুলো ছবি বড় করে ছাপা হয় সেখানে, সম্পূর্ণ রঙিন।
কিন্তু সব ছবি তো বইতে দেয়া যায় না। আর আল আইন ছাড়া অন্য শহরের গল্প যেহেতু বইতে নাই তাই অন্য শহরগুলো (যেমন দুবাই, আবুদাবি, শারজাহ)র ছবিও নাই।
এখন মওকা পেয়েছি। আমাকে এই মওকা তৈরি করে দিয়েছেন প্রিন্স আহমেদ। আমার অফুরন্ত অবসরের সময়টা আমি এইসব আর্কাইভিং এর কাজে লাগাই। তাঁর তৈরি করে দেয়া ফরমেটে আমি মনের মাধুরি মিশিয়ে সবগুলো বই একে একে এই ডিজিট্যাল ফরমেটে আপলোড দেয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছি।
এটি গ্রন্থাকারে যখন বেরোয় তার নাম ছিলো ‘আমিরাতে তেরোরাত’। এখানে আমি নাম বদলে দিলাম। নতুন নাম রাখলাম ‘আমিরাত ১৯৯৭’। কারন ১৯৯৭ সালের ৪ থেকে ১৭ মে পর্যন্ত যে আমিরাতকে আমি দেখেছি, আর আমার ক্যামেরায় স্থির করে রেখেছি এই কালটা আর কখনো ফেরত আসবে না।
১৯৯৭ সালের পর আরো তিনবার আমি আমিরাতে গিয়েছি, ছবি তুলেছি, ২ পর্বের প্রামান্যচিত্রও বানিয়েছি। সে গল্প, সে ছবি এখানে আনি নাই। এই দলিলটা সে সময়ের জন্যই রেখে দিলাম।
এই সময়ের মধ্যে জায়গার বদল হয়েছে অনেক, দালানের পরিবর্তন হয়েছে। যাদেরকে পেয়েছিলাম তাঁদের অন্তত তিন জন মারা গেছেন, বাকিরা সবাই সে দেশ ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি যে একদিন তাঁদের মধ্যে থেকে গান গেয়েছিলাম, সেই কথাটি মনে রাখার জন্য আমার এই সচিত্র ভ্রমণ পোর্টাল।
বাড়ি ছাড়ার আগে
দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে বেরুতেই ছানু বললো, ‘এখন তোমার কেমন লাগছে বলো।’
বললাম, ‘সত্যি বলছি, বিশ্বাস হচ্ছে না আমি এখন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে।’ আমার খুব উত্তেজনা বোধ হতে লাগলো। বলতে গেলে এই প্রথম দেশের বাইরে বেড়াতে আসা। এর আগে অবশ্য নব্বই সালে কলকাতা গিয়েছিলাম দলবলের সাথে। কলকাতার তিনশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘আর্কিটেকচার অব দ্য সিটিজ’ শিরোনামে যে আন্তর্জাতিক স্থাপত্য সম্মেলন হয়েছিলো তাতে বাংলাদেশের ছাত্র প্রতিনিধি দলের সাথে সাতদিনের জন্যে কলকাতা যাওয়া হয়েছিলো। তাও আবার বাইরোডে। সড়কপথে বিদেশ যাওয়া এবং ভারতের কেবল কলকাতার মতো জায়গায়। সে জন্যে সেটাকে ঠিক বিদেশ সফর বলে মনে হয়নি। তাও বেনাপোল দিয়ে যখন দেশের ভেতর এসে পৌঁছেছিলাম, খুব প্রশান্তি লেগেছিলো। মনে মনে বলেও ছিলাম এই জনমে আর বিদেশ না। খাই না খাই দেশের মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবো, ভাত খেতে না পেলে দূর্বা ঘাস খাবো, তবু পয়সা কামাই করার জন্যে বিদেশ যাবো না।
‘তাই বলে বেড়াতেও না? একবার এসে দেখে যাও না আমরা কোথায় আছি, কেমন আছি।’
ছানু এসব কথা চিঠিতে প্রায়ই লিখতো।

ছানুর সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় কুড়ি বছর ধরে। বয়সে সে আমার ২-৩ বছরের বড় হবে, স্কুলে সে আমার চেয়ে মাত্র এক ক্লাস উঁচুতে ছিলো। কবে কীভাবে কোন ঘটনায় তার সাথে আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়ে যায় এটা আমার আর মনে নেই। ১৯৭৮ সালে যখন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়ে চলে যাই, তখন থেকেই আমাদের সামনাসামনি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর দু বছর পর সে যখন আমিরাতের আল-আইন শহরে বড় ভাইয়ের সুগন্ধি ব্যবসায় যোগ দেয়, তখন এই ব্যবধান আরো বাড়ে, কিন্তু যোগাযোগ থেমে থাকেনি। এর মধ্যে আরব সাগরে অনেক পানি জমা পড়েছে, মরুভূমির খড়কুটোর ঘর বদলে রাশি রাশি দালানঘর উঠেছে। ভাইয়ের ব্যবসা ছেড়ে ছানু নিজের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি ক্যাডেট কলেজ শেষ করে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া চুকিয়ে, বন্ধুদের সাথে নিয়ে ফার্ম খুলে, মোটামুটি ব্যস্ততার মধ্যে দিন গুজরান করছিলাম।

এরই মধ্যে ছানু তাগাদা দিতো বেড়াতে যেতে। একদিন ফোনে বললো, তোমার পাসপোর্টের ফটোকপিটা পাঠিয়ে দাও, আমি ভিসা ইস্যু করাচ্ছি। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম—‘সত্যি সত্যি যদি যেতেই হয় আমি দু সপ্তাহের বেশি সময় দিতে পারবো না।’
‘ঠিক আছে, তাই হবে।’ ছানু ফোন রেখে দিলো। আমিও আমার কাজে মনোযোগ দিলাম এবং বিষয়টি প্রায় ভুলে যাবার চেষ্টা করলাম।
দিন পনেরো পরে ছানুর ফোন—তোমার ভিসা ইস্যু হয়েছে। আমি এক্ষুনি ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভিসার মেয়াদ ১৪ দিন। এটা ট্রানজিট ভিসা। মনে রাখবে, এক মাসের মধ্যে তোমাকে এখানে আসতে হবে, না হলে ভিসা বাতিল। তুমি কোনোমতে টিকেট কেটে চলে আসো—এখানকার সব দায়িত্ব আমার।
ঢাকাস্থ আমিরাতের কনস্যুলেট অফিস থেকে সাধারণ ভিসা ইস্যু হয় না। কেবলমাত্র কূটনৈতিক ভিসা ইস্যু হয়। অন্য সব ক্ষেত্রে ওখানকার একজন স্পনসরের মাধ্যমে গমনকারীর পাসপোর্টের ফটোকপির প্রেক্ষিতে ভিসা ইস্যু করা হয়। এই ভিসার ফটোকপিই টিকেট ইমিগ্রেশনে কাজ করে। যে এয়ারপোর্টের মাধ্যমে দেশে ঢুকতে হয়, সেই এয়ারপোর্টে মূল ভিসা জমা থাকে। সেটা দেখালেই পাসপোর্টে সিল পড়ে যায়।
আমার ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে প্রথম দিকে ভিসা ইস্যু করার আগে ছানু একবার জানতে চেয়েছিলো পাসপোর্টে আমার পেশা হিসেবে লেখা ‘আর্কিটেক্ট’ বদল করে ‘ব্যবসায়ী’ দেয়া সম্ভব কিনা। বিস্মিত হয়ে বললাম—‘কেন? আমি কি আর্কিটেক্ট নই? তার জবাব, ‘না, মানে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার দেখলে যদি ভিসা দিতে না চায়?’
—কেন দিতে চাইবে না? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কি দেশ ভ্রমণ করে না?
—না, না, সেটা নয়। ইন্ডিয়া বাংলাদেশ থেকে অনেক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এভাবে এসে পরে আর ফেরত যায় না, চাকরিবাকরি খোঁজে, কেউ কেউ চাকরি পেয়ে থেকেও যায়।
—সেটা তাদের ব্যাপার। ওদের যেহেতু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নাই, বিদেশ থেকে এসে তারা তো থেকে যাবেই। এজন্য ট্রানজিট ভিসা দিতে সমস্যা হবার কথা নয়।
ছানু হাল ছাড়ে না। আবার বলে—‘আচ্ছা, সেটা আমি চেষ্টা করবো, পাসপোর্টে পেশা বদল করতে হবে না। তুমি বরং একটা সার্টিফিকেট পাঠাও যে, তুমি কোনো সরকারি চাকরিতে নেই।
বললাম—সেটাও পাঠানো যাবে না। আমি যে সরকারি চাকরিতে নেই সেটা আমার পাসপোর্টই বলে দেবে। প্রয়োজনে নিজে আন্ডারটেকিং দেবো। কিন্তু আমাকে সার্টিফাই করবে কে?
ছানু সেদিন ক্ষান্ত দিয়েছিলো। ভেবেছিলাম থাক, তবে বাঁচা গেলো। মরুর দেশ কীই-বা আছে দেখার। তারচে ভারতটাকে ভালোভাবে দেখে আসি। কিন্তু না। হঠাৎ করেই একদিন ফোন এবং সাথে সাথে ফ্যাক্স করে ভিসা। সুতরাং আর দেরি করা নয়।

দুবাই যাবার কথা হচ্ছিল কয়েকদিন ধরেই। কিন্তু নিজেই নিশ্চিত ছিলাম না, বিশ্বাসও হয়নি। তাই আমল দিয়ে কাউকেই বলিনি। ভিসা চলে আসার পর না যাওয়াটা প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত। ফ্যাক্সটা হাতে নিয়ে, যেন কোনো নিশ্চিত প্রজেক্ট ক্লায়েন্ট বাতিল করে দিয়েছে, এমন একটা মন খারাপ করা মুখে আমার পার্টনার তৌকিরকে বললাম—‘দুবাই যাচ্ছি।’
তৌকির পাত্তা দিলো না। সিগারেটে টান দিয়ে বললো—‘কবে?’
আরো সিরিয়াস ভঙ্গি করে বলি—এক্ষুনি টিকেট কাটতে যাচ্ছি—আর্লিয়েস্ট এভেইলব্ল ফ্লাইটে।
তৌকির বলে—‘কোন এয়ারলাইনে যাচ্ছিস? বিমান আমিরাত তো সরাসরি দুবাই যায়।’
বলি—বিমানে যাবো না। কারণ এটা বাংলাদেশের বিমান। বত্রিশ বছর ধরে বাংলাদেশে জীবনযাপন করছি, প্লেনে উঠেও বাংলাদেশি আতিথেয়তা, বাংলাদেশি খাবার খেতে চাই না। ভিন দেশ দেখার জন্যেই যদি বিদেশ যাওয়া, তো হোয়াই নট বিদেশি বিমান!
তৌকির যুক্তি মানলো। বললো—তা হলে এমিরেটস্-এ যা।

বললাম—দেখি। চেষ্টা করবো ওমান এয়ার বা কুয়েত এয়ার লাইনে। কারণ আমিরাতে গেলে ঢাকা থেকে উঠিয়েই দুবাই নামিয়ে বলবে—যাও ভাগো। কিন্তু ওমান বা কুয়েতে গেলে আমাকে প্রথমে মাসকাট বা কুয়েত সিটিতে নিয়ে যাবে। সেই অঞ্চলটা না হোক, আরেকটা এয়ারপোর্ট তো দেখা যাবে? এক পয়সায় দুই মজা। সুতরাং সোজা না গিয়ে একটু ঘুরেই যাবো। একই পয়সা খরচ করে যখন বেশিক্ষণ আকাশে উড়তে পারি, সেটা আমি ছেড়ে দিবো কেন?
কুয়েত এয়ারওয়েজের বাংলাদেশ এজেন্ট বিএএসএল। আমাদের ফার্ম এদের দু-একটি ইনটেরিয়র কাজের কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে। সোনারগাঁও হোটেলের তাদের টিকেট কাউন্টারের ও কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছি, সুতরাং চোখ বন্ধ করে তাদের কাছেই চলে গেলাম। কাউন্টারের এক মহিলাকে বললাম—মে মাসের প্রথম ফ্লাইটে দুবাই যাবো, টিকেট দেন—বলে মানিব্যাগে হাত দিয়েছি টাকা বের করার জন্য। ভদ্রমহিলা একটু হাসলেন, বললেন—প্রথম যাচ্ছেন তো?
—জি। প্রথম।
—তাহলে আপনার পাসপোর্ট, ভিসার ফটোকপি জমা দেন।
আমরা দুবাই এয়ারপোর্টে টেলেক্স করবো। ওখান থেকে রেজাল্ট ওকে হয়ে এলেই শুধু আমরা টিকেট ইস্যু করতে পারি, তা না হলে না।
বুঝলাম। এসব ক্ষেত্রে ভুয়া পাসপোর্ট ভুয়া ভিসা জোগাড় করে কেউ যদি এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিতে না পেরে ধরা পড়ে, তবে তাকে ফেরত নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়বে ঐ বিমানটির কাঁধে। সুতরাং এয়ারলাইন কর্তৃপক্ষ কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। এইটুকু বুঝে অসহায়ের মতো ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন—‘এটাই আমাদের সিস্টেম, আপনি কাইন্ডলি কাল একবার ফোন করে খবর নিবেন। ভিসার কনফার্মেশন পেলে আর কোনো সমস্যা হবে না। আপনি আমাদের কনসালট্যান্ট আমরা স্পেশিয়াল রেইটে আপনাকে টিকেট দেবো।’
যথাসময়ে টিকেট হলো, পাসপোর্ট টিকেটের গায়ে ডলার এনডোর্ড হলো। এখন বাকি থাকল শুধু বিমানে ওড়ার পালা।
৪ মে ১৯৯৭। ভোর সাড়ে সাতটায় কুয়েত এয়ারওয়েজের বিমান উড়বে কুয়েতের পথে। আগের দিন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিক অনুভব করে উঠতে পারছিলাম না। সন্ধ্যা সাতটায় ঘরে এসে খাটের তলা থেকে বড় একটা স্যুটকেস বের করা হলো। স্যুটকেসের ধুলো পরিষ্কার করতে করতে জলী (আমার স্ত্রী) বললো—এইমাত্র মনে হচ্ছে আমাদের ঘরে কেউ বিদেশ যাচ্ছে।
স্যুটকেস গোছানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো জলী। টেলিভিশন দেখায় মনোযোগ দিলাম। এবং রাত বারোটা পর্যন্ত দেখে ঘুমাতে গেলাম।
যাত্রার সূচনাতেই একটা ভজঘট পাকালো। আবুল নামের আমার এক চেনা ড্রাইভারকে ঠিক করা হয়েছিলো ভোর চারটায় এসে আমাদের জাগিয়ে উঠাবে এবং সাড়ে চারটায় রওনা দিয়ে ভোর পাঁচটার মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছাবো। যদিও টিকেটের গায়ে লেখা আছে রাত তিনটায় এয়ারপোর্টে রিপোর্টিং। কিন্তু আমার মনে হলো এতো রাতে কেউই যাবে না। প্লেন ছাড়ার আগে চারঘণ্টা সময় এয়ারপোর্টে আমার কোনো কাজ নেই। কিন্তু রাত সাড়ে চারটায় ঘুম ভেঙে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলো আবুলকে নিয়ে। আবুলের পাত্তা নেই। আবুল পাশের বিল্ডিংয়ের একজন ড্রাইভার। আমাদের দারোয়ান নিশ্চয়ই তার বাসা চেনে। দারোয়ানকে ঘুম থেকে উঠানো হলো। চোখ মুছতে মুছতে জানালো—সে আবুলের বাসা চেনে না।
জলী বললো একবার আসার পথে দূর থেকে আবুল তাকে দেখিয়েছে মাঠের কোণে লাল গেটওয়ালা বাড়িতে আবুল থাকে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি নামিয়ে রওনা দিলাম আবুলের বাসার সন্ধানে। না, আবুল নেই, আবুলের বাসাও নেই। সকাল পাঁচটা হয়ে গেছে। ছোট ভাই রাসেল বললো সে আবুলের এক বন্ধুর বাসা চেনে। ঐ বন্ধু আরেক বাসার দারোয়ান। সেই বাসায় গিয়ে দারোয়ান বন্ধুকে ঘুম থেকে উঠানো হলো। অনেক অনুনয়-বিনয় করে দারোয়ান ভাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো আবুলের বাসায়। ততক্ষণে সকাল সোয়া পাঁচটা। আবুল ঘুম ভাঙা চোখেই গাড়ি চালাতে চাইলো। কিন্তু তাকে এ যাত্রা সে সুযোগ দেয়া হলো না। এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত পথে গাড়িটা বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্যই তাকে দায়িত্ব দেয়া হলো।
ভোরবেলা দেশ ছাড়ার সময় আমার কোনো দুঃখ দুঃখ ভাব এলো না। বরং ফুর্তিই লাগছিলো। এয়ারপোর্টের ভেতর ঢুকিয়ে দেবার সময় বৌ সাবধান করে দিয়েছে—তোমার ব্যাগটা সাবধানে রাখবা, ওর ভেতরই তো পাসপোর্ট টিকেট। আসলে আমার স্বভাবটা বৌয়ের অনেক দিনের চেনা। ফটো ল্যাবে গিয়েছি ব্যাগ নিয়ে, ভেতরে ক্যামেরা। ছবি প্রিন্ট করতে দিয়ে খালি হাতে চলে এসেছি। অনেকদূর আসার পর হয়তো মনে হয়েছে—ব্যাগটা কোথাও ফেলে এসেছি। আবার রিকশা ফিরিয়ে ব্যাগ আনতে যাওয়া। এটা এক-দুইবার হয়নি। তার চেয়ে বেশিই হয়েছে। এই যেমন গতকাল পাসপোর্ট টিকেট নিয়ে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে গিয়েছিলাম ডলার এনডোর্স করে ট্রাভেলার্স চেক নিতে। একপর্যায়ে ব্যাংকের অফিসার বললো—পাসপোর্টের দুই সেট ফটোস্ট্যাট কপি লাগবে। ব্যাংক থেকে বেরিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে, উল্টাদিকের এক দোকানে পাসপোর্ট ফটোস্ট্যাট করাচ্ছি। এমন সময় মনে হলো আমার মূল্যবান কালো ব্যাগটা আমার কাঁধে নেই। ব্যাগের ভিতর দুটো ক্যামেরা, আরো দুটো লেন্স এবং আমিরাত সফরের সম্ভাব্য বাজেট প্রায় হাজারখানেক ডলারের সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রা।
প্রায় দৌড়ে এসে ব্যাংকের কাউন্টারে দেখি ফকফকা শূন্যতা। ব্যাগটি যেখানে রেখে এসেছিলাম বলে মনে হয়েছিলো, সেখানে ব্যাগটি নেই। যে অফিসারের সাথে আমার কথা হয়েছিলো, তিনিও নেই। চেয়ার শূন্য। অসহায়ের মতো চারদিকে তাকাচ্ছি।
এমন সময় প্রায় বুড়ো দারোয়ান আমার কাঁধে হাত রাখলেন। মিটি মিটি করে হাসলেন। জিজ্ঞাসু চোখে কপালের কাছে ভ্র“ উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—কী ব্যাপার?
: আমার ব্যাগটা…।
: আসেন আমার সাথে।
আমাকে প্রায় টেনে এক কোণে নিয়ে আরেক অফিসারের টেবিলের তলা থেকে ব্যাগ বের করে দিয়ে বলেন—এইভাবে কেউ ব্যাগ ফেলে যায়?
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতর যাত্রী হয়ে এর আগে আমার কখনো ঢোকা হয়নি। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে এক ধরনের রোমাঞ্চ বোধ করতে লাগলাম। ভেতরে ঢুকেই এমন একটা ভাব দেখালাম যে এসব ফর্মালিটিজ আমার জন্য দুধভাত। অন্তত অন্য লোকজন যেন আমাকে দেখে তা মনে করে।
প্রথমেই কুয়েত এয়ারওয়েজের লেখা কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি লোকজন টিকেট, ভিসা, পাসপোর্ট দেখাচ্ছে। আমিও আমারগুলো হাতে নিলাম। একটা স্যুটকেস আমার সাথে আছে, সেটাকে ওজন করার ওখানে তুলতেই ইউনিফর্ম পরা এক অফিসার আমার দিকে হাত বাড়ালেন—সব কাগজ একসাথে দিয়ে দিলাম। তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লেন, এবং বললেন—ট্রানজিট ভিসা?
—ডলার আছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন। কিন্তু আমার কাছে প্রশ্নটি যথার্থ মনে হলো না। আমার কাছে যে ট্রাভেলার্স চেক ও ডলার রয়েছে তা আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের সিলছাপ্পরসহ পাসপোর্ট ও টিকেটের গায়ে লেখা আছে। তবুও নিচু স্বরে, খুব অমায়িক ভঙ্গিতে বললাম—জি আছে, এক হাজার ডলার।
ভদ্রলোক টিকেটের গায়ে স্যুটকেসের ট্যাগ লাগিয়ে বোর্ডিং কার্ড ধরিয়ে দিলেন। বোর্ডিং কার্ড নেবার পর আমার বাকি থাকে ট্রাভেল ফি জমা দেয়া।
ভেতরের দিকে চলে যাবো, এমন সময় বাইরে তাকিয়ে দেখি গ্লাসের বাইরে শ্যালক স্বপনের কোলে হাত উঁচিয়ে আমার আড়াই বছরের পুত্র ইশমাম ডাকাডাকি করছে।
কাছে যেতেই কাচের ফাঁক দিয়ে জলী বললো—বোর্ডিং কার্ড নিয়েছো?
বললাম—হ্যাঁ।
: তা হলে আমরা চলে যাই?
এমন সময় ইশমাম আরো জোরে চিৎকার করে উঠলো।
‘বাবা, তুমি যাবে না। তুমি কোথায় যাচ্ছো বাবা? বাবা চলে আসো।’
একবার মনে হলো—দূর! বাদ দিই বিদেশ-বাদেশ। কী হবে এসবের। তার চেয়ে বাসায় গিয়ে ছেলের সাথে ইসকুল ইসকুল খেলি। পরে আবার মনে হলো—বোর্ডিং কার্ড নেয়া হয়ে গেছে, স্যুটকেস নেয়া হয়ে গেছে প্লেনের কাছাকাছি। কী আর হবে মায়া বাড়িয়ে। মাত্র ১৩ রাতের সফর। ক’দিন দূরে থেকেই দেখিনা কেমন লাগে।
ইমিগ্রেশন কাউন্টারের ভিতর ঢুকে পড়ি। পেছনের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছা করেনি।
ট্রানজিটে কুয়েত এয়ারপোর্ট
প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে বিমানটি এসে নামলো কুয়েত এয়ারপোর্টে। কুয়েত ছোঁবার আগে থেকেই কেমন যেন এক ধরনের রোমাঞ্চ বোধ হতে লাগলো। নব্বই সালে সাদ্দাম হোসেনের আক্রমণের শিকার হয়েছিলো কুয়েত। কুয়েত তখন সকল সংবাদের শিরোনাম। সেই বিখ্যাত কুয়েত সিটিকে এক নজর দেখার জন্য প্লেনের জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালাম। ছিমছাম শহর খুব উঁচু ইমারত নেই বটে, কিন্তু মনে হলো খুব ভালো বিন্যাসে টাউন প্লানিং করা হয়েছে। পরিকল্পিত গ্রিডে প্রশস্ত সড়ক। সড়কের প্রান্তে শৃঙ্খলিতভাবে পার্ক করা গাড়ি। মোটামুটি ঘনবসতি শহরের মধ্যে। দূরে যেদিকেই চোখ যায়, মরুভূমি। ধু-ধু মরুভূমি। ছোট ছোট কিছু গাছ, তাও আবার পুরো সবুজ নয়, কালচে সবুজ। কুয়েত নামতেই মনে হলো—এখানে সবই সুন্দর, শুধু সবুজের বড় আকাল।
তেত্রিশ হাজার ফুট উঁচুতে উড়ে কুয়েত এয়ারপোর্টে এসে যখন নামি তখন কুয়েত সময় বেলা এগারোটা। কিন্তু আমার ঘড়িতে সময় বেজে আছে দুটো। বুঝলাম জীবনের হিসাব থেকে তিন ঘণ্টা সময় বেহিসাবে অর্জন করে ফেলেছি। ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে নেবার মধ্যে আনন্দ আছে। আরো তিন ঘণ্টা পরে আমার ঘড়িতে দুটো বাজবে। ব্যাপারটিই আনন্দেরই।
এয়ারপোর্টে নেমে চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম। সবদিক কেমন যেন একটা চিকচিকে ভাব। আমরা যারা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো দুটো কুপন। তার একটা দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ অপরটি দিয়ে ড্রিংক্স। দুবাইর পথে বিমান ছাড়বে কুয়েত সময় পৌনে পাঁচটায়। চারটায় এসে রিপোর্ট করতে হবে। হাতে ঘণ্টা পাঁচেক সময়। পাঁচঘণ্টা বসে থাকার বিড়ম্বনার কথা চিন্তা করতে করতে আমার কুয়েত অবতরণের রোমাঞ্চ কেটে যেতে শুরু করলো। কিন্তু ভাবলাম আমার কুয়েত আসার খবরটা কাউকে না কাউকে জানালে কেমন হয়। অবশ্য এর আগে আমাকে কুয়েত একবার পাঠিয়েছিলো ভোরের কাগজ-এর প্র“ফ রিডার।
১৯৮৯ সালের কথা। আমি তখন আজকের কাগজের বুয়েট প্রতিনিধি। স্টাফ রিপোর্টারদের বাইরে যারা খবর পাঠাতো তাদের নাম ছাপা হতো ইনট্রোর শেষ লাইনে। অন্য সব খবরের শেষে লেখা হতো—বুয়েট থেকে শাকুর মজিদ। একবার দেখলাম লিখেছে—কুয়েত থেকে শাকুর মজিদ। এ খবরটি প্রচুর লোক পড়েছে বলে মনে হলো। ক্যাম্পাসের ছেলেরা আমাকে দেখলেই দাঁত বের করে বলতো—‘কুয়েত থেকে’, পত্রিকার অফিসে পরদিন এলাম অভিযোগ নিয়ে। নিউজ এডিটর আহমেদ ফারুক হাসান অধিকতর গম্ভীর মুখে বললেন—‘আপনাকে কুয়েত পাঠানোতে মন খারাপের কিছু নাই। কুয়েত থেকে বুয়েটের খবর পাঠিয়েছেন—এটা কি কম কথা? যান, রিপোর্ট লেখেন, শর্ট করে লিখবেন, আমাদের স্পেসের খুব অভাব।’
কিন্তু সত্যি সত্যি কুয়েতের চকচকে এয়ারপোর্টে নেমে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সুন্দর-সুন্দর মানুষ, সুন্দর-সুন্দর পোশাক, চারদিকে মার্বেল আর গ্রানাইটের চাকচিক্য। এর মধ্যেই লাল পাজামা, ছাই রঙের ফুলহাতা শার্ট পরা কতোগুলো তরুণ ঝাড়– হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাজ, কোথাও যদি একটু ময়লা জমে, সাথে সাথে পরিষ্কার করা। এদেরই একজন কাছে এসে, সরাসরি বাংলায় বলে—ঢাকা থেকে আইছেন?
বলি, আপনি বাংলাদেশি?
—জি, কুমিলায় বাড়ি।
ইউনিফর্ম পরা বাকি তরুণদের দিকে তাকিয়ে বলি—‘ওরা কি বাংলাদেশি?’
—দুই তিনজন ইন্ডিয়ান আছে, বাকি সব সুইপার বাংলাদেশি।
মনটা আমার এ জন্যে খারাপ হয়ে গেলো। একটা প্লাস্টিকের চেয়ারের উপর বসে সিগারেটের প্যাকেটে হাত দিই। ছেলেটি দূর থেকে—একটা উঁচু ছাইদানি আমার কাছে এনে বলে—এখানে ছাই ফেলবেন। ফ্লোরে ফেললে অফিসার জরিমানা করে দেবে।

ছেলেটির সাথে আমার খাতির জমে যায়। তার নাম মফিজ। বাড়ি কুমিলার শিমলা থানায়, বয়স ২৪। দেশে তাদের এলুমিনিয়াম ক্রোকারিজের ব্যবসা আছে। ছয় মাস আগে বাহাত্তর হাজার টাকা খরচ করে এসেছে। যে দালাল তাকে পাঠিয়েছে সে এ চাকরির কথা খুলে বলেনি। বলেছিলো—এয়ারপোর্টের কাজ, বেতন মাসে ২৮ দিনার (১ দিনার = ১৪৫ টাকা প্রায়) কিন্তু বেতন কিছু না, ওভার টাইম আর বকশিশ মিলে মাসে যা পাবে, খেয়ে-দেয়ে বাংলাদেশি টাকায় দশ পনেরো হাজার টাকা কামাই করা কিছু না। কিন্তু কুয়েত এসে মফিজের মাথায় হাত। ঘরের ছেলে, সাত পুরুষে যে ধরনের কাজ কখনো করতে হয়নি, বিদেশবিভুঁই এসে জাত মেরে এখন সুইপারের কাজ তাকে করতে হয়। ডিউটিও বড় কঠিন। ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ। সরকারি ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া আর কোনো ছুটি নাই। অসুখ বিসুখেও কোনো মাফ নাই। কোনো কারণে একদিন ঠিক সময়মতো আসতে না পারলে তিনদিনের বেতন কাটা যায়।
মফিজ এইসব কড়া নিয়মের ভেতর দিয়েই কাজ করে যাচ্ছে। সে ভুলে যেতে চায় তার অতীতের কথা। ছিয়াত্তর হাজার পাঁচশ টাকা খরচ করে এদেশে এসেছে। আসার সময় ঋণ করেছিলো চলিশ হাজার, এখনো কুড়ি হাজার টাকা তার পরিশোধ করা বাকি আছে। বাড়িতে বাবার কাছে এ পর্যন্ত ৩৬ হাজার টাকা সে পাঠিয়েছে। কুয়েত এয়ারপোর্টে তার ২ বছরের চাকরির মেয়াদ। এর মধ্যে ৮ মাস চলে গেছে। দু বছর পার হলে সে আরো দু বছরের আকামা বাড়াবে। তারপর দেশে চলে যাবে একেবারে। আর কখনো এই চাকরি করার জন্য কুয়েত ফিরবে না।
কুয়েত এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জে হাঁটাহাঁটি করতে করতে, ঝিকঝিকে ডিউটি ফ্রি শপের মনোহরি জিনিসপত্তর দেখতে দেখতে কুয়েত সময় চারটা হয়ে গেলো। বিকেল পৌনে পাঁচটায় প্লেন ছাড়বে। দুবাইর পথে। দেরি না করে লাউঞ্জে ঢুকে গেলাম।
কুয়েত এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জ থেকে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে ঢোকার সময় প্রথম সা¤প্রদায়িক দুরাচারের বিষয়টি টের পেলাম। নিরাপত্তা তোরণের ভেতর দিয়ে নিরাপদে প্রবেশ করে রেহাই মিললো না। আমার পরনে যেহেতু প্যান্ট শার্ট এবং আমার চেহারা পশ্চিমাদের মতো নয়, তাই আমার দেহেও চালানো হলো নিখুঁত তলাশি। দুই হাত উপরে উঁচিয়ে ভালো করে দেখাতে হলো। বগলের তলায় এবং বেলটের তলায় কিছু না পেয়ে কুয়েতি সুঠামদেহী নিরাপত্তা কর্মী সম্ভবত মন খারাপ করে ছেড়ে দিল। লাউঞ্জে এসে বসে দেখি, কালো বোরকা পরা রমণী এবং সাদা আলখালা পরা পুরুষেরা পুরো শরীর কাপড়ে ঢেকে নির্বিচারে ঢুকে যাচ্ছে। তাদের জন্য ঐ কর্মীর কোনো উৎকণ্ঠা নেই, উৎকণ্ঠা নেই ইউরোপ আমেরিকার সাদা চামড়ার যাত্রীদের জন্যও। কিন্তু উৎকণ্ঠা আছে আমাদের নিয়ে।
ল্যান্ডিং ইন দুবাই
ঠিক ৪টা ৪৫ মিনিটে প্লেন ছাড়লো দুবাইর পথে। বিমানবালার ঘোষণা অনুযায়ী ৩৩ হাজার ফুট উঁচুতে চড়ে আমরা ১ ঘণ্টা ৫ মিনিটে দুবাই বন্দরে পৌঁছাবো। কিন্তু ভৌগোলিক কারণে এ সময়ের দূরত্ব গিয়ে ঠেকবে ২ ঘণ্টা ৫ মিনিটে। ঢাকা থেকে কুয়েত আসার সময় আমার যাত্রা ছিলো সূর্যের গতির দিকে। আলোর সাথে একই বেগে চলতে পারলে আমার কাছে সময় বর্তমান থাকতে পারে। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিলো না। যতটুকু সম্ভব ছিলো তা দিয়ে ৩ ঘণ্টা সময় জীবনের হিসাব থেকে বাঁচিয়ে আনন্দ করেছিলাম কিন্তু এখন যেতে হবে উল্টো। পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে। সুতরাং সূর্য দ্বিগুণ সময়ে আমাকে পিছিয়ে দেবে। যে দূরত্ব অতিক্রম করবো, সূর্য ততক্ষণে আমার কাছ থেকে ১টি ঘণ্টা ছিনিয়ে নেবে।
প্লেনে আমার সিটের সামনে যে ছোট্ট মনিটর দেয়া আছে তাতে অডিও ভিডিও দু রকমের চ্যানেল। ইংরেজি, হিন্দি, আরবি গান, সিনেমা। ঢাকা থেকে কুয়েত পর্যন্ত সময়ে হিন্দি সিনেমা চালালো ‘রাজা হিন্দুস্থানি’। কুয়েত থেকে দুবাই পর্যন্ত সিনেমার ব্যবস্থা ছিলো না। এক বেলা ডিনার খেতে খেতেই তো একঘণ্টা সময় পার করা যায়। অনেক চ্যানেলের মধ্যে থেকে আমার কাছে প্লেনের যাত্রার মনিটরিং দেখতে চমক লাগলো বেশ।
ডিনার খেয়ে পর্দায় চোখ রাখতেই দেখি লেখা আছে ট্রাভেল টাইম ৪৫ মিনিট, বাকি ২৪ মিনিট সময়ে ১৮১ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করবো। পর্দায় ভেসে আসছে আরব সাগর ও তার পাশাপাশি অঞ্চলসমূহ। তীর চিহ্ন দিয়ে প্লেনের গতিবিধি দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। একবার কম্পাসের মতো একটা গোলাকার অবয়ব ভেসে উঠলো। তা দিয়ে দেখলাম কাবা শরিফ ১৩৫ মাইল পেছনে ফেলে আমরা পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে যাচ্ছি। প্লেনের গ্রাউন্ড স্পিড প্রতি ঘণ্টায় ৬২৪ মাইল। বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সময় এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে দূরত্বও কমে আসে। ৩৩ হাজার ফুট থেকে আস্তে আস্তে নিচে নামে কুয়েত এয়ারওয়েজের বিমান। মনিটরে দেখা যায় প্লেনটি দুবাই উপক‚লের কাছাকাছি এসে পড়েছে। সূর্যের আলো লীন হয়ে গেছে খানিক আগে। আরব সাগরে ছোট ছোট ট্রলারের বিন্দু বিন্দু আলো দেখা যায়। হঠাৎ করে বাহিরের তাপমাত্রা—৩ থেকে ৪ ডিগ্রি বেড়ে আসে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই ঠাশ করে দুবাই এয়ারপোর্টের গ্রাউন্ড যখন বহরটি ছুঁলো, তখন বাইরের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দুবাই এয়ারপোর্টে নেমে একটা শংকা হঠাৎ মনটাকে খানিক আক্রান্ত করে ফেললো। আমার মূল ভিসার কপি এয়ারপোর্টে থাকবে, সেটা দেখিয়ে এখানকার ইমিগ্রেশন অফিসারকে সন্তুষ্ট করতে পারলে আমার ভিসা পাসপোর্টে লাগবে। তা না হলে না।
রিটার্ন টিকেট করা আছে। এরা চাইলে আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত পাঠাতে পারে।
ছানুর দেয়া পরামর্শ অনুযায়ী ভিসার ফ্যাক্স কপির ফটোকপি দেখিয়ে মূল কপিটা একটা কাউন্টার থেকে উঠিয়ে নিলাম। এবার আসল পরীক্ষা। ইমিগ্রেশন। অনেক কাউন্টার ইমিগ্রেশনের। তার মধ্যে দুটো হচ্ছে ব্রিটেন ও আমেরিকার নাগরিকদের জন্য। এ দু দেশের নাগরিক হলে তাদের আগে থেকে ভিসা নিয়ে যাবার দরকার নেই। এই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে গেলেই ইমিগ্রেশন অফিসার খুশি মনে তার পাসপোর্টে সিল মারবেন। অন্য দুটো কাউন্টার হচ্ছে জি সি সি (গালফ কমিউনিটি কাউন্সিল) ভুক্ত দেশগুলোর জন্য। তাদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। এছাড়া অন্য দেশগুলোর নাগরিকদের তাদের দেশে ঢুকতে অন্য ব্যবস্থা। সেই অন্য ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম।
যথাসময়ে আমার ভিসার কাগজ ও পাসপোর্টটি নিয়ে কাউন্টারে মুখোমুখি হলাম ইমিগ্রেশন অফিসারের। লোকটি ছোকরা বয়সি। বয়স তিরিশের বেশি হবে না। চেহারা কালো, অল্প অল্প দাড়ি আছে। আমার কাগজ ও পাসপোর্ট দেখে শুধু একবার বিষণœ মুখে আমার মুুখের দিকে তাকিয়ে ভিসার কাগজ ও পাসপোর্টে দুটো লাল রঙের সিল মেরে পাসপোর্ট ফেরত দিলেন। তার মানে—১৪ দিনের জন্য তোমাকে ট্রানজিট ভিসা দেয়া হলো। যাও, এবার দুবাই দেখো।
ভিসা নেয়া হলো, এবার বেরিয়ে পড়ার পালা। কিন্তু বাদ সাধলো আমার লাগেজটি। কুয়েত এয়ারওয়েজের বেল্ট ঘিরে যত লাগেজ পড়ে আছে তাতে আমার স্যুটকেসটি দেখা গেলো না। পড়লাম বিপাকে। স্যুটকেসটির মধ্যে আহামরি কিছু নেই। আমার বৌ, আমার বন্ধু, বন্ধুপতœী ও তার ছেলেমেয়ের জন্য কিছু কাপড়চোপড়, কিছু কাঁচা তরকারি ও ফলমূল এসব ভরে দিয়েছে। ব্যাগটি না পাওয়ার জন্য মনে কোনো দুঃখবোধ জন্মালো না। কারণ ব্যাগের ভিতরের জিনিসপত্তর আমার নয়, বন্ধুর। কিন্তু মন খারাপ হলো ব্যাগটির জন্য। কম করে হলেও দেড় হাজার টাকার স্যুটকেস। এতো টাকার মায়া ছাড়তে ইচ্ছে হলো না। তাই ইউনিফর্ম পরা এক ভদ্রলোককে বললাম—আমার লাগেজ পাওয়া যাচ্ছে না, কী করতে পারি।
আরবদের সম্পর্কে আমার ধারণা খুব উঁচু নয়। এর মধ্যেই টের পেয়ে গেছি, বাংলাদেশি চামড়া তাদের পছন্দ নয়। কিন্তু ঐ কর্মকর্তা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আমাকে একটি বুথ দেখিয়ে সেখানে যাবার পরামর্শ দেন।
যথারীতি সেই বুথে গিয়ে হাজির। যে ভদ্রলোক কাউন্টারে বসে কম্পিউটার নিয়ে টেপাটেপি করছিলেন—তাকে আমার সমস্যার কথা জানালাম।
তিনি মাথা না তুলে বললেন—আবার ভালো করে দেখে আসুন। বললাম—আমি তিনবার দেখে এসেছি। আমি নিশ্চিত লাগেজটি আসেনি বা এলেও কেউ নিয়ে গেছে।
এবার তিনি মুখ তুলে তাকালেন। বললেন—দেখি আপনার টিকিট। আমার টিকিটের সাথে যে ট্যাগ লাগানো আছে তা দেখে তিনি চিন্তিত হয়ে গেলেন। বললেন—আপনার ব্যাগটি বাহরাইন চলে গেছে।
যেন আকাশ থেকে পড়লাম। ঢুকতে না ঢুকতেই এ কি ঝামেলা! আগে শুনেছি ঢাকার বিমানবন্দরে ব্যাগ হারায়। পৃথিবীর অন্য কোথাও এয়ারপোর্টে ব্যাগ হারায় না। এবার দেখি দুবাইতে এই অবস্থা। কিন্তু তাতে আমার দুঃখের চেয়ে আনন্দই বেশি বোধ হতে লাগলো। যাকগে দু হাজার টাকার ব্যাগ, ব্যাটাদের কথাতো কিছু শোনাতে পারবো।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, ব্যাগ হারানোর ব্যাপারটিতে তাদের সহজে ছেড়ে দেবো না। তাই কাউন্টারের উপর কনুইটা চাপিয়ে, অনেকটা ফিল্মি কায়দায়, কণ্ঠস্বর যতটা গম্ভীর করলে ভদ্রলোকের স্নায়ুর উপর চাপ পড়ে তারচে বেশি গম্ভীর করে বললাম—আপনাদের এখানে কী সবসময় এরকম হয়?
ভদ্রলোক আসলেই খুব ভদ্রলোক। তিনি বিচলিত হলেন না। কিন্তু প্রশ্নটির কোনো জবাবও দিলেন না। আমাকে বললেন, ‘আমি কুয়েত এয়ারের একজন কর্মকর্তাকে ডেকে দিচ্ছি, আপনি বরং তার সাথে কথা বলুন।’ এর মধ্যে কী বোর্ডে বাটন টেপা শেষ হলে একটা টেলেক্সের কপি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন—‘আপনার ব্যাগটির সংবাদ আমরা এই মাত্র বাহরাইন পাঠিয়ে দিয়েছি। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি আপনাকে ফোন করে জানানো না হয়, আপনি এই নম্বরে খোঁজ নিবেন। আশা করি আপনার ব্যাগটি আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারবো।’
এর মধ্যে এসে হাজির হলেন কুয়েত এয়ারওয়েজের কর্মকর্তা। ভদ্রলোক মিশরি। আমার ট্যাগটি দেখে বললেন—এখানে লেখা আছে ঢাকা-কুয়েত-বাহরাইন। আপনার ব্যাগ বাহরাইন চলে গেছে।
আমি ক্ষেপে বললাম—আমি যে দুবাই যাবো, সেটা আমার টিকেটে লেখা আছে। তারপরও যদি তোমার এয়ারলাইনের কোনো স্টাফ আমার লাগেজ বাহরাইন পাঠান তার দায়িত্ব আমি নেবো কেন, বলুন।
এর মধ্যে কাউন্টারের বাইরের কাচের জানালা দিয়ে একটা প্রিয় পরিচিত মুখ দেখা গেলো। ছানু এতোক্ষণ ধরে আমার এই সব কাণ্ডকারখানা দেখছে এবং বারবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। মূকাভিনয় করার ভঙ্গি করে বোঝালাম—আমার লাগেজ হাওয়া হয়ে গেছে। ছানু ইশারা করলো—হাত দিয়ে লেখার ভঙ্গি করে। অর্থাৎ—তুমি এপ্লিকেশন লিখে চলে আসো, কী আর করা।
বলি—তুমি থামো, আমি ওদের ছাড়ছি না।
কুয়েত এয়ারের কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন—আপনার ব্যাগে কী কী আছে?
বললাম—তেমন মূল্যবান কিছু নেই; নিজে ব্যবহার করার জিনিসপত্তর।
অতঃপর, খানিক চিন্তিত মুখে বললেন—‘আমি স্বীকার করি, আমাদের এয়ারলাইনের কোনো কর্মকর্তার ভুলের জন্য আপনার ব্যাগ অন্য জায়গায় চলে গেছে। আমরা চেষ্টা করবো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার ব্যাগটি আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাগটি না পাওয়ার জন্য আপনার যে অসুবিধাটুকু হলো তা খানিকটা পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করবো, আপনি চলুন আমার সাথে।’
হাতব্যাগটি নিয়ে ঐ কর্মকর্তার পিছু পিছু এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। ছানু জড়িয়ে ধরলো বাঙালি কায়দায়। তার আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে বললাম—একটু অপেক্ষা করো, আমাকে ঐ ভদ্রলোক ডাকছেন।
এয়ারপোর্টের ভেতরেই দোতলায় কুয়েত এয়ারের অফিস। আমাকে অফিসে নিয়ে ২/৩টা কাগজে সই করিয়ে একটা ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন—এটা রাখুন, আমাদের সামান্য ক্ষতিপূরণ উপহার। এর ভিতর কিছু জিনিসপত্র আছে, যা দিয়ে আপনার সাময়িক অসুবিধা দূর হবে। আর ঐ ভাউচারটা ক্যাশ কাউন্টারে দেখালেই আপনাকে ১৪৪ দিরহাম দিয়ে দেবে। ব্যাগটি ফেরত নিতে আপনাকে এয়ারপোর্টে আসতে হবে, তার জন্য এই ক্ষতিপূরণ। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার এই ঘটনার জন্য আমরা দুঃখিত।’
এবার আমিই বরং লজ্জিত হয়ে পড়লাম। মনে হলো—শুধু শুধুই তাদের সাথে রাগ দেখালাম। ছোট ব্যাগটি খুলে দেখি এর মধ্যে আছে ১টি শার্ট, ১ জোড়া পাতলা কাগজের স্যান্ডেল, সেভিং ক্রিম, লোশন, রেজার, পারফিউম, জুতার ব্রাশ, দাঁত খিলান, সুঁই সুতা, পিন, ছোট ছুরি, ছোট্ট একটা সাবান, টুথপেস্ট, ব্রাশ, মাউথওয়াশ। অর্থাৎ একজন পর্যটকের তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য যা যা লাগতে পারে।
ছানু এসব দেখে ও শুনে মন্তব্য করলো—‘আমি শিওর, তোমার ব্যাগটা কখনোই তুমি পাবে না। এ জন্যই এসব দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে।’
বললাম—‘না, এরকম হবে বলে মনে হয় না। তবে এর আগে কারো ক্ষেত্রে এরকম হয়নি?’ ছানু বললো—‘এর আগে ব্যাগ দেরিতে এসেছে, কিন্তু ক্ষতিপূরণ জাতীয় কিছু কেউ দেয়নি, পায়ওনি। এটা তোমার ক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম। তার একমাত্র কারণ, তুমি ভালো ইংরেজি বলতে পারো। অন্য কেউ হলে বোঝাতে পারতো না, খালি কাগজ একটা হাতে নিয়ে চলে আসতো।’
এর পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। ২৪ ঘণ্টা পার হতে না হতেই দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে ফোন। আপনার স্যুটকেস চলে এসেছে, আপনি নিজে এসে বা কাউকে পাঠিয়ে ওটা নিয়ে যান। এই তথ্য পেয়ে অবাক হইনি। আমার কেন যেনো একটা উচ্চ ধারণা জন্মে গেলো আরবদের প্রতি।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে খানিকটা হেঁটে বড় রাস্তায় উঠতে যাবো এমন সময় পেছন ফেরে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া করতে লাগলো। নিয়ন বাতি, প্রকাণ্ড সব ঝাড়বাতি, কেমন যেন সিনেমা সিনেমা মনে হলো।

কুয়েত এয়ারপোর্টে ফোর হানড্রেড এএসএর কোডাক ফিল্ম লোড করেছি ক্যামেরায়। তারপরও পার্ক করা একটা গাড়ির উপর ক্যামেরা রেখে ব্রাকেট করে ছবি তুললাম কয়েকটা।
ছানুর প্রশ্ন—কেমন লাগছে?
বলি—ঠিক অনুভব করতে পারছি না। স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
ছানু একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে সতর্কবাণী—সিগারেট যত ইচ্ছা খেতে পারো, খুব সস্তা, ৪ দিরহামে বেনসন পাওয়া যায় এক প্যাকেট, কিন্তু খুব সাবধান, রাস্তার উপর বাট ফেললে—নগদ জরিমানা ৫০০ দিরহাম। সঙ্গে সঙ্গে দিতে না পারলে ২ দিনের জেল।
ছানু গাড়ি নিয়ে এসেছে। ড্রাইভার চাঁটগায়ের। মূলত তিনি মিউনিসিপ্যালিটির ড্রাইভার। নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, কিন্তু পেশাদারিভাবে চালানোর অনুমতি নেই। তবে পরিচিতদের ফাইফরমায়েশে তিনি কখনোই না করেন না। রাতের অন্ধকার ভেদ করে আমাদের গাড়ি ছুটলো ১৮০ কিলোমিটার দূরে আল-আইন শহরের দিকে। বড় নিঝুম রাত, বড় স্নিগ্ধ হাইওয়ে। দেখতে দেখতে দু ঘণ্টার আগেই পৌঁছে গেলাম।
বাগানের শহরে

৫ মে, ১৯৯৭। ঘুম ভাঙতেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। বাংলাদেশে এখন সকাল সাড়ে এগারো। এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস ছেড়ে এসেছি ছাত্রজীবনের পর। ঘুম থেকে উঠেই ছটফট শুরু করে দিলাম। বাসার মধ্যে বসে থাকা যাবে না। কিন্তু বাঙালির ঘরের মেহমান বলে কথা। নাস্তা খেয়ে বেরুতে বেরুতে বেলা এগারোটা বেজে যায়।
ছানু থাকে আল-আইনের মেইন স্ট্রিটে। প্রধান সড়কের মাঝখানে বড় একটা লেন। নিচে দোকানপাট, ৪-৫তলা পর্যন্ত অ্যাপার্টমেন্ট। প্রায় সব ইমারতই এরকম মাঝারি সাইজের উচ্চতা। পাঁচতলার উপর কোনো আবাসিক ইমারত নেই।
দু-একটা অফিস বিল্ডিং ৭-৮তলা মাত্র আছে।

ছানুর বাসা থেকে তার দোকান পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। কিন্তু এটুকুতেই আমার ঘেমে যাবার মতো অবস্থা। ঘরের ভেতর সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ। ঘর থেকে বেরুতেই ৪২ সে. তাপমাত্রার একটা ঝাঁজ কপালের উপর আলতো করে ছুঁয়ে দিলো। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টের পেলাম—বাংলাদেশ ছেড়ে অনেক দূরে ভিন্ন এক ভূমিরূপের রাজ্যে এসেছি।
আল-আইন—শব্দের অর্থ ঝরনা। ধূসর মরুর বুক চিরে ঝরনার ধারা তৈরি করেছে সবুজ বেষ্টনী। আল-আইনকে বলা হয় গার্ডেন সিটি। বাগানের শহর। তার অবশ্য কারণ আছে। একমাত্র আল-আইন শহরে অনেক কষ্টে ক্লিষ্টে গাছপালা লাগিয়ে ধূসর প্রকৃতির যতোটা সম্ভব সবুজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ছানু বললো—এতো গাছপালা দেখে মনে করো না, আমিরাতের সব শহর এরকম। আসলে আল-আইন অন্য সব শহর থেকে আলাদা।
এর অবশ্য কারণ আছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ জায়িদ-এর পিতৃ ও মাতৃভূমি হচ্ছে এই শহর। যদিও শেখ জায়িদ অবস্থান করেন আবুধাবিতে, তথাপিও এই শহরের সাথে রয়ে গেছে তাঁর নাড়ির টান। শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি। শুধু তাই নয়, আমিরাতের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট যুবরাজ শেখ খলিফা বিন জায়িদ আল নাহিয়ানের একটা প্রাসাদ আছে এই শহরে। শেখ খলিফার মা, শেখ জায়িদের প্রথম স্ত্রী, যার সাথে শেখ জায়িদের কোনো সম্পর্ক এখন নেই, তিনিও থাকেন এই শহরে।

এই শহরকে সাজাতে দ্বিধা করেননি শেখ জায়িদ। ফুলে ফলে, পার্কে বাগানে ভরিয়ে রেখেছেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে শুধু গাড়িই চোখে পড়ে, মানুষ না।
এমনিতেই সমস্ত আমিরাতের লোক সংখ্যা মাত্র ২২ লাখ। আল-আইন শহরে ১৯৮৮ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী লোক সংখ্যা ছিলো ১,৩২,৯৮০ জন। তবে এর মধ্যে বিদেশিদের হিসাবে আনা হয়নি। বিদেশিরা তাদের হিসাবের বাইরে।
আমিরাতে মানুষ আছে দুই প্রকারের। এক প্রকারের হচ্ছে অর্থাৎ যারা প্রকৃতপক্ষে আমিরাতে জন্মগ্রহণকারী আরবি। অপরপক্ষ হচ্ছে অতুনি খারিজী। অর্থাৎ বহিরাগত। তেলে সোনায় সমৃদ্ধ অঞ্চলটি মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশেরই সাথে, ১৯৭১ সালে। প্রায় অশিক্ষিতের ঐ অঞ্চলে কারিগরি উৎকর্ষ অর্জনের জন্যে দক্ষ অদক্ষ কারিগর, প্রযুক্তিবিদ, উপদেষ্টার প্রয়োজন ছিলো এবং আছে। উচ্চ মাইনের চাকরির সুবাদে নানা শ্রেণীর মানুষের সেখানে বাস। কিন্তু কোনো আইনে কাউকে নাগরিক করিয়ে নেবার বা নাগরিকত্ব দেবার বিধান আমিরাত সরকারের নেই।

ছানুর দোকানটির নাম ‘নজিব পারফিউমারি স্টোর’। দোকানটি তার একার নয়। আরবি ‘আরবাব’ একজন আছে তার পার্টনার। শুধু তার ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো খারিজীকে ওখানে ব্যবসা করতে হলে একজন ‘অতুনী আরবাব’ জোগাড় করে নিতে হয়। কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই সে ব্যবসায় অংশীদার হবে। ব্যবসার অংশীদাররা সবক্ষেত্রেই লাভক্ষতি ভাগাভাগি করে। কিন্তু এই ‘আরবাবরা’ ক্ষতির ধারেকাছে নেই। তাদের লাভ চাই। লাইসেন্স করার সময় এবং ফি বছর লাইসেন্স রিন্যু করার সময় তাদের হাতে মোটা অংকের ‘লাভ’ ধরিয়ে দিতে হয়। এর পরিমাণ ২-৩ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ দিরহাম (১ দিরহাম = বাংলাদেশি ১২ টাকা প্রায়) পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আল-আইন হচ্ছে রাজধানী আবুধাবির একটি শহর। এ শহরটি আয়তনে আমিরাতের সব শহরের চেয়ে বড়। সে তুলনায় জনবসতি কম। বাঙালিদের মধ্যে তিন শ্রেণির লোকজনের বাস সেখানে। তাদের মধ্যে সবচে ভালো অবস্থানে আছেন—সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মাত্র শিক্ষক। এর পরে আছেন স্ব নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা এবং তারপর সাধারণ চাকরিজীবী যাদের অধিকাংশই দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক।
খারেজীদের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের বেতন স্কেল অনুযায়ী তারা নাগরিক সুবিধা পেয়ে থাকে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক প্রমুখেরা ফ্রি ফার্নিশড, ৩ বেডরুমের বাসায় থাকে। তাদের ক্ষেত্রে নির্ধারণ করা থাকে ৪-৫ হাজার দিরহাম মাসিক ভাড়ার মধ্যে বাড়ি। সরকার থেকে তাদের বাড়ির ভাড়া দিয়ে দেয়া হয়।
প্রতি বছর নতুন আসবাব এবং দু বছর পরপর পুরো পরিবারের জন্য স্বদেশে যাওয়া আসার টিকেট ফ্রি দেয়া হয়।
আমিরাতে যে কেউ ইচ্ছা করলেই তাদের পরিবারকে নিয়ে আসতে পারে না। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী কমপক্ষে ৪ হাজার দিরহাম মাসিক বেতন না হলে কেউ পরিবার আনতে পারে না। এ নিয়ম অবশ্য মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষকদের ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য।
সরকারি ইমামদের সর্বোচ্চ বেতন ৩৪শ টাকা হয়ে থাকে। সাধারণত আবাসিক সুবিধা ছাড়া মূল বেতন ১৫ থেকে ২০ হাজারের মধ্যে থাকে। ইমামদের প্রত্যেকের জন্য অবশ্য মসজিদের সাথে থাকার ঘর থাকে। কারো ১ কামরা, কারো ২ বা ৩ কামরার ঘর।

অল্প বেতনে যারা চাকরি করছে তাদের মধ্যেও শ্রেণি বিভাগ আছে। এক শ্রেণি হচ্ছে যারা সরকারি কাজ করে, অপর শ্রেণি ব্যক্তি মালিকানার কোনো প্রতিষ্ঠানে। এদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ও অবস্থান অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। মিউনিসিপ্যালিটি, যেটাকে ওরা বলে ‘বলদিয়া’ ওখানেই প্রায় সকল সরকারি কর্মচারী। এঁদের বেতন ১৪-১৫শ দিরহাম মাসে। কাজের দক্ষতা ও অবস্থানের উপরে সর্বোচ্চ বেতন হয়ে থাকে ২৪শ দিরহাম। এ টাকার মধ্যেই সবাইকে নিজের থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য খরচের ব্যবস্থা করতে হয়। সরকার যে সুবিধাটুকু দিয়ে থাকে তা হলো—দু বছরে দুই মাসের বেতনসহ ছুটি এবং দেশে যাওয়া আসার টিকেট।
এসব শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশিদের খুব ভালো চোখে দেখে না এমন কথা বললেন কয়েকজন। তবে এক একটি পেশায় এক একটি দেশের শ্রমিকদের বিশেষত্ব আছে। বাংলাদেশি ডাক্তারদের খুব সুনাম। আবার সুনাম আছে বাঙালি ইলেকট্রিশিয়ান আর রং মিস্ত্রিদের। ‘অতুনী’রা ঘরকন্যার কাজে পছন্দ করে ফিলিপিনো মেয়েদের। তার অন্যতম কারণ, ওরা খুব অল্প বেতনে (মাসে ৪/৫শ দিরহাম) চাকরি করে, সংসারের যাবতীয় কাজ, রান্নাবান্না, বাচ্চাদের দেখাশোনা করা ছাড়াও মেয়েরা প্রত্যেকে ড্রাইভিং জানে। অতুনীদের যেহেতু প্রত্যেকের পরিবারে ৪/৫টা গাড়ি থাকে সেহেতু ড্রাইভিং জানা একজন কাজের বুয়া তাদের বাড়তি সুবিধা দেয়। অবশ্য এমনিতে মাটি কাটা ও ড্রাইভিং-এর জন্য পাঠানরা বিখ্যাত।
আল-আইন শহরে বেশিরভাগ বাঙালি ব্যবসায়ী পারফিউম ব্যবসা করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কারো কারো ২-৩টা দোকান থাকলেও কেউই দোকানের নাম পাল্টান না। যেমন, আল-আইন মেইন স্ট্রিটে আসাদ পারফিউমারি নামে ৩টি, আফিয়া পারফিউমারি নামে ২টি, নজিব পারফিউমারি নামে ২টি, সিটি পারফিউমারি নামে ২টি দোকান আছে। অবশ্য কারণ আছে। আরবরা খুব বেশি সুগন্ধিপ্রিয়। সার্বক্ষণিক তাদের সুগন্ধি চাই। তারা কিছু কিছু দোকানের নামের খুব ভক্ত। মাসের একটা নির্দিষ্ট তারিখে তারা আসে এবং দরদাম না করেই ব্যাগভরে পারফিউম নিয়ে যায়। এই শ্রেণির কাস্টমার যদিও খুব বেশি নয় তবুও এদের আগমন হঠাৎ করে তাদের ভাগ্যে বড় প্রভাব ফেলে। যে কারণে তারা নাম পরিবর্তন করতে চান না। এটা ছাড়াও একই নামে ভিন্ন দোকান হলে লাইসেন্সের ক্ষেত্রেও ঝামেলা কম হয়।
পারফিউমের দোকান ছাড়া আছে কিছু কসমেটিক্স ও গ্রোসারি শপ। বাঙালির পরিচালনায় আছে কয়েকটি হোটেল এবং টেইলারিং শপ। এসবের মালিক কর্মচারী প্রায় সবাই বাংলাদেশি।
আল-আইনে কয়েকটি শপিংমলের সামনের চত্বর সন্ধ্যাবেলা খারিজীদের আগমনে ভরে ওঠে। কোথাও পাকিস্তানি, কোথাও পাঠান, শিখ। তেমনি ‘বাঙালি বাজার’ নামে এমনকি ট্যাক্সিওয়ালাদের কাছেও যেটা পরিচিত হয়ে উঠেছে সেটা আল-আইনের নতুন মিউনিসিপ্যালিটির মার্কেটের সামনের চত্বর।

প্রতি সন্ধ্যায় এ চত্বরটি ভরে ওঠে বাঙালিদের কোলাহলে। বাঙালিদের বেশির ভাগই বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের। এছাড়াও নোয়াখালী, কুমিলাসহ অন্যান্য অঞ্চলের বাঙালিরা আছেন। সবচে বেশি সংঘবদ্ধ হলেন চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাঙালি। তারা আগে অবশ্য একই জায়গায় জড়ো হতেন। এখন আলাদা হয়ে গেছেন। শোনা যায়, কী একটা কারণে দু পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো ক’ বছর আগে। তারপর থেকে আলাদা। কেউ কারো পাড়ায় যান না। বা পাশের চত্বরে সিলেটি এবং ডান পাশের চত্বরে চট্টগ্রাম ও অন্যান্য অঞ্চলের বাঙালি। প্রতি শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি। এদিন বিকেল থেকেই এ দুটো চত্বর জমজমাট হয়ে যায়। ওখানে দাঁড়ালে মনে হবার কোনো কারণ থাকে না যে, বাংলাদেশের বাইরে কোথাও কেউ এসেছে। মুখ থেকে মুখে, কান থেকে কানে খবর ছড়ায় দেশের। দেশের প্রতিদিনকার তাজা খবর সেখান থেকেই ছড়ায়। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাঙালিরা সেখানে সবাই সবার প্রতি খুব সদয়। কারো চাকরি নাই বন্ধুবান্ধবরা তাকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে, টাকা ধার দিচ্ছে, চাকরি জোগাড় করে দিচ্ছে।
বাঙালি বাজারে এর মধ্যেও চলে ব্যবসা। যারা হুন্ডির ব্যবসা করে তারা চেক বই হাতে নিয়ে টুলের উপর বসে পড়ে। আমিরাতের টাকা দিয়ে বাংলাদেশি চেক পাওয়া যায়। এই চেক তারা দেশে পাঠান।
আমাকে পেয়ে বেশ কজন বাংলাদেশি অধীর আগ্রহে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার খবর জানতে চান। তাদের আগ্রহ মেটাতে পারি না। বলি—ঐ বিষয়ে আমার জ্ঞান যেমন কম তেমনি আগ্রহও নাই।
একজন বলে—‘হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসায় কোনো পরিবর্তন হয়নি?’ জবাব দিই, চোখে পড়ার মতো কোনো পরিবর্তন দেখিনা। আমার কাছে সব শাসককে একই রকম মনে হয়। সবাই ক্ষমতায় গিয়ে একই কাজ করে, ক্ষমতায় যাবার আগে বা ক্ষমতায় না থেকে সবাই একই কথা বলে। কথা ও কাজের কোনো পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন হয় শুধু কথাওয়ালা ও কাজওয়ালাদের। মদের বোতলের মতো। একই মদ কখনো লাল বোতলে, কখনো কালো বোতলে।
আরেকজন প্রবাসী বয়স প্রায় পঁয়তালিশের কাছাকাছি হবে। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে থাকেন। ১৬ বছর ধরে আছেন এই শহরে। গত ৭ বছর ধরে তিনি দেশে যাননি। আমার হাত ধরে রাস্তার এক কোনায় নিয়ে গেলেন। যেন, কতদিনের পুরোনো চেনা লোক। হ্যান্ডশেক করা হাত না ছাড়িয়ে যেন খুব গোপনীয় বিষয়ে শলাপরামর্শ করতে ডেকেছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন—‘আপনি ইঞ্জিনিয়ার মানুষ ভেতরের খবর রাখেন, আচ্ছা বলেন তো, বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়াররা তেল আর সোনা উঠাতে পারবে তো?’
একটু ভড়কে যাই। বলি—কোন সোনার কথা বলছেন?
—কেন পত্রিকায় লিখেছে, দিনাজপুরে সোনার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে, আপনি দেখেননি?
এরকম একটা সংবাদ কবে যেন পত্রিকায় পড়েছিলাম ঠিক মনে নাই। সংবাদটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু উনি মনে রেখেছেন খবরটাকে।
ভদ্রলোক তারপর বললেন—আমাদের দেশে গ্যাস আছে, তেল আছে, সোনা আছে। একদিন এগুলো থেকে কোটি কোটি টাকার সম্পদ উঠবে। কিন্তু আমরা তখন থাকবো না। এই রমলের (বালুর আরবি নাম ‘রমল’) দেশে গায়ের চামড়া ফেলে পড়ে আছি কতগুলো টাকার জন্য। নইলে আমাদের দেশের মতো সুন্দর দেশ দুনিয়ায় আর কোথায় আছে? আপনারা দেশে আছেন, সুখে আছেন, সুখে থাকেন। আমাদের দেখতে এসেছেন, দেখে যান—কিন্তু আমাদের দুর্দশার কথা কোথাও লিখবেন না, তাহলে আমাদের আত্মীয়স্বজনরা কষ্ট পাবে। বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক।
অপর একজন খুব চিন্তিত মুখে বললেন—ভাই আজ তো ডলারের রেইট আরো বেড়ে গেলো। কাল ছিলো এক টাকায় (দিরহামে) বাংলাদেশি এগারো টাকা পঁয়তালিশ পয়সা, আজ হয়েছে পঁয়ষট্টি পয়সা। বলি—‘তাতে তো আপনাদেরই লাভ। দিরহামের বিনিময়ে টাকা বাড়বে।’
‘না-ভাই, লাভ আমাদের হলে কী হবে?’ ভদ্রলোক চিন্তিত মুখে বললেন—‘ডলারের কাছে টাকার মান যে কমে গেলো?’ এভাবে চলতে থাকলে তো দেশের উন্নতি হবে না।’
তরুণদের মধ্যে যারা আল-আইনে আছে, তাদের অধিকাংশেরই বয়স কুড়ি থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। তাদের প্রায় সবাই ২০/২২ বছর বয়সে এখানে আসে। কিন্তু ফিরে যেতে পারে না নানা কারণেই। এদের মধ্যে অনেকেই চেষ্টা করে যে কোনোভাবে যদি পশ্চিমের কোনো দেশে রুজি-রোজগারের জন্য যাওয়া যায়।

সাধারণত শ্রমিকদের মধ্যেও এক ধরনের অসন্তোষ কাজ করছে এখানে থাকার ব্যাপারে। তারা মনে করছেন, আমিরাত সরকারের কাছে এখন তাদের আর কদর নেই আগের মতো। বড় বড় দালান ইমারত, রাস্তা, যা কিছু বানানোর ছিলো সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে, এখন তার প্রয়োজন সিকি ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে, সুতরাং অতিরিক্ত শ্রমিকদের আজ তার প্রয়োজন নেই। সে কারণে কমিয়ে দিয়েছে বেতনভাতা, সুযোগসুবিধা। আগে ফ্রি ভিসা নিয়ে যারা এখানে আসতো তারা নানাভাবে বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম জুটিয়ে নিতে পারতো। এখন নতুন কানুন করেছে, যে প্রবাসী যে নির্দিষ্ট আরবাবের স্পনসরশিপ নিয়ে এখানে এসেছে, তাকে সেই আরবাবের অধীনেই কাজ করতে হবে। অন্যথায় সোজা জেল, যতক্ষণ পর্যন্ত না ফেরত যাবার টিকেটের বন্দোবস্ত হয়েছে ততদিন জেল বাস এবং অতঃপর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এবং এই ব্যবস্থার ফায়দা নিয়ে নিচ্ছে স্ব স্ব নিয়োগকারী। তারা ও তাদের কর্মচারীদের রেখেছে কঠিন নিয়মের মধ্যে। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত যদি ডিউটি থাকে, তবে ঠিক পাঁচটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে গেট বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ মিনিট বিলম্বে কারখানায় গেলে কাজ করার সুযোগ থাকবে না। সেই দিনকে অনুপস্থিত হিসাব করা হবে এবং একদিনের অনুপস্থিতির কারণে তার তিনদিনের মাইনে কাটা যাবে।
যেসব প্রবাসীরা শরিকা (কোম্পানি) গুলোতে কাজ করে, তারা কেউই দেশে থেকে সেসব কাজ করে বা শিখে যায়নি। ওখানে গিয়ে শিখতে হয়েছে। এমন একজন বললো—চাকরিতে যখন ইন্টারভিউ দিতে যাই, তখন হাত ধরে পরীক্ষা করে। হাতের তালু নরম হলে তাকে নেয়া হয় না। এক্ষেত্রে যারা দেশে কোদাল মাটি টেনেছে, তাদের জন্যে চাকরি পেতে সুবিধা। পরনের কাপড়চোপড়ের মধ্যেও থাকতে হবে মালিন্য। ফিটফাট পোশাকে শরিকায় চাকরি পাওয়া যায় না।
মূল আরবিদের এইসব প্রবাসীরা ডাকে ‘বুদ্দু’ বলে। ‘বুদ্দু’ মানে বোকা। কিন্তু এখানে বুদ্দু বলতে বোঝায় সেই সব আরবি যারা আমিরাতের প্রকৃত নাগরিক। আগে এক সময় এটা একটা গালি ছিলো। এখন নাম হয়েছে। কোনো আরবি বুঝে ফেলে যে এটা তাদের হেয় করার জন্য ডাকা। সেক্ষেত্রে অনেক সমস্যাও হয়েছে কোনো কোনো বাঙালির। এজন্য এ নামটি তারা গোপনে, আড়ালে ডাকে। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার জন্য ডাকে।

তেমনি এক ব্দ্দুুকে নিয়ে বিপদে পড়েছে বাবু। কয়েকমাস আগে তার বাসায় স্যানেটারি আইটেমের কিছু কাজ করিয়েছিলো। টাইলস লাগানো, ফিটিং রিপেয়ারিং। কন্ট্রাক্ট ছিলো ২৮ হাজার দিরহামের। কাজ শেষ। কাজের সময় হাজার দশেক দিরহাম বাগিয়েছিলো, কাজ শেষে বাকি টাকা উঠাতে পারছে না। আজ না, আগামী সপ্তাহ। আগামী সপ্তাহে হাজির হলে সামনের মাসে। এই করে করে ৬ মাস পার হয়ে গেছে। টাকা উঠাতে পারছে না। এ সব বুদ্দুদের নিয়ে অভিযোগ যেমন আছে, বুদ্দুদের সুনামও প্রচুর। টাকা খরচ করে তারা দু হাতে। বিল পাঠালে ভালো করে পড়ে দেখেও না, যদিও বেশির ভাগ বুদ্দু পড়ালেখা জানে না। তাদের মর্জি ঠিক থাকলে হাতে হাতে পেমেন্ট করে দেয়, মর্জি ঠিক না থাকলে ইচ্ছামতো ঘোরায়। এসব ঘোরানোর মধ্যে তারা হয়তো আনন্দও পায়। পয়সা না দিয়ে যদি আনন্দ পাওয়া যায়, এই আনন্দ গ্রহণ করতে অসুবিধা কোথায়?
কিন্তু যে সব তরুণ সস্তা শ্রম বিকোচ্ছে মরুর প্রান্তরে, তারা প্রায় সবাই নিজেদের নিয়ে খুব হতাশ। তরুণরা তাই ছোটোছুটি করছে ওখান থেকে ইউরোপের কোনো দেশে চলে যেতে। কেউ বা কিছু টাকা নিয়ে ফেরত আসতে চাইছে নিজের মাটিতে। ২৪-২৫ বছর বয়সি সাবুদ্দিন চাকরি করে এক শরিকাতে। মাসে ওভারটাইমসহ ১৪-১৫শ দিরহাম বেতন পায়। ঘরভাড়া ২শ, খাওয়া ও অন্যান্য খরচে আরও দুই তিনশ চলে গেলে মাস শেষে তার হাতে থাকে ৮শ থেকে হাজার খানেক দিরহাম। এই টাকা মাসের শেষে সে তার বড় ভাইয়ের হাতে পৌঁছে দেয়। বড় ভাই থাকেন আল-আইন থেকে প্রায় ৪০ কি. মি. দূরে। সপ্তাহে একবার আসেন। সাবুদ্দিনের হিসাব মতো আরো বছরখানেক এখানে কাজ করে যা জমবে তা নিয়ে দেশে চলে যাবে। বিয়ানীবাজার শহরে একটা রেস্টুরেন্ট খুলবে—দুই লাখ টাকা খরচ করে। আর কখনো মিডলইস্ট ফিরে আসবে না।

আল-আইন শহরে প্রবাসী বাঙালিদের সর্ববৃহৎ অংশটি থাকেন শহরের কাছাকাছি ‘সাবিহা’গুলোতে। সাবিহা মানে গ্রাম। কিন্তু গ্রাম বলতে আমাদের চোখে যে শ্যামল স্নিগ্ধ চেহারা ভাসে, মরুভূমির গ্রাম সেরকম কিছু নয়। প্রায় দু ফুট পুরু মাটির দেয়াল, ছোট্ট এক চিলতে জানালা, কোথাও আছে কোথাও নেই। আট ফুটের মতো উঁচু ঘর, যার ছাদ তৈরি হয়েছে খেজুর গাছের ফালির উপর পাটি, শন বিছিয়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। এসব বাড়িতেই বিশ বছর আগেও এখনকার বড় বড় শেখ সাহেবরা থাকতেন। বাড়ির মাঝখানে ছোট্ট উঠান, তার এক কোণে কুয়ো থাকতো। উঠানের চারপাশ ঘিরে এক লাইনের ছোট্ট ছোট্ট খুপরি। ঘরের আয়তন ১র্০দ্ধ১র্২ এর মতো। সেই বাড়িগুলো এখন ভাড়া নিয়ে থাকেন খারিজী শ্রমিকেরা। পরিবর্তন এসেছে শুধু কুয়োর বদলে হাম্মামের। প্রতি ঘরে সেই পুরোনো কাঠামোতে নতুন যোগ হয়েছে একটি করে পুরোনো এয়ারকন্ডিশনার। মেজের উপর দেয়াল থেকে দেয়ালে কার্পেট। ঘরের আয়তন অনুসারে ৩/৪ জন এক ঘরে থাকেন। দেয়াল বরাবর একটি করে ছোট সিঙ্গেল খাট বিছানোর পর মাঝখানে যে ছোট্ট জায়গাটুকু থাকে তাতে সবাই মিলে বসে খানাপিনা করেন। প্রতি বাড়িতেই বিভিন্ন দেশের খারিজীরা থাকেন। বাঙালিদের সাথে পাঠান, শিখ, ইরানি, আফগানিস্তানি, এসব। তবে একই রুমের ভেতর দুই জাতির বা দেশের কাউকে দেখা যায়নি।

ঘরগুলোর ভাড়াও বেশ উঁচু। এসব অতি নীচুমানের বসবাস অনুপযোগী ঘরগুলোর ভাড়া মাসে ৬/৭শ দিরহামের কম নয়। তবে কোথাও কোথাও যেসব শ্রমিকদের শরিকায় কাজ করেন, শরিকাগুলো থেকে তাদের সাইট সংলগ্ন এসব পরিত্যক্ত ঘরবাড়িতে থাকতে দেয়।
রান্নাবান্নাতে প্রবাসীরা সবাই পাকা। সবাই সব কাজ করতে পারেন। যিনি নতুন আসেন, তাকে প্রথমে কিছুদিন ছাড় দেয়া হয়। রুমমেট রেধেবেড়ে দেন। তারপর ধীরে ধীরে হাতে ধরিয়ে শেখানো হয়। এবং আস্তে আস্তে একদিন পাকা রাধুনী (শব্দটা পুংলিঙ্গে হবে)-তে পরিণত হয়ে যান। এ পুরুষ রাধুনীদের রান্না খেয়ে সেই পুরোনো কথাটাই মনে পড়েছে বারবার—পৃথিবীর সবচে সেরা কুকের সবাই-ই পুরুষ।
খাওয়াদাওয়ার জিনিসপত্তরও পর্যাপ্ত এবং বেশ সস্তাই। আমাদের প্রবাসী বাঙালিরাও আরবদের মতো ভাত মাছের চেয়ে ফলমূলের প্রতিই বেশি আকৃষ্ট। রাতে ও দুপুরে খাবারের পর মোটা প্লেটে ফলমূল নিয়ে বসেন। এসব অনেক কিছুই অনেক কষ্টে এবং শ্রমের বিনিময়ে আমিরাতেই উৎপন্ন হয়। তবে ভারত পাকিস্তান থেকে আঙ্গুর, আম, কমলা আসে বেশি। খেজুর অতি সস্তা বলেই হয়তো, এর বেশি কদর নাই। রাস্তার পাশে খেজুর গাছ থাকে, যার যতটুকু ইচ্ছা পেড়ে নেয়া যায়, কিন্তু শর্ত থাকে—খেজুর পাড়তে গিয়ে রাস্তা ময়লা করা যাবে না। খেজুর পাড়তে গিয়ে ডাল ভেঙ্গে রাস্তায় পড়লে জরিমানা ৫০০ দিরহাম। এই জরিমানা করতে পারে বলদিয়ার লোকজনও। রাস্তাঘাটের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে দুজন কর্মচারীকে পাওয়া যাবে না। এদেরও বেশির ভাগ ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের।

খেজুরের জন্যে বিখ্যাত মরুভূমিতে গিয়ে বাংলাদেশের খেজুর গাছ সম্পর্কে মজার খবর পাওয়া গেলো। এরশাদ সরকারের আমলে আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ জায়িদ একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। সে সময় তাকে বাংলাদেশি খেজুর ও খেজুরের রস খাওয়ানো হয়েছিলো। শেখ জায়িদের সেই খেজুর গাছ ও খেজুরের রস খুব পছন্দ হয়েছিলো। দেশে এসে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই খেজুর গাছ আল-আইন লাগিয়ে সেখান থেকে রস নেয়ার। একজন প্রবাসী বাঙালি বললেন—আল-আইনে ঐ খেজুর গাছ বাংলাদেশ থেকে আনিয়ে লাগানো হয়েছিলো, সেই খেজুর গাছ থেকে রসও নেয়া হয়েছিলো—কিন্তু আরবরা এই গাছগুলো দিয়ে খুব সুবিধা করতে পারেনি। কয়েক বছর পর গাছগুলো মরে যায়।
দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে আল-আইন আসার পথেই ছানু খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলেছিলো—শাকুর, তোমার জন্য আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি—একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। তোমার ভাবির সিদ্ধান্ত হলো—তুমি যা রায় দেবে তাই হবে।
বললাম—বিষয় কী?
ছানু বললো—বিষয়টি বড় জটিল। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা এখানে থাকবো না দেশে চলে যাবো। দেশে ফেরত গেলে কী করবো, ঢাকায় থাকবো না সিলেট থাকবো, না বাড়িতে চলে যাবো।

খানিকটা অবাক হলাম। ১৬০ কিলোমিটার বেগে চলা গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে শনশন শব্দ করে বাতাস আসছে। ছানু চেয়েছিলো জানালা বন্ধ করে এসি ছেড়ে দিতে। কিন্তু আমার তাতে সায় ছিলো না। মরুভূমির দেশে যখন এলাম তাদের ধুলোবালির গন্ধ যদি নাই শুঁকলাম তবে আর এখানে আসা কেন। মরিচই যদি খাবো তো হোয়াই নট ঝাল মরিচটা।
হাত দিয়ে জানালার কাচটা উঠিয়ে ঠিক হয়ে বসলাম। বললাম—‘ফিরে যেতে চাচ্ছো কেন? দেশ থেকে যারা একবার বেরিয়ে যায়, তারা আর কি সহজে দেশে ফিরে যেতে পারে?’
‘তোমার কথা হয়তো ঠিক।’ ছানুও বসলো নড়ে চড়ে। তারপর বললো—‘কিন্তু এই দেশের এখনকার পলিসি হচ্ছে ফরেনার খেদাও। ওরা দুইদিন পরপর এমন সব নিয়মকানুন আবিষ্কার করছে, যাতে বিদেশিরা ধীরে ধীরে তল্পিতল্পা গুটিয়ে যার যার দেশে চলে যায়। সবচে বেশি চিন্তিত আমার বাচ্চাদের লেখাপড়া নিয়ে। ওদের ঠিকমতো পড়াশোনা করাতে না পারলে আমার এই জীবনের কোনো মূল্য নেই।’
ছানুর ছেলেমেয়ে চারজন। বড় ছেলে মিন্টুর বয়স ১৩, সে পড়ে একটা ইন্ডিয়ান স্কুলে। আমিরাতের স্বদেশি আর বিদেশিদের মধ্যে সব সময় একটা শ্রেণি বিভাগ আছে। আমিরাতের নাগরিকদের জন্যে যেসব স্কুল কলেজ আছে, সেখানে কোনো বিদেশির পড়ালেখার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি অনেক ক্লাব রেস্টুরেন্টও আছে। এখানে বিদেশিদের প্রবেশাধিকার নেই।

বিদেশিদের ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম ইন্ডিয়ান স্কুলে পড়ে। আল-আইনে অবশ্য একটা বাংলাদেশি স্কুল আছে, সেখানেও বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। কিন্তু তার গুণগত মান ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রবাসীদের অভিযোগ এসেছে।
বিদেশিরা আমিরাতের যে কানুনটি নিয়ে সবচে বেশি শংকিত তা হচ্ছে—১৮ বছর বয়স হবার পর কোনো বিদেশি আমিরাতের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পারবে না, তবে পড়াতে পারবে। পড়াতে পারবে এ জন্যেই যে, আমিরাতের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো পূর্ণ নাগরিক এখনও তাদের মধ্য থেকে হয়ে উঠেনি।
আল-আইনে এক বাংলাদেশির আকামায় (পরিচয়পত্রের আরবি নাম) চোখ বুলিয়ে অবাক হলাম। কারণ পরিচয়পত্রটি বিদেশির জন্য, কিন্তু সম্পূর্ণ আরবি ভাষায় লেখা। তাকে বললাম—বাহ্! তাদের মাতৃভাষার প্রতি এতো শ্রদ্ধা?
ভদ্রলোক আমার মুখের উপর জবাব দিলেন—কীসের মাতৃভাষা?
এটা করা হয়েছে পুলিশদের জন্য। আরবি পুলিশেরা কি ইংরেজি জানে? অবশ্য এখন কিছু কিছু পুলিশ ইংরেজি বুঝতে ও পড়তে পারে, কিছু কিছু শরিকা ইংরেজি ও আরবি ভাষায় আকামা ছাপাচ্ছে। আরবরাও এখন ধীরে ধীরে শিক্ষিত হয়ে উঠছে।
তার কথায় সত্যতা পেলাম ইউএই ইয়ারবুক ১৯৯৫-এ। সেখানে তাদের শিক্ষাবিস্তারের যে সরকারি ফিরিস্তি ছাপা হয়েছে তা থেকে তাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার একটা নমুনা পাওয়া যায়।
১৯৭০ সালে আমিরাতের নাগরিকদের মাত্র ২২% ছাত্র সেকেন্ডারি স্কুলে যেতো। ২০ বছরের ব্যবধানে স্কুলগামী ছাত্রদের সংখ্যাটি ১৯৯০-এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭%। এবং দিনে দিনে সংখ্যাটি ক্রমাগত বেড়েই চলছে।
সিকি শতাব্দী আগেও আমিরাতের বড় বড় শহরগুলোর সবকটিতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো না। আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ জায়িদের পক্ষেও কোনো শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ ছিলো না। সে কারণেই শিক্ষা বঞ্চিত এই পূর্বপুরুষেরা উঠেপড়ে লেগেছে ধন-দৌলত ও জৌলসে ভরা আমিরাত সাম্রাজ্যের প্রতিটি নাগরিককে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসরমান করে তুলতে। বর্তমানে সকল স্তরের শিক্ষা উপকরণকে আমিরাতের নাগরিকদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি করে দেয়া হয়েছে এবং দিনে দিনে তার সুফলও আসতে শুরু হয়েছে। ২৪ লাখ জনগোষ্ঠীর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে এখন ৫ লাখের বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। মজার ব্যাপার পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় আমিরাতের মহিলারা শিক্ষাদীক্ষায় পুরুষের চেয়ে সংখ্যা গুণ মানে অনেক বেশি এগিয়ে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়টি আল-আইনে অবস্থিত এবং ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪,৫৯৩ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পেরেছে। এদের মধ্যে পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা যথাক্রমে ৫,৬৯৫ ও ৮,৮৯৮। ১৯৯৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩৮২ জন ছাত্র এবং ১০২১ জন ছাত্রী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে।
সেকেন্ডারি পর্যায়ে ১৯৯৫ সালে ৩,০৪,০০০ ছাত্রছাত্রী ৬০৮টি সরকারি স্কুলে এবং ১,৯০,৭৩৭ জন ৩৯০টি বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করছে। সরকারি স্কুলে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ২৫,০৮৪ যার মধ্যে মাত্র ৮,২০০ শিক্ষক আমিরাতের নাগরিক। বাদবাকি প্রায় ১৬ হাজার শিক্ষক বিদেশি।
১৯৭১ সালে সংযুক্ত আরব-আমিরাত যখন ব্রিটিশ বলয় থেকে মুক্ত হলো, তখন থেকেই শিক্ষাদীক্ষার উন্নয়ন হয়। ১৯৬৮ সালে আমিরাতে অশিক্ষিতের পরিমাণ ছিলো ৭৯%, ১৯৮০ সালে এ সংখ্যা নেমে আসে ২৮.৪%। ১৯৯৩ সালে আমিরাতের নাগরিকদের মাত্র ১৬.৮% ছিলো অশিক্ষিত। এ সংখ্যাটি ধীরে ধীরে বিলীন হতে চলেছে।
শিক্ষাখাতে সরকারি বরাদ্দও রয়েছে পর্যাপ্ত। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিলো ৩শ ১৭ কোটি ৪০ লক্ষ দিরহাম (প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা) এ বরাদ্দ ছিলো ২ লাখ ৯১ হাজার ছাত্রছাত্রীদের জন্য। সে হিসেবে মাথাপিছু প্রতি ছাত্রের জন্য বরাদ্দ ছিলো ১০ হাজার ৯শ দিরহাম।

১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট শেখ জায়িদ দেশব্যাপী কর্মসংস্থান প্রচারণার নির্দেশ দেন। তাঁর কথা ছিলো কোনো সুস্থ সবল যুবক যেন ঘরে বসে বেকার জীবন না কাটায়। যে যে বয়সের এবং যে যোগ্যতারই হোক সে কাজে যোগ দিক, সরকার তার কর্মসংস্থানের দায়িত্ব নেবে।
শেখ জায়িদের এ আহŸানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন বয়সি আমিরাত নাগরিক কাজে যোগ দেয়। সরকারি হিসেব মতে এদের মধ্যে ১৮ বছর বয়সের নিচে ৪১২ জন, ১৮-২৯ বছর বয়সি ৮,৩৬২ জন, তিরিশোর্ধ্ব ৩,০৪৮ জন, চলিশোর্ধ্ব ১,৮১৬ জন, পঞ্চাশোর্ধ্ব ১,১২২ জন এবং ষাটোর্ধ্ব ৮৩৫ জন এই ১৫,৫৯৪ জন কর্মসংস্থান প্রত্যাশীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও কম (মাত্র ৪,৭৫১ জন) ছিলেন পুরুষ, বাদবাকি সবাই মহিলা। কর্ম-প্রত্যাশীদের মধ্যে ২ জন ছিলেন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী, ১৬ জন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী, ১৭ জন স্নাতকোত্তর।
ডিপ্লোমাধারী, ২২৭ জন বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী, ৩৩ জন হাইস্কুল উত্তর ডিপ্লোমাধারী এবং ১০৪০ জন ছিলেন স্কুল সার্টিফিকেটধারী। এদের প্রত্যেককেই সন্তোষজনক পদে চাকরি দেয়া হয়।
সরকারি এসব পৃষ্ঠপোষকতার অনুক‚ল প্রভাব পড়ছে আমিরাতের নাগরিকদের উপর। সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনী ছাড়াও বিভিন্ন অফিস আদালতে আমিরাতের শিক্ষিত নাগরিকেরা নিয়োগ পাচ্ছেন। প্রেসিডেন্টের এক ভাষণ থেকে বোঝা যায়, অনেক নাগরিকই কাজ করতে আগ্রহী নয়, তারা বেকার থাকা পছন্দ করেন। তিনি তার ভাষণে বলেন—‘আমি বুঝে উঠতে পারি না, কেন শুরুতেই বড় মাইনের চাকরি ছাড়া তারা কোনো কাজ করবে না? একজন নাগরিক যে সদ্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিল, তার কাজের শুরুতেই বেতন নিশ্চয়ই একজন অফিসারের সমান হবে না।’ অবশ্য আমিরাত নাগরিকদের কাজের প্রতি অনীহার মূল কারণ যে তাদের ভরণপোষণের চিন্তা নেই। সরকার থেকে তাদের পরিবারের জন্য ভাতা আছে।

এক প্রবাসী জানালেন, আমিরাতের কোনো নাগরিক যদি মরুভূমির কোনো অংশে চাষবাস করতে চায়, তা হলে নির্দিষ্টমানের জমিটাকে সরকারি খরচে চাষাবাদ উপযোগী করে দেয়া হবে। পানির ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা এবং লোকবল দিয়ে তাকে চাষে উৎসাহিত করা হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সরকার সেই চাষির কাছ থেকে চড়া মূল্যে সেসব দ্রব্যের গোটাটি কিনে বাজারে ছাড়বে নামমাত্র দামে।
আমিরাত সরকারের উদ্দেশ্য তার নাগরিকদের বসিয়ে না খাইয়ে কাজে লাগানো। যে কারণে, যে কোনো নাগরিক সরকারের কাছে চাকরি চাওয়া মাত্র তার একটা কর্মসংস্থান হয়ে যায়। কর্মসংস্থান হয় তার যোগ্যতা অনুসারে।
১৪ মে, ১৯৯৭ তারিখের ‘গালফ নিউজ’ পত্রিকার একটা খবর আমার নজর টানলো। কাগজটি লিখেছে যে, আমিরাত সরকার আশা করছে ২০১০ সালের মধ্যে আমিরাতের গ্র্যাজুয়েটরা সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল পোস্টগুলোর ২০ শতাংশ পূরণ করতে পারবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি শিক্ষা পরিচালক আলেম আল শামসীর উদ্ধৃতি দিয়ে কাগজটি লিখেছে, ইউএইতে প্রতি বছর প্রায় ৯ হাজার কারিগরি পদ তৈরি হয়, কিন্তু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বছরে ৩০০ জনের বেশি গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারছে না।
একই রকম আরেকটি খবর ছাপা হলো খালিজ টাইমস পত্রিকায়। এ খবরে ব্যাংকিং সেক্টরে আমিরাতের নাগরিকদের পদ তৈরির ব্যাপারে একটা আইন প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরের চেয়ারম্যান ও যোগাযোগমন্ত্রী আহমেদ হুমাইদ আল তায়েব-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, আমিরাত সরকার আশা করছে আগামী দশ বছরের মধ্যে ব্যাংকিং সেক্টরে ৫০ শতাংশ অফিসার নাগরিকদের মধ্যে থেকে নেয়া যাবে। বর্তমানে এই সেক্টরের কর্মকর্তাদের মাত্র ৯ শতাংশ আমিরাত নাগরিক।
এসব ক্ষেত্রে লেখাপড়া জানা কোনো নাগরিক তার পছন্দের কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে চাইলে আমিরাত সরকার তার জন্যে একটি পদও তৈরি করে দেবেন অনায়াসে। চাকরিতে যোগদানের প্রথম দিনেই একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় অনেক খারিজী অফিসারকে ডিঙিয়ে উঁচু চেয়ারটিতে হবে তার আসন।
এসব কারণেই প্রবাসীদের মনে একটা আশংকা কাজ করছে বড় বেশি। তাদের ধারণা মরুভূমির দেশে বেশিদিন হয়তো আর স্থায়ী হওয়া যাবে না। তবে সবচে বেশি দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকেন, যারা সন্তান নিয়ে সেখানে আছেন এবং যাদের সন্তানের বয়স আঠারোর কাছাকাছি।
আছাদউদ্দিন নামক এক বাঙালি প্রবাসী। প্রায় কুড়ি বছর ধরে আছেন
আল-আইনে। প্রথম দিককার বাঙালি ব্যবসায়ী। প্রায় স্থায়ীভাবে তিনি ব্যবসা পেতে আছেন। তিন তিনটি পারফিউমারি শপ আছে। এখন নিজে কোনোটাতেই বসেন না, বয়স হয়েছে। কর্মচারীরা দেখাশোনা করছে। কিছুদিন আগেও তিনি উ™£ান্তের মতো চিন্তিত ছিলেন তার অত্যন্ত মেধাবী কন্যাকে নিয়ে। অত্যন্ত ভালো গ্রেড নিয়ে এ-লেভেল পাস করার পর মেয়েটাকে উচ্চতর পড়ালেখা করানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। যেহেতু আমিরাতের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিদেশির সহজ স্থান নেই, এবং নিজে পরিবার নিয়ে আমিরাতেই থাকবেন, মেয়েটাকে বিলেতের এক বাঙালি ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া ছাড়া তাঁর কাছে ভালো কোনো বিকল্প হাতে ছিলো না।
আল-আইন হাসপাতালের বাংলাদেশি চিকিৎসক মেসবাহ তার ত্রয়োদশী কন্যাকে নিয়ে এখন থেকেই চিন্তিত। কথায় কথায় বললেন—মেয়েটার বয়স আঠারো হয়ে গেলে আমি হয়তো দেশেই ফিরে যাবো।
কিন্তু সবাই কি স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আসতে পারবে?
ছানুর সবচে বড় ভাই নুরউদ্দিন সাহেব আটষট্টি সালে এসেছিলেন আল-আইনে। মামাদের সাথে নিয়ে আগরের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আগরের ব্যবসা বেশ লাভজনক। তার সাথে যোগ হয়েছিলো নানারকম পারফিউম ও কসমেটিক্স। ব্যবসার পসার তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি আমিরাতের মাটিতে। ছেলেমেয়ে বড় হবার সাথে সাথে পাড়ি দিয়েছেন কানাডায়। বিনিয়োগকারী হিসেবে কানাডার নাগরিকত্ব নিয়েছেন সপরিবারে। ছেলেমেয়েরা এখন সেখানেই পড়াশোনা করছে।
তেমনি মোস্তফা কামাল, আরেক তরুণ ব্যবসায়ীও কানাডার ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এসেছেন ক’দিন আগে। একমাত্র উদ্দেশ্য—আমিরাত আজ হোক কাল হোক ছেড়ে দিতে হলে—যেন ওখানে ঠাঁই নেয়া যায়।

ছানু বলে, জানো শাকুর—এই তেল আর সোনার খনির দেশে বিদেশিদেরকে তারা মানুষ মনে করে না—কিন্তু তারপরও কেউ সহজে এদেশ ছাড়তে চায় না। তার প্রধান কারণ, এখানে তোমার নিরাপত্তা আছে। তুমি সারারাত দরোজা খুলে ঘুমাতে চাও ঘুমাও, কেউ তোমার ক্ষতি করবে না। লাখ টাকার বান্ডিল হাতে নিয়ে মাঝরাতে বাজার থেকে আসো, কেউ তোমার হাতের দিকে তাকাবেও না। অসুখ বিসুখে তো কথাই নেই, বছরে ৩০০ দিরহাম দিয়ে হেলথ কার্ড করো—আর সারা বছর ধরে অসুখের চিকিৎসা করাও। সবকিছু ফ্রি। খাওয়াদাওয়া সস্তা, পানি বিশুদ্ধ, বাতাসটা যদিও গরম কিন্তু দূষিত নয়। মানুষজন ঠকবাজ নয়, ব্যবসা করে মজা পাওয়া যায়। কিন্তু সেটাও বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে—ছেলেমেয়েরা এখন যে পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে বেড়ে উঠছে তাদের জন্য দেশে গিয়ে দেশের সাথে একাকার হওয়াও তো সহজ নয়।
ছানুর কোনো কথাই ফেলে দেয়ার মতো নয়। দেশে থাকলে তার ছেলেমেয়েরা গ্রামের হাইস্কুলে পড়তো। সেখানকার পড়াশোনার মান সম্পর্কে কারো অজানা নয়। আজ ঘরে বাইরে তার ৮/১০ বছরের ছেলেও চমৎকার ইংরেজি বলতে পারে, পড়তে পারে। ঘরের মধ্যেও তার সেই চর্চা রয়েছে। আরো দু-একটা পরিবারেও দেখেছি, তারা ঘরেও তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না। স্কুলে ইংরেজি প্রধান ভাষা থাকলেও আরবি এবং মাতৃভাষা—এই তিনটে ভাষাই প্রাথমিক স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হয়। এবং মজার ব্যাপার, ছানুর বড় ছেলে মিন্টু জানালো—আরবি হাতের লেখা পরীক্ষায় সে অনেকের আরবির চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে কয়েকবার।
কিন্তু আমার মনে হয় হিসাবটিও হয়তো ঠিক নয় তাদের যে, একদিন সকল বিদেশির প্রয়োজন তাদের ফুরিয়ে যাবে। কেননা কাঁচা বাজার, সুপার মার্কেট, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, এসকল ব্যবসায় আরবিরা এখনও সরাসরি আসেনি। তাদের এসব ব্যবসা করার প্রয়োজনও নেই, সম্ভবত হবেও না। অফিস আদালতে বড় বড় কর্মকর্তা হিসেবে এখন যারা গালফের অন্যান্য দেশ যেমন সিরিয়া, মিশর, লেবানন, ইরাক, ইরান, ফিলিস্তিন এবং পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের খারিজীরা কাজ করছেন, তাদের স্থানগুলো ধীরে ধীরে আমিরাতের নাগরিকরা দখল করবে ঠিক। তবে ছোটখাটো কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শ্রমিক শ্রেণির চাহিদা পূরণের জন্য তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মুখোপেক্ষী অন্তত আরো পাঁচ দশক থেকেই যাবে।
স্বাস্থ্যসেবায় আমিরাত

হাসপাতালের গেটে মোস্তফা আটকা পড়েছে তার চার বছরের ছেলে তাহমিদকে নিয়ে। মোস্তফা যতই বোঝাতে চাইছে যে, ছেলেটার মা তিনদিন ধরে তাকে দেখেনি। এক মিনিটের জন্য সে তার ছেলেটাকে মার কাছে নিয়ে যেতে চায়। গেটের দারোয়ান নাছোড়বান্দা। কোনোভাবেই সে ছেলেটিকে হাসপাতালে ঢুকতে দেবে না।
কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে এক ফিলিস্তিনি নার্স এসে হাজির। আরবিতে কথা বিনিময় হলো দুজনে। মোস্তফা খুশি মুখে ফিরে এসে গাড়িতে উঠলো ছেলেকে অন্য কোথাও রেখে আসবে। বললাম—ব্যাপার কী? মোস্তফা বললো, নার্স বলেছে—শিলার সামান্য জন্ডিসের লক্ষণ দেখা গেছে, এ অবস্থায় ছেলেকে মার কাছে নিলে মার থেকে রোগটা ছেলের শরীরে চলে আসতে পারে। সে জন্যে মার বিপদ না কাটা পর্যন্ত ছেলেকে নেয়া যাবে না।
আমিরাতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে সবাই খুব খুশি। আমিরাতের নাগরিকদের জন্য সব ধরনের চিকিৎসা, ওষুধ সম্পূর্ণ ফ্রি। বিদেশিদের জন্য রয়েছে হেলথ কার্ডের ব্যবস্থা।
মোস্তফার একটা মেয়ে হয়েছে ২ দিন আগে আল-আইন হাসপাতালে। জন্মের দ্বিতীয় দিনেও মার কাছে বাচ্চাকে দেয়া হলো না। ডাক্তার বললেন—এই সময়ে বাচ্চাটি যে পরিমাণ ওজন নিয়ে পৃথিবীতে আসার কথা তার চেয়ে ওজন খানিকটা কম। ওজন না বাড়া পর্যন্ত তাকে মার কাছে দেয়া হবে না।
মোস্তফার অবশ্য এ নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। আমিরাতের চিকিৎসাব্যবস্থার উপর এখানকার সকল বৈধ অভিবাসী খুব সন্তুষ্ট। এমনিতেও হাসপাতালগুলোতে বেড বা চিকিৎসকের কোনো সংকট নেই। প্রতি ৮.৫৩ রোগীর জন্য ১টি করে বিছানা, প্রতি ৩.১১ জন রোগীর জন্য একজন সার্বক্ষণিক ডাক্তার। ১৯৯৫ সালের হিসাব মতে সমগ্র আমিরাতে ৩ হাজার ডাক্তার আছেন। সে হিসেবে প্রতি ৬শ জনে ডাক্তার ১ জন, নার্স আছেন ২২৫ জনে এক। সে বছর পর্যন্তও আমিরাতে ৩৫টি সরকারি হাসপাতাল, ৯৮টি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। মেডিকেল সেন্টারগুলোতে বিছানার সংখ্যা ৪৪০৩টি। কোনো রোগী যে কোনো অসুখে পড়লে প্রথমে যাবে মেডিকেল সেন্টারে। সেখানে প্রাথমিকভাবে রোগ নিরূপণ করবেন ডাক্তাররা। তারা যদি সেটাকে জটিল মনে করেন তবেই পাঠাবেন হাসপাতালে। মেডিকেল সেন্টারের রিকমেন্ডেশন ছাড়া হাসপাতাল কাউকে ভর্তি করে না।
আল-আইনে আছে দুটো হাসপাতাল। গুণ ও মানের দিক দিয়ে আল-আইন হাসপাতাল দ্বিতীয়, প্রথম হচ্ছে তাওয়ান হাসপাতাল। আল-আইন হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রায় সবাই বিদেশি। ভারত ও সুদানের ডাক্তার বেশি। বাংলাদেশের ডাক্তার আছেন কয়েকজন, এদের মধ্যে ডা. মেসবাহ, ডা. সুলতানা, ডা. ইয়াকুব, ডা. আজিজ ও তাঁর স্ত্রী ডা. দিলরুবা এবং ডা. শহিদুল প্রমুখ। বাংলাদেশি ডাক্তারদের বেশ সুনাম ওখানে, বিশেষ করে বাংলাদেশি প্রবাসীদের কাছে। হাসপাতালে বাঙালি ভর্তি হলে নিজের দায়িত্ব না পড়লেও এসে তদারকি করেন অনেকেই।
ডাক্তারদের মধ্যে আমিরাতের কোনো নাগরিককে চোখে পড়লো না। অবশ্য পড়বেই বা কী করে। ১৯৯৫ সালে আল-আইন মেডিকেল স্কুল থেকে আমিরাতের প্রথম গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার বেরিয়েছেন ৩২ জন। এদের মধ্যে ২২ জনই মহিলা, ১০ জন পুরুষ মাত্র (এখানেও মহিলা ডাক্তারের পুরুষের দ্বিগুণ)।
শিলাকে দেখতে গেলাম আমরা তিনজন। মোস্তফা, ছানু আর আমি। চার বিছানার একটা কামরা। এই হাসপাতালে এটাই নিয়ম। কোনো সিঙ্গেল বেডের ঘর নেই, চারজনের বেশিও নেই। প্রত্যেকের বিছানাকে পর্দা দিয়ে আলাদা করা যায়, আবার পর্দা সরিয়ে একও করা যায়। শিলাকে মনমরা দেখালো। দু দিন হলো মেয়েটা জন্মেছে, ভালো করে দেখতেও দেয় না নার্সেরা। জন্ডিস যদি মেয়েকে আক্রমণ করে এই ভয় দেখিয়ে সরিয়ে রাখে সারাক্ষণ।
শিলার মাথার কাছে টেলিফোন সেট। যে কোনো প্রয়োজনে রিসিভার উঠালেই ওপাশ থেকে এটেনডেন্ট কথা বলবে। মাথার উপরে, ছাদ থেকে বসানো আছে ছোট্ট একটা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। প্রত্যেক রোগীর জন্য একটা করে ক্যামেরা তাক করা থাকে। ডাক্তাররা তাদের জায়গায় বসেও যাতে রোগীর অবস্থা দেখতে পারে, সে জন্যে এই ব্যবস্থা।
বাচ্চা প্রসবের ২ দিন পর কেমন তরতাজা দেখাচ্ছিলো শিলাকে। মোস্তফাকে বললাম—শিলার কি নর্মাল ডেলিভারি ছিলো?
মোস্তফা একটু অবাক হলো—কেন, নর্মালই তো হবে?
বললাম, ঢাকায় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নর্মাল ডেলিভারির সংখ্যা খুব কম থাকে। সম্ভবত আবহাওয়ার কারণে। ঢাকার আবহাওয়া ডাক্তারদের সিজারিয়ান করতে বাধ্য করে!

মোস্তফা হাসলো। বললো—তোমাদের ঢাকার খবর জানি না। তবে আল-আইনে এই ১৪ বছরে আমি কমপক্ষে একশোটা বাচ্চা জন্ম হবার খবর শুনেছি, তাতে কারো পেট কাটতে হয়নি। তুমি শুনলে অবাক হতে পারো, আমার তাহমিদের ব্রিচ ডেলিভারি হয়েছে। জন্মের সময় ওর মাথা ছিলো পিছনে, ঠ্যাং দুটো সামনে। তাও ডাক্তাররা অপারেশন করেনি। তিনদিন ছিলো কড়া অবজারভেশনে। তারপর বাঙালি ডাক্তার দিলরুবাসহ অন্য ডাক্তাররা নর্মাল ডেলিভারি করিয়েছেন, কোনো অসুবিধা হয়নি।
শিলার ঘরে অপর তিন রোগী তিন দেশি। একজন মিশরি, একজন ফিলিস্তিনি অপরজন পাকিস্তানি। তাদের তিনজনেরই বাচ্চা হবে। আমরা যখন বসে আছি শিলার বিছানার কাছে, তখন পাশের বিছানার পর্দা সরিয়ে একটা মহিলা হাতে একটি থালা বাড়িয়ে দিল। ছানু কথা বললো আরবিতে। ঐ মহিলা মিশরি, আমার দিকে তাকিয়ে ছানু বললো—মহিলা আমাদের জন্য এই খাবার দিয়েছেন, এটা তাদের দেশীয় পিঠা। দেখি, আমাদের চিতই পিঠার মতো এক ধরনের পিঠা জাতীয় জিনিস দেয়া আছে খুব পরিচ্ছন্ন একটা থালায়। এর সাথে এক ধরনের মিষ্টি সস।
শিলার জন্য খাবার এসেছে। হাসপাতালের খাবার। বাঁশমতি চালের ভাত, মুরগির রোস্ট, ২টা ব্রেড, একবাটি দই, কলা, এক প্যাকেট জুস এবং একবাটি সবজি। এসব খাবারে শিলার রুচি নেই। সে বললো—আমাকে একটা মিশরি চিতই পিঠা দাও, তোমরা বরং এগুলো খেয়ে শেষ করো। আমরা চারজন মিলে ৩টা পিঠা ভাগাভাগি করে খেলাম। ফিরে আসার সময় ছানু মহিলাকে আরবিতে কী যেন বললো। আমার মনে হলো মহিলাকে ধন্যবাদ দিয়েছে। জবাবে মিশরি মহিলা কাপড়ের পর্দার অন্দরমহল থেকে বললেন—‘শুকরান।’
আবদুর রহমান বাওয়ানী

পাঠান ড্রাইভারদের সুনাম আছে আমিরাতে। কিন্তু আমার ভাগ্যে আল-আইনে ট্যাক্সিক্যাবে চড়ার খুব একটা সুযোগ হলো না। মোস্তফার ৯৭ মডেলের টয়োটা ক্র্যাসিডা সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে টহল দিতো। একদিন বাবুদের ওখানে রাত কাটালাম তাদের শরিকার মধ্যে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ঠিক করলাম ছানুকে আজ আর জ্বালাবো না। বাবু ও সাবুদ্দিনের শখ আমাকে নিয়ে বেড়ানোর। বললাম, ঠিক আছে, একজন পাঠান ড্রাইভারওয়ালা ট্যাক্সি নাও। তাকে নিয়ে ঘোরা যাবে।
পাঠানদের নাকি চেহারা দেখলেই চেনা যায়। এক পাঠানের নাম জানি। জগত বিখ্যাত ক্রিকেটার ইমরান খান। অপর কোনো পাঠানের চেহারার সাথে আমার সে রকম পরিচয় নেই। বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি—এমন সময় বাবু বললো—ওঠো এটা পাঠানের ট্যাক্সি।
ট্যাক্সিতে যখনই উঠেছি আমি বসতাম ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে এবং কখনোই কোনো ড্রাইভারকে বিরক্ত না করে ছাড়তাম না। এঁদের মধ্যে দু-একজন পেয়েছি ভারতীয় যারা ইংরেজি বলতে পারে। উর্দু হিন্দিতে আমার কোনো দখল নেই, আরবি তো প্রশ্নই ওঠে না। সে কারণে সবার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করা আমার সম্ভব হতো না। তবে এই বেলা এই পাঠান ড্রাইভারটাকে আমার কেন জানি ভালো লেগে গেলো।
ওর নাম আবদুর রহমান বাওয়ানী। পাকিস্তানের নাগরিক। বয়স বললেন ছেষট্টি বছর। বত্রিশ বছর ধরে ট্যাক্সি চালাচ্ছেন, এবং এই আল-আইন শহরেই। এর মধ্যে দেশে গিয়েছেন, বিয়ে করে ফিরে এসেছেন, আবার দেশে গিয়েছেন। তাঁর দুটো ছেলের জন্ম হয়েছে এবং এখন তারা বড় হয়েছে। দুটো ছেলেই ট্যাক্সি চালায়, আমিরাতে। আমিরাতে ট্যাক্সি চালাতে প্রয়োজন এক কঠিন ড্রাইভিং টেস্ট। এ পরীক্ষাগুলোতে কেউ নাকি কখনোই একবারে পাস করে না। ড্রাইভিং টেস্টে পাস করার পর ট্যাক্সিচালক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়। তখন সরকার থেকে তাদের ট্যাক্সি দেয়া হয়। ট্যাক্সিতে প্রত্যেক ড্রাইভারের লাইসেন্স ছবিসহ লেমিনেটেড থাকে ড্যাশ বোর্ডের সাথে। প্রতি ১২ ঘণ্টার জন্য সরকারকে ট্যাক্সি ভাড়া দিতে হয় ৫০ দিরহাম। এটা বাদে যা থাকে তাই লাভ।
আল-আইনে ট্যাক্সি মিটারের সর্বনিম্ন চার্জ ২ দিরহাম। অবশ্য দুবাইতে এই চার্জ ৩ দিরহাম। অন্যান্য শহরে ২ দিরহামই। দুবাইর ট্যাক্সিগুলো গুণগত মানে খুব উন্নত। প্রত্যেক ট্যাক্সিতে এয়ার কন্ডিশনার থাকে। অবশ্য যাত্রী যদি মনে করেন তিনি এসি চালাবেন না ড্রাইভার তখন তা বন্ধ রাখতে পারে। এতে বিল আসে কম।
ড্রাইভার বাওয়ানীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো—বাংলাদেশি ট্যুরিস্ট হিসেবে। বাওয়ানীর তাতে আনন্দ। সে বলে—পুরো আল-আইন
আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে। বলি—পুরোটাই প্রায় দেখা হয়ে গেছে এখন যাবো ‘আইন-আল-ফায়দা’য়।
আইন-আল-ফায়দায় যাওয়ার পথে খাতির জমে যায় পাঠান ড্রাইভারটির সাথে। আমাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করছে আমার দুই সহযাত্রী। তারা আরবি ও হিন্দি-উর্দু বলতে পারে। আমি হিন্দি উর্দু খানিকটা বুঝি। যখন না বুঝি তখন ওরা আমাকে সাহায্য করে।
বাওয়ানীর দুই ছেলে যদিও ড্রাইভার কিন্তু তিনি ছেলে দুটোকে বেশি দিন কাজ করতে দেন না এখানে। তারা বিয়ে করেছে পাকিস্তানে। এক ছেলে দেশে যায় ছ মাস থাকে, আবার চলে আসে। ঐ সময় অন্য ছেলে দেশে যায়। তিনি বলেন—আমার জীবন নষ্ট হয়েছে ড্রাইভারি করে করে, আমার ছেলেদের জীবন নষ্ট করতে চাই না। ওদেরকে বলেছি—দেশে ব্যবসাপাতি ধরার জন্য। আমি যতদিন পারি তাদের জন্য টাকা রোজগার করে যাবো।
‘আপনার রোজগার কতো?’ সহসা প্রশ্ন করে বসি। বাওয়ানী তাতে বিরক্ত হয় না। বলে, আমি আমার দুই ছেলের সমান কামাই করি। মাসে যদি ওরা একজন দু হাজার দিরহাম করে, আমি করি চার হাজার। ওরা যদি ৩ হাজার করে, আমি করি ৬ হাজার।
বাওয়ানী আমাকে জিজ্ঞেস করে—এ দেশ কেমন লাগছে। বলি, ‘খুব সুন্দর।’
এ সময় পিছন থেকে বাবু বাংলায় বলে উঠে—‘শাকুর ভাই, আপনি বলেন বাংলাদেশ আরো সুন্দর। বাংলাদেশে যা আছে এই রমলের দেশে তার সুতাভাগও নাই।’ সে রকম কিছু বললাম।
বাওয়ানী হে হে করে হেসে উঠলো। প্রাণখোলা হাসি।
বলি—আপনার দেশ কেমন?
তিনি বলেন—তোমার কাছে তোমার দেশ যেমন।
বাওয়ানীর কাছ থেকে মজার একটা খবর পাওয়া গেল। পাঠান ড্রাইভারদের একটা সমিতি আছে সমগ্র আমিরাতে। প্রত্যেক পাঠান ড্রাইভার প্রতি মাসে ১০০ দিরহাম করে জমা দেয় এই সমিতিতে। তার মূল কারণ হচ্ছে, আমিরাতের খুব কড়া ট্রাফিক আইন। এই আইন অনুযায়ী—কোনো ড্রাইভার যদি দুর্ঘটনাক্রমে কোনো লোকের প্রাণঘাত করে, তবে ঐ ড্রাইভারকে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে ১ লাখ ৮০ হাজার দিরহাম জরিমানা দিতে হবে। কোনো পাঠান ড্রাইভার যদি দুর্ঘটনা ঘটায় তার জরিমানার টাকা দেবে ঐ ড্রাইভার সমিতি। আমিরাতে পাঠান ড্রাইভারদের মতো সংগঠিত কোনো ড্রাইভার সমিতি নেই।
সমগ্র আমিরাতের ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম অতি উন্নত। তার প্রধান কারণ সেখানে ট্রাফিক আইনের পূর্ণ প্রয়োগের ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কারো পক্ষে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। সে চাইলেও কোথাও কোনো গাড়ি পাবে না, যা চালাতে পারে। আমিরাত নাগরিক ছাড়া বহিরাগতদের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া খুব কঠিন। এমনিতে একটা নির্দিষ্ট স্ট্যাটাসের না হলে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে চায় না, এমন কথাও বলেছেন কয়েকজন। তবে গাড়ি কেনার ব্যাপারে এক ধরনের মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ব্যাপার এখনও রয়ে গেছে। আমিরাতের নাগরিক ছাড়া কাউকে মার্সিডিজ, ল্যান্ডরোভার, লিমুজিন, পাজেরো ধরনের গাড়ি কিনতে দেয় না। নাগরিকদের গাড়ি কেনার অফুরন্ত সুযোগ। যে কোনো নাগরিক সরকারের কাছে আবেদন করলেই বিনা সুদে ধারের টাকায় যে কোনো মডেলের যে কোনো দামের গাড়ি পেয়ে যায়। ধারের টাকা ফেরত দেয়ার পদ্ধতিও বড় সহজ। গাড়ি কেনার এক বছর পর প্রতি মাসে ৮শ টাকা করে
কিস্তিতে দাম শোধ হবে। এ কারণেই বোধহয়, আরবিদের প্রতি বাড়িতে ৭-৮টা গাড়ি এবং তার দামি গাড়ি। এ কারণেই জাপানের গাড়ি কোম্পানিগুলোর প্রধান লক্ষ মধ্যপ্রাচ্যের বাজার।
রাস্তাঘাটে গাড়ি নিয়ে চড়তে একটা জিনিস লক্ষ করলাম, প্রত্যেকটি ড্রাইভার আইনের প্রতি খুব সতর্ক। আইনের কাছ থেকে ফাঁকি দেবার কোনো ব্যবস্থা নাই।

আমাদের দেশে লালবাতি না মেনে সামনে গাড়ি চালালে যদি সার্জেন্ট ধরে বসে, তার কাছ থেকে খুব অল্পে রক্ষা পেয়ে চলে যাওয়া যায়। ট্রাফিক পুলিশও পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত খেয়ে খুশিমনে বেআইনি গাড়িগুলোকে ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু ওখানে এসবের সুযোগ নেই। যেমন, হাইওয়েতে যেসব জায়গায় গতিসীমা নির্ধারণ করা আছে, সে সবের অনেক স্থানেই রাস্তার পাশে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা রাখা আছে। কেউ গতিসীমা অতিক্রম করবে তো তার খাতায় জরিমানা যোগ হয়ে গেলো। এ জরিমানার অংকও নির্ধারণ করা। যেমন কোথাও লেখা আছে সর্বোচ্চ গতিসীমা ১৪০ কিলোমিটার। সেখানে কেউ হয়তো ১৪৬ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়েছে, তার জরিমানা হবে ১৪০ দিরহাম। ১৬০ কিলোমিটার গাড়ির গতি হলে জরিমানাও হবে ১৬০ দিরহাম। এই জরিমানাগুলো সারা বছরে জমা হবে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট অফিসে। বছর শেষে যে সময় গাড়ির ফিটনেস করিয়ে নেবার জন্য আবেদন করা হবে তখন কম্পিউটারের বোতাম টিপে বের করা হবে সারা বছরের জরিমানার অংক। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ কোনো কারণে তার জরিমানার অংকের প্রতি সংশয় দেখিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসেন, তার জন্য রয়েছে অন্য ব্যবস্থা। প্রতি চ্যালেঞ্জের জন্য দশ দিরহাম জমা দিতে হবে। এই টাকা জমা দেবার দশ মিনিটের মধ্যে তাকে একটা ফটো উপহার দেয়া হবে। সেই ছবিতে দেখা যাবে চালককে এবং গাড়িটিকে। দেখা যাবে কোথায়, কখন, কত কিলোমিটার বেগে এই গাড়ি চলছিলো। এই আমলনামা হাতে পেয়ে জরিমানা দিয়ে বোকা বনে যাবার কোনো কারণ থাকে না।
এক বিকেলে মোস্তফা মন খারাপ করে বসে আছে। বলি—‘কী ব্যাপার? বৌ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়নি?’
‘আরে না শাকুর ভাই’—মোস্তফা মুখে কঠিন হাসি ফুটিয়ে বলে—‘এক মিনিটের জন্য একশ টাকা (দিরহামকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিজেদের মধ্যে টাকাই বলে) জরিমানা হয়ে গেলো।’
‘কীভাবে?’
‘মার্কেটে গেলাম নতুন মেয়েটার জন্য একটা গোসলের গামলা কিনতে। মার্কেটের সামনের পার্কিং লটে গাড়ি রাখবো, দেখি পার্কিং করার এরিয়া খালি নাই। ভাবলাম এক মিনিটের ব্যাপার পার্কিং এরিয়ার বাইরেই না হয় রেখে যাই। এসে দেখি পুলিশদের গাড়ি সামনে। লাইসেন্সটা নিয়ে গেলো। কাল আনতে হবে একশ দিরহাম জরিমানা দিয়ে।’
বললাম, খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছো তোমরা। রাস্তার মধ্যে এলোপাতাড়ি গাড়ি চালানো, যেখানে ইচ্ছা গাড়ি ফেলে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কেটিং-এ কাটিয়ে দেবার মজা তোমাদের এখানে নেই।’
মোস্তফা হো হো করে হেসে উঠলো।
জেবেল হাফিত

আল-আইনে যে বাঙালির সাথেই দেখা হয়, সে-ই জিজ্ঞেস করে বড় পাহাড়ের উপর গিয়েছি কিনা। বলি—কোন পাহাড়?
: জেবেল হাফিত।
জেবেল মানে পাহাড়। হাফিত মানে কী জানি না। কিন্তু আল-আইন শহর থেকে সন্ধেবেলা ঐ পাহাড়ের সারি সারি বাতি জ্বলতে দেখেছি। উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে যে রাস্তাটি পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে ঠেকেছে তার দু পাশে ল্যাম্পপোস্ট। দূর থেকে মনে হয় যেন কেউ ছোট ছোট মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে পথ দেখাবার জন্যে। বাতিগুলো ক্রমাগত একটা বাঁকা পথ এঁকে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে ঠেকেছে। রাতেরবেলা পাহাড়টি যাতে কারো চিনতে ভুল না হয় সে জন্যে এই ব্যবস্থা।
৭ মে, ১৯৯৭। ঠিক হলো—বিকেলবেলা জেবেল হাফিতের চূড়ায় উঠবো।
মোস্তফার গাড়িতে সওয়ার হলাম আমরা বেশ কজনা। সস্ত্রীক ছানু, তার পুত্রকন্যা, আর মোস্তফার ছেলে তাহমিদ। কিন্তু যাত্রার শুরুতেই গাড়িতে বমি করে বসলো ছানুর ৪ বছরের কন্যা সুমি। সিদ্ধান্ত হলো, ওকে নিয়ে বাবা-মা ফেরত যাবে শহরে। কারণ—এ যাত্রায় সোজা রাস্তায় বমি করলে পাহাড়ে উঠতে এই মেয়ে বারোটা বাজিয়ে দেবে। সুতরাং ব্যাক টু দ্যা হাউজ।
পাহাড়েরা বেশ প্রবঞ্চক হয়। দেখতে মনে হয় এই তো কাছেই, কিন্তু কাছে পৌঁছাতে কষ্টের শেষ থাকে না। জেবেল হাফিতই বা কম কীসে। আল-আইন শহরটাকে ছায়া দিয়ে রাখা এই পাহাড়টি বহুক্ষণ ধরে কাছে কাছে দেখেও কাছে আসতে সময় লাগলো তিরিশ মিনিটের মতো। মোস্তফা গাড়ির গতি কমিয়ে অটো গিয়ারের ডি ড্রাইভের পরিবর্তন আনলো। ডানপাশের পোস্টে তখন লেখা ১৬ কি. মিটার। বোঝা গেলো ১৬ কিলোমিটার ঢালু উঁচু পথ বেয়ে তবেই জেবেল হাফিত জয় করা যাবে।
জেবেল হাফিতের প্রাগৈতিহাসিক ভূমিকা অনেক। প্রতœতত্ত¡বিদেরা গত দশ বছর ধরে এ পাহাড়ের আনাচেকানাচে ঘাঁটাঘাঁটি করে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো বাসন-কোসনের সন্ধান পেয়েছেন। এগুলো এখন রাখা হয়েছে আল-আইন জাদুঘরে। জেবেল হাফিতের তলদেশের উত্তর ও পূর্ব দিকের কয়েকটি গুহায় অনুসন্ধান চালিয়ে কয়েকশ পাথরের থালাবাসন পাওয়া গেছে। এই থেকে অনুমান হয় যে, পাহাড়টির গুহায় ৫ হাজার বছর আগেও মানুষের বসবাস ছিলো।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রতœতাত্তি¡কেরা কাজ শুরু করেছেন পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে। কিন্তু গত দশকের আগেও তারা তেমন কোনো প্রতœতাত্তি¡ক সন্ধান পাননি। গত এক দশকে এর আবিষ্কার হয়েছে প্রচুর। ধারণা করা হচ্ছে, ৭ হাজার বছর আগে এ অঞ্চলে গুহামানবেরা পাহাড়গুলোর পাদদেশে বসবাস করতো।
মোস্তফাকে বললাম—জেবেল হাফিত যাচ্ছি ঠিক, কিন্তু বইতে পড়া গুহাটুহার সন্ধান-টন্ধান পাবো তো? মোস্তফা হাসে। বলে—ওসব এখন নাই। বদ্দুরা এখন আলিশান ভিলায় থাকে। গুহায় থাকা ছেড়ে দিয়েছে একশ বছর আগে। তবে কোথাও কোথাও গুহার পাশে কিছু সাবিহা (গ্রাম) দেখা যায়, সেখানে অবশ্য পুরোনো দিনের মানুষেরা থাকে।
বলি—তাহলে আমাকে ওখানেই নিয়ে যাও।
মোস্তফা গাড়ির গতি না কমিয়েই হাসে। এ হাসির মানে হচ্ছে, সম্ভব না।
আমরা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে জেবেল হাফিত মাড়াতে থাকি। এমন আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি চড়া আমার কাছে নতুন মনে হয়নি। আমাদের সিলেটের জাফলং কিংবা রাঙামাটি যেতে ওরকম কতো পাহাড় মাড়িয়েছি। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে বড় তফাৎ হচ্ছে প্রকৃতির রং। আমাদের গুলোও পাহাড়, এগুলোও পাহাড়। আমাদের পাহাড়ে বৃষ্টির পানি পড়ে জন্মেছে সবুজ বনানী, মনে হয় মাটির পাহাড়ের গায়ে সবুজের আলগা চাদর পরা অরণ্য। কিন্তু এখানে মাটি তো নয়, কঠিন পাথর। পৃথিবী সৃষ্টির সময় অগ্ন্যুৎপাতে যে কঠিন শিলারা আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়ে পড়ে ছিলো, প্রকৃতি তাকে অবহেলায়, অযতেœ নিরাভরণ রেখে আছে পৃথিবী সৃষ্টির চার হাজার কোটি বছর ধরে।
নির্মাণগত কাঠামোতে অবশ্য আছে পরিবর্তনের সুস্পষ্ট লক্ষণ। দু পাশে প্রশস্ত রিটেইনিং ওয়াল, দু পাশেই বাতির স্তম্ভ, যা একসাথে রাস্তাকেও আলোকিত করছে, আবার দূর থেকে এ প্রাগৈতিহাসিক স্থানকে পর্যটকের আকর্ষণ বিন্দুতে টানতেও দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। প্রশস্ত পথ, পথের ধারে টেলিফোনের লাইন এবং বিশ্রাম নেবার বা ঢালু পাহাড়ে চড়তে জরুরি অবস্থায় গাড়ি পার্ক করা বা ঘুরিয়ে নেবারও ব্যবস্থা রেখেছে। এক সময় যা ছিলো দুর্গম গিরি, আজ তা সুগম আর সহজ, প্রাণবন্ত। তবে মোস্তফা জানালো—এখনও এর সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। পাহাড়ের উপরে কয়েকটি অট্টালিকা বানানো হচ্ছে, এখানেও পর্যটকদের জন্য অনেক ব্যবস্থা থাকবে।
জেবেল হাফিতের উপরে উঠে দেখা গেলো ২/৩টা প্রাসাদ নির্মাণের শেষ পর্যায়ে কাজ চলছে। শ্রমিকরা বেশির ভাগই বাংলাদেশি। এই সুউচ্চ পাহাড়েও পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। যে দুটো প্রাসাদ দেখা গেলো—তার একটি আল-আইনের শাসকের, অন্যটি অন্য কোনো শেখ সাহেবের। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হলে তারা তাদের বন্ধুদের নিয়ে এখানে সময় কাটাবেন, এই ইচ্ছায় এ প্রাসাদগুলো বানানো।

জেবেল হাফিতের চূড়ায় বেশ খানিকটা জায়গা সমতল করে চারদিকে রেলিং দিয়ে রাখা হয়েছে। যারা বেড়াতে আসেন তারা গাড়ি পার্ক করে রেলিংয়ের ধারে বেঞ্চিতে বসে দূরের শহর দেখেন। ইতোপূর্বে এতো উঁচু পাহাড়ে উঠিনি। আমিরাতের উচ্চতম পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বেশ শিহরন বোধ করতে শুরু করলাম। শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদ পাথরের পাহাড়ে তার লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রকৃতির আপন ইচ্ছায় রূপ নেয়া পাহাড়গুলোর এক একটিকে এক এক রকম মনে হয়। মনে হয় কোনো তুখোড় ভাস্কর এবস্ট্রাক্ট ফর্মে পাথরগুলো দিয়ে ভাস্কর্য বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। উপর থেকে নিচে তাকালাম ভয়ে ভয়ে। আল-আইন শহরকে দেখা যায় পায়ের নিচে, ছোট্ট ছোট্ট ঘর, মিটি মিটি তারার মতো ল্যাম্পপোস্ট। হঠাৎ করে মোস্তফাকে অনুরোধ করে বসলাম—ভাই, তোমার মোবাইল থেকে আমি কি একটা লং ডিসট্যান্স কল করতে পারি?
মোস্তফা মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে—ভাবির কাছে ফোন করবেন? আগে বলেননি কেন?
বাংলাদেশের নাম্বার টিপলাম। হিসেব করে দেখলাম ঢাকায় তখন রাত আটটার কিছু উপরে। ফোন ধরলো জলী।
—জানো আমি এখন কোথায়?
: কোথায়?
—আমিরাতের সবচে উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে তোমাকে ফোন করছি।
: ফাজলামো রাখো, পাহাড়ের উপরে ফোন পেলে কোথায়?
—এখানে পাহাড়ের উপরেও ফোনের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমি ফোন করছি মোবাইল সেট থেকে।
: তোমার কোমরে ব্যথার কথা মনে আছে? তুমি পাহাড় চড়তে গেছো কেন?
—আরে না, গাড়িতে করে পাহাড় চড়ছি, কোমরের সমস্যা হবে না।
: তোমার যা ইচ্ছা করো। আমি জানি না। দু দিন পর দেশে এসে আবার বিছানায় পড়ে থাকলে আমি ফিরেও তাকাবো না। তুমি তাড়াতাড়ি পাহাড় থেকে নেমে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।
বৌয়ের সাথে আলাপ করে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি যে অনুভূতির কথা বলতে চাইলাম—তা বোঝাতে পারলাম না। ফেরত পেলাম উপদেশ। উপদেশ শুনতে আমার ভালো লাগে না। আবার প্রকৃতি দেখার জন্য মনোযোগী হয়ে গেলাম।
ঘুরতে ঘুরতে একদিকে দেখলাম রেলিং-এর মধ্যে একটা দরোজাও আছে। এই বেষ্টনীটি পার হয়ে পাহাড়টি থেকে বেরিয়েই দেখি, অনেক দেরি করেই এখানে এলাম। এর আগে অনেকেই এসে বসে আছে। এর মধ্যে তিন চারজন কালো ও সাদা চামড়ার পর্যটকের দল ছাড়া বাকি সবাই আরবি। একটা বড় পাথরের উপর তিনজন বৃদ্ধ আরবি খোশগল্পে মেতে রয়েছে।
পাহাড় থেকে নিচের ছবি তোলা খুব কষ্টের। প্রথম কারণ, শেষ বিকেলের একটা ধোঁয়াটে আবরণ ইতোমধ্যেই তলার শহরটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। খালি চোখেই বেশি কিছু দেখা যায় না। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে অনেকটা হতাশ হয়ে বুড়োগুলোর ছবি উঠাতে চাইলাম।
ক্যামেরা তাক করেছি বুুড়োদের দিকে, অমনি একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে কী যেন বললো আরবিতে।
ভয় পেয়ে গেলাম।
এ ভয় অমূলক নয়। গতকাল আল-আইনের ফান সিটিতে আমার একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে ছবি উঠাতে গিয়ে।
ফান সিটি বিশাল আয়তনের প্রমোদনগরী। শুধু শিশুদের জন্য নয়, বড় এবং বুড়োদের জন্যেও অনেক কিছু আছে। সস্ত্রীক ছানু ও তার বাচ্চাদের নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম ফান সিটিতে। ছানুর ছেলেমেয়েরা খুব হৈ চৈ করছে, কিন্তু আমার কেন যেনো ওসবে তেমন আগ্রহ নেই। একটি বেঞ্চে বসে আছি। সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময়। হঠাৎ দেখি দুই আরব রমণী বোরকা খুলে ঘাসের উপর বসে আছে এবং তাদের দুজনের পাশে বেবি চেয়ারে দুটো ফুট ফুটে শিশু। আমরা মায়ের সাথে বাচ্চাদের অঙ্গাঙ্গীভাবে দেখে অভ্যস্ত। আমাদের দেশের শিশুপার্কে বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে মায়েরা ঘোরাঘুরি করে। কিন্তু এখানে, এই বাচ্চা দুটোকে পাশে এমন অযতেœ বসিয়ে রেখেছে দেখে আমার অন্যরকম মনে হলো। শুধু তাই নয়, মা দুজন দুহাতে দুটো সিগারেট ধরিয়ে নিজের মতো টেনে যাচ্ছেন। একটু হোঁচট খেলাম। মা, শিশু এবং সিগারেট—এ তিনের সমন্বয়টাকে ধরে রাখার জন্যে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে ফ্লাসগান বসিয়ে চার্জ দিয়েছি। ফ্লাসগানে ব্যাটারি চার্জ হলে শব্দ হয়। ছানু সেই শব্দ শুনছে। যেই ক্যামেরা তাক করতে যাবো, এমন সময় আমার হাত আটকে দিলো ছানু। ‘খবরদার আরব মহিলাদের ছবি তুলবে না। খুব অসুবিধা আছে।’
—কেন? কী হবে ছবি তুললে?
: কী হবে মানে? এখনই পুলিশ ডেকে আনবে। পুলিশকে তারা যা বোঝাবে তাই বুঝবে। পুলিশ তোমার কোনো কথা শুনবে না। সোজা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে রেখে দেবে দুইদিন। এখানকার সব পুলিশ ক্যাম্পেই মাটির তলার জেলখানা আছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ পাবে না। কারণ, তুমি খারিজী।
ছানুর কথায় খানিকটা ভড়কে যাই। ক্যামেরা থেকে ফ্লাসগানকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যাগের ভেতর পুরে দূরে দাঁড়িয়ে ঐ মহিলাদের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকি।
ছানু এসময় আমাকে আমিরাতের পুলিশ ও মহিলাদের বিষয়ে নানারকম জ্ঞান দিতে থাকে। এক দোকানদারের গল্প শোনায়। একদিন এক আরবি মহিলা ঐ দোকানে এসেছে একটি বিশেষ পারফিউম কিনতে। ঐ মহিলার অভ্যেস ছিলো কয়েক পদের পারফিউম কিনে এক বোতলের ভিতর ঢুকিয়ে ককটেল বানানো। মহিলাটি দোকান থেকে পারফিউম কিনে দাম চুকিয়ে সালাম আলাইকুম বলে চলে যায়।
আসল ঘটনাটা ঘটে পরের দিন। অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মহিলাটি বলে—গতকাল এই দোকান থেকে যে পারফিউম কিনে নিয়েছিলো তা মেশানোর পর ককটেলের সুগন্ধ নষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং তার দাবি হচ্ছে, যতগুলো পারফিউম মিশিয়েছিলো প্রত্যেকটির দাম ফেরত দিতে হবে এবং এখনই। দোকানদার পড়লো বেকায়দায়। মহিলাকে যতই বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে ভেজাল মেশানো পারফিউম বিক্রি করে না, প্রয়োজনে একই ব্র্যান্ডের অন্য কোনো পারফিউম চাইলে সে পরীক্ষা করে দেখাতে পারে। কিন্তু মহিলা তার বক্তব্যে অনড়। তার হাতে পরীক্ষানিরীক্ষা করার মতো সময় নেই। সে চায় ক্ষতিপূরণ এবং এক্ষুনি।
এরকম পরিস্থিতিতে ভিনদেশি একজন দোকানদারের করার কিছু নেই। সময়ক্ষেপণ দেখে মহিলা বলে—এক্ষুনি সমস্ত ক্ষতিপূরণ না দিলে সে পুলিশ ডাকবে এবং পুলিশকে বলবে যে এই দোকানদারগুলো তার ইজ্জত লোটার চেষ্টা করেছিলো। বলে সে দরজা লাগানোর দিকে হাত বাড়ালো।
: পুলিশ কি এই মহিলার কথায় বিশ্বাস করবে?
: হানড্রেড পারসেন্ট করবে। পুলিশ কোনো সাক্ষী সাবুদ মানে না। সোজা গাড়িতে উঠিয়ে জেলে ভরিয়ে দেবে। আরবিদের সাথে মামলা করে কেউ জিততে পারে না। আর মহিলাদের ব্যাপারটা তো আরো আলাদা। তারা যা বলবে পুলিশ তাই বিশ্বাস করবে।
খানিকটা ভয় পেয়ে বেঞ্চের উপর এসে বসে পড়লাম। এমন সময় ফর্সা, দীর্ঘাঙ্গী এক যুবক আমার সামনে এসে আরবিতে চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। তাকে বললাম—‘ক্যান ইয়ু স্পিক ইন ইংলিশ?’
আরো অধিক জোরে চিৎকার করে লোকটি বলে—‘ইয়েস, আই স্পিক ইংলিশ। হোয়াই ইয়ু টেক ফটো মাই ওয়াইভস?’
তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম—আমি তোমার বৌদের কোনো ছবি উঠাইনি। কিন্তু সে আরো রেগে যায়।
এমন সময় ছানু এসে আরবিতে কী কী সব বললো। লোকটি ঠাণ্ডা হয়ে ফেরত চলে গেলো। যাবার সময় শাসনের ভঙ্গিতে আঙ্গুল উঁচিয়ে আমাকে ইংরেজিতে বললো—‘দোন্ত গো দেয়ার, দোন্ত লুক মাই ওয়াইভস।’
এ ঘটনার পর ছানু আমাকে কঠিন ভাষায় সাবধান করে দিয়েছিলো। বলেছিলো—বদ্দুদের দিকে ক্যামেরা তাক কোরো না, আর ভুল করেও যদি মহিলাদের ছবি তুলতে যাও, তবে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত মাটির তলার জেলে সময় কাটিয়ে যেতে হবে। বলেছিলাম—বেশ তো ভালোই হয়, আমিরাতের জেলখানাটাও দেখা হয়ে যাবে।
ঠিক এই কারণে আরব বৃদ্ধদের কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভয় কাটিয়ে দিলো মিন্টু। মিন্টু স্কুলে আরবি শিখেছে। সে আরবিতে লিখতে ও পড়তে পারে, কথাও বোঝে। আমার ও তার বাবা ছানুর সাথে সব সময় ইংরেজিতেই কথা বলে। আমার কাছে এসে ওদের আরবি কথা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিল। বললো—‘চাচা ওরা বলছে এতো দূর থেকে ছবি উঠালে ওদের চেহারা দেখা যাবে না, আপনি আরো কাছে যান।’
আরো সাহস পেয়ে গেলাম। এর মধ্যে মোস্তফা আমাদের মাঝে এসে গেলো। আমার ভাষাগত সব সমস্যা মিটে গেলো। আরব বৃদ্ধদেরকে আমার সম্পর্কে অনেক কিছু বললো। সব শুনে তারা আমার সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো।
এই সব আয়োজন থেকে ফিট দশেক দূরে একটা পাথরের উপর একা একা বসে সূর্যাস্ত দেখছে এক আরবি তরুণ। সেও এসে যোগ দিলো আমাদের মধ্যে। আমাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘ইউ আরকিতেকত? ফতোগেরফার?’
মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
এর মধ্যে মোস্তফার সাথে তার আরবিতে কী কী সব কথাবার্তা হলো। মোস্তফা আমাকে বললো—এই ছেলেটা তোমাকে সুন্দর আরেকটা পাহাড় দেখাতে চায়, তুমি কি যাবে?
ওর কথায় খানিকটা অবাক হয়ে যাই। তার সাথে সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করি। তার নাম মোহসীন। বয়স ২০-২১ বছর হবে। পড়াশোনা করে দুবাই পুলিশ স্কুলে ফাইনাল ইয়ারে। সে যতটুকু ইংরেজি পারে, তাতে আমাদের মধ্যে ভাষার আদানপ্রদানে খুব অসুবিধা হলো না।
মোহসীন বললো—তোমার দেশে পাহাড় নাই?
বলি—আমার দেশে পাহাড় আছে, নদী আছে, সাগর আছে, বিল আছে। কিন্তু এগুলোর মতো নয়।
‘তোমার কাছে কোনটাকে বেশি সুন্দর মনে হয়?’ মোহসীনের প্রশ্ন।
বলি—‘দু দেশের প্রকৃতি দু রকমের। দুটোর সৌন্দর্য আলাদা। একটার সাথে অন্যটা মেলানো ঠিক হবে না। তবে পাহাড় প্রচুর দেখেছি, কিন্তু এসবের মতো পাথরের পাহাড় দেখিনি। আমার কাছে চমৎকার লাগছে।’
মোহসীন বলে—তোমার যদি সময় হয়, আমি তোমাকে আরেক শ্রেণির পাহাড় দেখাতে নিয়ে যেতে পারি।
সেখানে একটি ঝরনা আছে, ঝরনা থেকে নদীর উৎপত্তি হয়েছে। শুক্রবার ওখানে যাই। তোমার যেহেতু পাহাড় ভালো লাগে, তুমি খুব আনন্দিত হবে।
বলি—ওটা কোথায়?
সে বললো—ওমানের শেষ প্রান্তে।
বললাম—আমার তো ওমানের ভিসা নাই, আমিরাতের ভিসা, যদি পুলিশ ধরে?
মোহসীন হাসতে হাসতে বললো—মা ফী মুশকিলা—নো পরব্লেম।

মাই ফাদার পুলিশ অফিসার, আই পুলিশ স্তুদেন্ত।’
ঠিক হলো—কাল সকাল সাড়ে দশটায় মোহসীন আসবে মোস্তফার সিটি পারফিউমারি স্টোরে। সেখান থেকে আমরা রওনা দেবো ওমানের পথে পাহাড় দেখার জন্য।
সূর্য ডুবে গেছে জেবেল হাফিতের তলায়। পাহাড়ের উপর থেকে সূর্য ডোবার দৃশ্য অনেকক্ষণ দেখা যায়। ঘন কুয়াশার মতো একটা আবরণ ঢেকে দিলো পাহাড়তলের গার্ডেন সিটিকে। ল্যাম্পপোস্টগুলো থেকে সারি সারি আলোর কণা ফুটে উঠলো। মনে হলো একটা বড় অপূর্ণতা রয়ে গেছে এই পাহাড়ের সৌন্দর্যে। মোস্তফার সাথে ঠিক হলো—দেশে ফেরার আগে যে কোনো একদিন সূর্য ওঠার আগে আমরা এ পাহাড়ে এসে উঠবো। পাহাড়ের চূড়া থেকে বালুরাশির ভেতর থেকে সূর্য উদয় হওয়ার দৃশ্য দেখবো।
পরিকল্পনা ফাইনাল হয়ে গেলো। আমাদের গাড়ি জেবেল হাফিতের ঢালু বেয়ে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে গেলো। যাবার আগে একবার মোহসীনকে দেখতে চাইলাম। মোহসীন সেই আগের মতো একটা পাথরের উপর বসে আছে। অন্ধকার হয়তো তার বেশি প্রিয়। মোহসীন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
মোহসীনের সাথে একদিন
মোহসীনের সাথে আজ আমার দেখা হবার কথা সকাল দশটায়। মোহসীন বলেছিলো—যদি কোনো কারণে মত পাল্টাই তবে সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যে যেন তাকে জানিয়ে দিই। তার পক্ষ থেকে যদি কোনো সমস্যা থাকে—সেও সাড়ে ন’টার মধ্যে আমাকে জানাবে। সকাল পৌনে দশটা পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকে কোনো যোগাযোগ হলো না। পুরো ব্যাপারটা ছানুকে যখন বললাম—সে আমল দিলো না। তার কথায় – আরবদের তুমি চেনো না, ওরা যখন যা খুশি বলে বসে, পরে সব ভুলে যায়। শুধু শুধু তোমাকে ওসব বলেছে। বাদ দাও ওর কথা, আজ কোথায় যেতে চাও, বলো।
বলি—ছেলেটাকে আমার সেরকম মনে হয়নি। ঠিক আছে, ওকে ফোন করে দেখো তো, কী বলে।
ছানু ফোন করলো মোহসীনকে। তারা দুজন আরবি কথা বলে ফোন রেখে দিলো। ছানু আমার দিকে তাকিয়ে বললো—ও এখন বাসা থেকে বেরিয়েছে, দশ মিনিটের মধ্যে আমার বাসার নিচে আসবে। সে তৈরি।
বলি—তাহলে তো হলোই চলো নিচে নামি।
ছানু খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলো। তারপর বললো—ঠিক আছে, আমিও নামছি। যদি যেতেই হয়, তোমাকে একা ছাড়বো না, আমিও যাবো।
ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁতে না ছুঁতেই মোহসীনকে দেখা গেলো গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। ছানু কথা বললো আরবিতে। আমাকে অনুবাদ করে বোঝালো—ও খুব লজ্জিত যে ওদের ল্যান্ডরোভার গাড়িটা আনতে পারেনি, ছোট গাড়ি নিয়ে এসেছে।
বললাম—তাতে কী, এ গাড়িতে সমস্যা কোথায়?
মোহসীন বললো—আমরা যে পথে যাবো, সেখানে রাস্তা ভালো নেই, তোমার খুব আরাম হবে না।
বলি—মা ফী মুশকিলা।
মোহসীন হেসে ওঠে আরবিতে কী যেনো বলে।
আমি ইংরেজিতে বলি ঐ একটি বাক্য ছাড়া আর কোনো আরবি বাক্য বলতে পারি না।
মোহসীন আবার হাসলো শব্দ করে। প্রায় চিৎকার করে ‘মা ফী মুশকিলা’ বলে দরোজা খুলে দিল। আমাকে বসতে বললো সামনে, তার পাশে। ছানু বসেছে পেছনের সিটে।
আল-আইনের ভেতরে ওমানের বুরেইমি শহরটি ঢুকে আছে। আল-আইন থেকে দুবাই যেতে বুরেইমি পার হয়ে যেতে হয়। আমিরাতের নাগরিকেরা ওমানের এ অঞ্চল দিয়ে যাওয়া-আসা করতে পারেন, কিন্তু গাড়ি থেকে নামতে পারেন না। ওমানের এ অঞ্চলের নাগরিকেরা দুটো পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। একটি ওমান, অপরটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের। আমার পাসপোর্টে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ১৪ দিনের ট্রানজিট ভিসা, ছানুর ভিসা আমিরাতের। সেক্ষেত্রে পুলিশি ভয় খানিকটা বুকের মধ্যে পুষে মোহসীনের গাড়ির সওয়ার হলাম আমরা দুজন।
আল-আইন পার হয়ে বুরেইমিতে গাড়ি থামালো মোহসীন। হঠাৎ কিছু না বলে এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকে গেলো। আমিও গেলাম পিছু পিছু। কয়েকটা ফিল্ম কেনা হলো। মোহসীন দুই বাক্স জুস কিনলো রাস্তার পানীয় হিসেবে। এক বাক্সে দশ প্যাকেট জুস। তার একার জন্য তো বটেই, তিন জনের জন্যেও এই পরিমাণ যথেষ্ট। আমার দিকে তাকিয়ে বলে—আর কিছু আমার লাগবে কিনা। লজ্জায় পড়ে যাই। এমনিতে তার গাড়ির তেল পুড়িয়ে আমাকে তাদের পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে, তার উপর বিশ প্যাকেট আমের রসই তো অনেক বেশি। আর কী নেবো। ভদ্রতা দেখানোর জন্য বললাম—দামটা আমি দিই?
মোহসীন প্রায় রাগ করার ভঙ্গিতে বললো—কেন? তুমি তো আমার অতিথি। আজকের সব খরচ আমার।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের গাড়ি শহর অঞ্চল ছেড়ে মরুভূমির ভেতর দিয়ে চলা শুরু করলো। বললাম—আমরা কোথায় যাচ্ছি?
মোহসীন বলে—এই রাস্তা যেখানে গিয়ে শেষ হবে, সেখানে।

এরকম লং ড্রাইভে আলাদা উত্তেজনা কাজ করে। কোথায় যাচ্ছি, জানি না। যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, সেটা গাড়ি চলার মতো সে রকম রাস্তা নয়। আমিরাতের সড়কগুলোর মতো ওমান এখনো ততটা উন্নত হয়নি। মরুভূমির ভেতর দিয়ে বালু আর পাথরের টুকরা বিছানো পথ। ছোট রাস্তা। এই পথ দিয়ে গাড়ির চলাচল প্রায় নেই বললে চলে। মোহসীন বললো—এই রাস্তাগুলো ছিলো মূলত বেদুইনদের চলার পথ। উট নিয়ে এই সব পথে আগের মানুষেরা চলতো। উল্টা দিক থেকে গাড়ি ক্রস করতে হলে একটা গাড়িকে রাস্তা থেকে সরে যেতে হয়।
এ রকম রাস্তায় এর আগে যাওয়া হয়নি। ডানে-বাঁয়ে বালুর সমুদ্র। সামনে, বেশ দূরে, সারি সারি পাহাড়। ধূসর বর্ণের। মোহসীনকে বললাম—এই পথ নিশ্চয়ই ঐ পাহাড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে।
মোহসীন বলে—আমরা শেষ পর্যন্তই যাবো। আমি নিশ্চিত, মরুভূমির উপর দিয়ে যেতে তোমার ভালো লাগবে।
মোহসীন যেখানে গিয়ে গাড়ি থেকে নামলো, তা আমাকে অভিভূত করলো না। ছোট্ট একটা ঝরনাধারা। পাথরের উপর দিয়ে খুব স্বচ্ছ, ঠাণ্ডা পানির প্রবাহ। দুপাশে অবশ্য পাথরের পাহাড়। একটা দুটা স্বল্পদীর্ঘ গাছ। ১০-১২ ফুট উঁচু হবে, তার বেশি নয়। মোহসীন বলে—কেমন লাগছে?
বলি—বেশ সুন্দর। কিন্তু আমাদের জাফলং বা মাধবকুণ্ডের কাছে এটা কিছুই না।

মোহসীন মন খারাপ করে ফেললো। সে বললো—চলো, ৪০ কিলোমিটার দূরে আরেকটি ঝরনাধারা আছে, সেটা নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে। আমি আসলে সেখানেই যেতে চেয়েছিলাম—মাঝপথে এই জায়গায় নামলাম।
আমরা রওনা দিলাম ওমানের মাহদা অঞ্চলের দিকে।
১৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলতে থাকে। দূরে একটা দুটো উট দেখা যায়।
একবার মোহসীন বলে উঠলো—ঐ উটগুলো খুব খারাপ, ওরা মানুষ মেরে ফেলে।
‘মানুষ মারে কীভাবে?’
মোহসীন এবার আর কথা বলে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করি—‘উটেরা মানুষ মারে কীভাবে?’
মোহসীন আরো জোরে গাড়ি চালায়। কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর হঠাৎ একটা পাহাড়ের মোড় ঘুরিয়ে গাড়িটা ব্রেক করে। আমাকে বলে—‘নামুন, আপনাকে একটা জিনিস দেখাবো।’
নেমে গেলাম। সাথে ছানুও।
মোহসীন বলে—একমাস আগে, আজকের দিনে, আমার বাগদত্তাকে একটা উট মেরে ফেললো।
মোহসীনের চাচাতো বোনের সাথে তার বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো।
মেয়েটিকে তার পছন্দ ছোটবেলা থেকে। ঠিক হয়েছিলো এ বছর জুলাই মাসে তার পরীক্ষা শেষ হলে দুজনের বিয়ে হবে।
এক মাস আগে এই দিনে মেয়েটিকে নিয়ে সে এই ঝরনা দেখতে এসেছিলো। তার সাথে ছিলেন চাচা-চাচি আর চাচাতো বোন। ঝরনা দেখে আল-আইন ফেরার পথে এই জায়গায় সে যখন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলো, তখন হঠাৎ করে একটা উট তার গাড়ির সামনে এসে পড়লো। গাড়ি চালাচ্ছিলো খুব জোরে। পাহাড়ের বাঁক ঘুরিয়েই যখন দেখলো উটটি রাস্তায়, তার গাড়ির সামনে, তখন শক্ত ব্রেক ধরা ছাড়া তার উপায় ছিলো না। কিন্তু তাতেও রক্ষা হলো না তার গাড়িটির। উটের সাথে ধাক্কা লেগে গাড়িটি উল্টে যায়। মেয়েটি বসেছিলো তার ডানপাশের সিটে। তাকে রক্ষা করা গেলো না। স্পট ডেড।
খুব দ্রুত ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে মোহসীন নিচের বালুর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
মোহসীনকে সান্ত্বনা দেবার মতো ভাষা আমার জানা নেই। যে ভাষায় তার সাথে আমার ভাব বিনিময় হচ্ছে, সেই ভাষায় এসব পরিস্থিতিতে বেশি কিছু বলাও যায় না। আমিও তার সাথে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম।

মোহসীন গাড়িতে উঠে পড়লো। সাথে আমিও। এতক্ষণ পর সে গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারের বোতামে টিপ দিলো। একটা আরবি গান। ধুমধাড়াক্কার মতো। বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। কিন্তু তার ধারণা হলো, আমার হয়তো ভালো লাগছে না। মোহসীন পাল্টিয়ে আবুধাবি রেডিওর ইংরেজি গানের চ্যানেল অন করে দিলো।
দীর্ঘক্ষণ পরে বললাম—তুমি কি প্রায়ই এখানে আসো?
মোহসীন বলে—‘না, আগে একবারই এসেছিলাম আমার প্রেমিকাকে নিয়ে। আজ এলাম শেষবার। আর আসবো না।’
—কেন?
—আমি সহ্য করতে পারবো না, রাস্তাটি দেখলেই আমার তার কথা মনে পড়ে যাবে।
—তবে আজ এলে কেন?
আজকের দিনটির জন্য। গত মাসের ৮ তারিখে চলে গেলো এখান থেকে। আজ জায়গাটা দেখে গেলাম।
ওর কথা শুনে আমার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হলো। এতক্ষণ মনে হয়েছিলো—আমাকে দেখানোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন দেখছি—বিষয়টা সেরকম নয়। প্রেমিকার বিষণœ স্মৃতির সাথে আমার আগমন নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা। আমার মনে হলো—তাকে আর ঘাঁটানো ঠিক না। বললাম, চলো আমরা আল-আইন চলে যাই, আর কোথাও যাবো না।
মোহসীন চিন্তিত স্বরে বললো—কেন? কেন যাবে না।
এর কারণ ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছা হলো না। মুখে বললাম—তোমার মনটা খারাপ, এসময় তোমাকে আর ঘোরাতে চাই না।
কিন্তু মোহসীন মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন করে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো—ও কিছু না, আমরা এখন আরো বড় একটা পাথরের পাহাড়ের দিকে যাচ্ছি। ওটা তোমার ভালো লাগবেই।
অনেক পথ মাড়িয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে আরেক জনপদে এসে হাজির হলাম। মোহসীনকে বললাম—তোমাদের এখানকার একটা নিখাদ গ্রাম দেখতে চাই। কিংবা ধরো গুহা-টুহা, যেখানে গরিব মানুষজন থাকে।
মোহসীন হাসে। বলে, সে রকম অবস্থা এখন নাই।
বললাম—আমরা বইতে পড়েছি, আরবের লোকেরা গুহার ভেতরে বাস করতো।
: তখন আমাদের তেল ছিলো না, স্বর্ণ ছিলো না, মানুষজন দরিদ্র ছিলো।
আমি তাকাই মোহসীনের দিকে।

মোহসীন কিছুক্ষণ কোনো শব্দ করে না। বেশ পরে, গাড়ি চালাতে চালাতে বলে—দেখি, তোমাকে একটা গ্রামে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।
কিছুদূর গাড়ি চালিয়ে মোহসীন একটা ছোট রাস্তার ভেতর ঢুকে গেলো। একটা পাহাড়ের পাশে গাড়ি থামিয়ে বলে, ‘নামো, এটা একটা গ্রাম।’
গ্রাম সম্পর্কে আমার ধারণা ভিন্ন। তাই আমি নামতে ইতস্তত করছি। ধু-ধু মরুভূমির মাঝে ধূসর বর্ণের কিছু ঘাস। অল্প উঁচু দু চারটি খেজুর গাছ। এর মাঝখানে একতলা পাকা বাড়ি একটা দুটো। এই হচ্ছে গ্রাম।
কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে আমার চোখ টানলো একটি উপত্যকা। এ উপত্যকায় খেজুর গাছের ছাউনির নিচে অনেক ছাগল প্যাঁ পোঁ করছে। একটা গাছ, তার নিচে চাদর বিছিয়ে বসে আছে এক বৃদ্ধ। মাথায় পাগড়ি।
মোহসীনকে বলি—ঐ বুড়োর সাথে আমি কথা বলতে চাই। মোহসীন আমাকে দূরে দাঁড় করিয়ে লোকটির কাছে গেলো। দুজন পরস্পরের নাক লাগিয়ে সম্ভাষণ জানালো। আরবিতে কথা হলো পরস্পর। তারপর আমাকে নিয়ে তার কাছে গেলো। এর মধ্যে বুড়ো আরেকটা চাদর বিছিয়ে বসতে দিলো।
এই গাছতলায় বসতে যে কারোরই প্রশান্তি লাগার কথা।
বুড়োটি সম্পর্কে কৌত‚হলী হয়ে পড়ি। ওর নাম আলী বিন সাইদ। বয়স কত, তিনি নিজেই জানেন না। তবে আমাদের অনুমান আশির উপর। বিয়ে করেছেন দুটো। ছেলেমেয়েরা সবাই শহরে থাকে। দুটো বৌ থাকে দূরের পারে বাড়িতে। তিনি কারো কাছে থাকতে পছন্দ করেন না।
না ছেলেমেয়ে, না বৌ। তার কতগুলো ছাগল আছে, সেগুলো চরান, ওগুলোর সাথেই একটা ভাঙা ঘর, যার বেড়া ও ছাদ খেজুর গাছের পাতা দিয়ে বানানো, সেখানেই থাকেন। এখানেই তার খাবার আসে বৌদের কাছ থেকে।
আলীর সাথে আমার কথাবার্তা বেশিদূর এগোতে পারে না। প্রথম কারণ দুজনের মাঝখানে যে দোভাষী, সেই মোহসীনও সব ইংরেজি বোঝে না, এর উপর মোহসীনের কথা হলো—এই লোক যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে, সে ভাষাটিও মোহসীন ভালোভাবে বুঝছে না।
আলীর আস্তানায় একটা নোংরা প্লেটে ঢাকনা দিয়ে রাখা খেজুর এবং একটা ফ্লাস্ক আছে। ফ্লাস্কের মধ্যে ‘ঘাব’। মোহসীন বললো—‘এটাকে আরবি কফি বলে, তুমি খাবে?’
দেখলাম—এক ধরনের চা পাতার নির্যাস, রং প্রায় কালো রঙের। একটা ছোট্ট কাপে দেয়া হলো সামান্য কফি। সবার আগে আমাকে। ইতস্তত না করে এক চুমুকে শেষ করে দিলাম। কোনো স্বাদ পেলাম না। আমার পর ঐ কাপ বাড়িয়ে দেয়া হলো ছানুর দিকে। সে বাংলায় বললো আমাকে—ওসব খেয়েছি, আমি খাবো না। সেই কাপ চলে গেলো মোহসীনের হাতে। ও খুব যতœ করে খেলো।
নোংরা প্লেটে অনেক খেজুর। পাশ দিয়ে মোটামুটি মাছি ভন ভন করছে। আলী আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন প্লেট। একটা খেজুর মুখে দিলাম। খেজুরের সাথে বালিও মেশানো আছে। কষ্ট করে একটা খেলাম। আলী গাছ দেখিয়ে কী যেন আরবিতে বললো। মোহসীন বুঝিয়ে দিলো। এটা ঐ গাছের খেজুর।

লোকটির ঐশ্বর্য আছে, বোঝা গেল। কিন্তু সে কিছুই ভোগ করতে চায় না। তার ছেলেরা চেয়েছিলো এই পুরোনো বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে যেতে, যেখানে বড় ভিলায় তারা থাকে। কিন্তু আলী যাবেন না। তাঁর কথা—আমি এইখানেই মরতে চাই। এই জায়গার মতো শান্তি শহরের বাড়িতে নেই।
আমার ক্রমাগত প্রশ্ন বৃদ্ধকে বিব্রত করে তুললো। এর মধ্যে আমি ক্যামেরা বের করে কয়েকটি ছবি উঠাতে গেলাম। আলী চান না তার ছবি তুলি। নিষেধ করলেন।
কারণ জানতে চাইলেন। কিন্তু তাকে সন্তুষ্ট করা গেল না।
একসময় আরবিতে চিৎকার শুরু করে দিলেন এবং বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে একটা লাঠি হাতে নিলেন।
মোহসীন আমাকে আগলে নিয়ে বললো, চলো, তাড়াতাড়ি বেরোই, এই ছবি তোলার জন্য এই লোক ক্ষেপে গেছে তোমার উপর।
আমরা দ্রুত জায়গা ছাড়লাম। কিন্তু লোকটির কথা ভুলতে পারলাম না। তাকে আমার রহস্যময়ই মনে হলো। কিন্তু কেন? তার ক্ষেপে যাবার কারণটি আমার বোঝা হলো না। গাড়িতে উঠে এসে তাকিয়ে রইলাম তার আস্তানাটির দিকে। জানি, এই জনমে আর কখনো তার সাথে আমার দেখা হবে না।
মোহসীনকে বললাম—ঐ লোক এমন আচরণ করলো কেন?
মোহসীন হাসে। বলে, লোকটি এমনিতেই বদমেজাজি। এই কারণে বৌ ছেলেমেয়েরা তাকে আলাদা করে দিয়েছে। তোমার উপর ক্ষেপেছে ছবি তোলার জন্য। সে চায় না, তার ছবি অন্য কেউ দেখুক।
এই বেদুইন বৃদ্ধকে ফেলে রেখে আমরা গেলাম কঠিন পাহাড় দেখতে। ওমানের মাহদা রাজ্যের শেষ প্রান্তে। সারি সারি পাহাড়। শিলা পাথরের পাহাড়। পৃথিবী সৃষ্টির পর যে কঠিন রূপান্তরিত শিলা ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে বালুরাশিতে পরিণত হয়েছে, তারই অবশিষ্টাংশ এখনও আছে পাঁচ হাজার কোটি বছর ধরে এইখানে। এ পাহাড়গুলোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী। স্বচ্ছ, ঠাণ্ডা পানি। এ দুর্গম গিরিপথে খুব কম পর্যটকের আসা হয়। জনমানবহীন পাহাড়ের একটি শক্ত টিলার উপর উঠে বসে পড়লাম। তার অমসৃণ গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে মনে হলো—হয়তো এই পাথরে এইমাত্র কোনো মানবের প্রথম স্পর্শ পেলো।
নিচে নেমে গেছে মোহসীন। আমার সাহস হলো না। যদি উঠতে না পারি? মোহসীন উপরে উঠে। হাতে একটা ভিস্তি। এর একটা আরবি নাম আছে, কিন্তু আমার সেটা মনে নেই। ছাগলের আস্ত চামড়া দিয়ে বানানো একটা জলাধার। অন্য কোনো জায়গা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে এসে আটকা পড়েছিলো কোনো এক পাথরের গায়ে। মোহসীন বলে, এইগুলো দিয়ে আগের বেদুইনরা পানি খেতো। যখন মাইলের পর মাইল উটের পিঠে চড়ে তপ্ত মরুভূমি পার হতো, তখন সঙ্গে থাকতো এই ভিস্তি। এইটাই ছিলো জীবনধারণের প্রধান খাবার।
এখন সেই সময় নেই। রাস্তার পাশে সরকারি নিয়ন্ত্রণে বসিয়ে রাখা হয়েছে ঠাণ্ডা পানির কল। টিপ দিলেই পানি আসে। মোহসীনের দাদারা উটে চড়ে যখন এ পাহাড়ে আসতেন, তখন ঐ ছাগলের চামড়া দিয়ে বানানো ব্যাগটা ভরে পানি নিয়ে আসতেন জীবন বাঁচাতে। এখন মোহসীন আসে ল্যান্ডরোভারে করে। তার গাড়ির পিছনের সিট ভরা থাকে বোতল ভরা ঠাণ্ডা পানি, নানা জাতের ফলের রসের ব্যাগ। মোহসীন হয়তো তার দাদার জীবনযাপনের ঐ তথ্যটিও জানে না। কারণ, ইতিহাস পড়া বা পড়াশোনার মতো পরিবেশ তাদের এখন মাত্র তৈরি হচ্ছে, ধীরে ধীরে।
শেখ জায়িদের পূর্বপুরুষদের আস্তানায়

আল-গাতারায় শেখ জায়িদের প্রাচীন নানা বাড়ির প্রাসাদটির ভগ্নাংশ এখন পর্যটকদের টানে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসে এটা দেখতে। একটা দেয়ালের গায়ে আরবিতে দুটো হরফ লিখে একটা ‘+’ চিহ্ন দেয়া আছে। এমন চিহ্নসমূহ আমাদের দেশের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটেও দেখা যায়। যেমন দেখা যায় সস্তা হোটেলের দেয়াল এবং বাথরুমের দরজায়ও কিন্তু দু লাইনের একটা বাক্য দেখে পড়ার চেষ্টা করলাম। জের জবরহীন আরবি বাক্য পড়া এবং বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। সিরাজি আমার দিকে চেয়ে একটু হাসলো। বললো—ওখানে কী লেখা আছে আপনি পড়তে চাচ্ছেন তো! মাথা নাড়লাম।
সিরাজি বললো—ওখানে লেখা আছে ‘দারমুকি জাতির পুংলিঙ্গ খুব শক্তিশালী। বলে হাসলো। তার পুরো মানে বুঝতে পারলাম না। সিরাজি বললো—এটা বিদ্রুপ করে লেখা। শেখদের বাড়ির দেয়ালে কোনো দারমুকি তরুণ বিদ্রুপ করে এই কথা লিখেছে।
তার মানে শেখদের রাজত্বের প্রতি অনীহার আশংকা কি আছে?
এমন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আসাদ সাহেবও। তিনি বলেছিলেন—‘আসছে, দারমুকিরা আসছে।’ শেখদের একতরফা রাজতন্ত্র চালানোর দিন হয়তো শেষ হয়ে আসছে।
কিন্তু শেখ জায়িদের অভাবনীয় জনপ্রিয়তা দেখে একথা কারো মনে হবার নয় যে শেখ পরিবারকে শাসন-ক্ষমতা চালাতে কেউ আপত্তি জানাবে। আরব সাগরে মাছ ধরা আর মুক্তা খোঁজা-নির্ভর একটি দরিদ্র জাতিকে ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দেবার পিছনে এই বৃদ্ধের ভূমিকা অনেক। এই কথা আমিরাতের সব নাগরিক শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার করেন। একারণেই হয়তো ১৯৭১ সালে এই দেশ গঠিত হবার পর থেকে পরপর পাঁচবার বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে আসছেন। এবং এ কথা প্রায় সবাই জানেন যে, শেখ জায়িদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাত অন্য কাউকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও আশা করে না।
শেখ জায়িদের পিতামহ শেখ জায়িদ বিন খলিফা আল-নাহিয়ান ১৮৫৫ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত আমিরাতের আবুধাবি অংশের শাসক ছিলেন। একটানা ৫৪ বছর ধরে শাসন করার কথা আমিরাতের ইতিহাসে অন্য কোথাও নেই। শেখ জায়িদের পিতা ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত শাসন কার্য পরিচালনা করেন। এর পরে ১৯২৮ সালে কিছু সময়ের জন্য শাসক নিযুক্ত হন তার এক চাচা শেখ শাখবুথ।
জীবনের শুরুতে শেখ জায়িদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। তাঁর ছোটবেলায় সমগ্র আমিরাতে এমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না যেখানে গিয়ে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতেন। মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে পাওয়া ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে তাঁর কোনো শিক্ষা গ্রহণ করা হয়নি।
উত্তপ্ত মরুভূমিতে, প্রবল পানীয় জলের সংকট নিয়ে তিনি বেদুইনদের সাথে দিন কাটাতে শুরু করেন কিশোর বয়সে। ১৯৩০ সালের দিকে তাঁর একটা চাকরি হয়।
পশ্চিম থেকে আসা সর্বপ্রথম তেল উৎপাদনকারী টিম মরুভূমিতে প্রাথমিক জরিপ কাজ চালানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে শেখ জায়িদকে গাইড নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৬ সালে তিনি নিযুক্ত হন আমিরাতের শাসকের আল-আইন মরু অঞ্চলের প্রতিনিধি। এসময় তিনি আল-আইন অঞ্চলের প্রাকৃতিক উন্নয়নের কথা ভাবেন। শুরু করেন পানীয় জল সরবরাহের চেষ্টা। আল-আইনকে একটা বাগান শহরের রূপ দেবার পরিকল্পনা তিনি তখনই গ্রহণ করেছিলেন। এবং সে অনুসারে রাস্তাঘাটের পাশাপাশি সবুজ বৃক্ষায়নে তিনি ব্রতী হন। ১৯৫৩ সালে শেখ জায়িদ ইউরোপ ভ্রমণে গেলে তাঁর দৃষ্টি অন্যদিকে প্রসারিত হয়। তিনি মনে করতে শুরু করলেন যে, যেভাবেই হোক আধুনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমিরাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। শেখ জায়িদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক ক্ষমতায় সীমিত সম্পদের মধ্য থেকে আমিরাতের উন্নয়ন শুরু হয়ে যায়। শেখ জায়িদকে নেতৃত্বের দিকে ঠেলে দেয় আল-নাহিয়ান পরিবার। ১৯৬১ সালের ৬ আগস্ট এক পারিবারিক বৈঠকে ঠিক হয় তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে বদলি করে তাকেই বানানো হবে আমিরাতের শাসক। ১৯৬৮ সালে ব্রিটেন ঘোষণা দিলো ১৯৭১ সালে তারা উপসাগরীয় অঞ্চল ছেড়ে দেবে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে আমিরাতের অঙ্গরাজ্যসমূহ নিয়ে গঠিত হলো ইউএই (সংযুক্ত আরব আমিরাত)। শেখ জায়িদকে নির্বাচন করা হলো প্রথম প্রেসিডেন্ট। সেই থেকে আজ অবধি সুদক্ষ প্রশাসন নিয়ে শাসন করছেন শেখ জায়িদের পরিবার।
শেখ জায়িদ বিন সুলতান আল-নাহিয়ান সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি আবুধাবি অঙ্গরাজ্যের শাসক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। এ সব সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী শেখ মখতুম বিন রাশিদ আল মখতুম হচ্ছেন তার ভাই। তিনি দুবাই রাজ্যের অধিপতি। অন্য ভাইদের মধ্যে শেখ হামদান বিন রাশিদ আল মকতুম হচ্ছেন আমিরাতের অর্থমন্ত্রী, শেখ মুহাম্মদ বিন রশিদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।

শেখ জায়িদের বড় ছেলে যুবরাজ শেখ খলিফা বিন জায়িদ আল নাহিয়ান। অন্যান্য ছেলেদের মধ্যে শেখ সুলতান বিন জায়িদ আল নাহিয়ান উপপ্রধানমন্ত্রী, শেখ মোহাম্মদ বিন জায়িদ আল নাহিয়ান বিমানবাহিনীর প্রধান, শেখ হামদান বিন জায়িদ আল নাহিয়ান আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শেখ আব্দুলাহ্ বিন জায়িদ আল নাহিয়ানকে দেয়া হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রীর পদ, শেখ হাজ্জা বিন জায়িদ আল নাহিয়ান হচ্ছেন পুলিশ বাহিনীর প্রধান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৭টি স্টেট—আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ, আজমান, রা’স আল খাইমাহ, উম্মাল কুউয়াইন ও ফুজিয়ারার প্রতিটির শাসকই আল নাহিয়ান পরিবারের কেউ না কেউ। এমনকি গার্ডেন সিটি আল-আইনের গভর্নর হচ্ছেন—শেখ তাহনুম বিন মোহাম্মদ আল নাহিয়ান। তিনি শেখ জায়িদের জামাতা এবং চাচাতো ভাই, আবার অন্য সম্পর্কে পরস্পরের বেয়াই।
আমিরাতের সবচে খানদানি গোত্র হচ্ছে শেখ পরিবার। এরপর আছে দারমুকি, মনসুরি, শামসী, খিলী, আমরি, দাহিরী, আদারী। এদের বিয়ে শাদী এবং সামাজিক আচার আচরণ গোত্রকে অতিক্রম করে খুব বেশি হয় না। বিয়ের ব্যাপারে তারা গোত্রকে প্রাধান্য দেয় সবচে বেশি। এক্ষেত্রে মেয়ের বিয়ের বয়স পার হলেও না।
বিয়ের ব্যাপারে কিছু মজার খবর পাওয়া গেলো সিরাজির কাছে। সে বললো—বিয়ে হয় তিনদিন ধরে এবং মেয়ের বাপের বাড়িতে। বিয়ের যাবতীয় খরচ বহন করবে বরের বাবা। বিয়ের আগেই নগদ মুদ্রার লেনদেন সেরে নিতে হয়। কয়েক লক্ষ দিরহাম পর্যন্ত বিয়ের সময় খরচ করতে হয় বরের পক্ষকে। মেয়েপক্ষ শুধুই গ্রহণ করবে। অবশ্য এই বিশাল অংকের পণ ছেলেপক্ষ মেটাতে না পারার কারণে অনেক ছেলেও বিয়ের বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারে না। তার জন্য অবশ্য সরকার বসে নেই। ৬ মে, ১৯৯৭ তারিখের খালিজ টাইমস দৈনিকের এক খবরে দেখলাম গত পাঁচ বছরে বিবাহ তহবিল থেকে আমিরাতের নাগরিকদের জন্য ৭৪৬ মিলিয়ন দিরহাম (১ দিরহাম = ১২ টাকা প্রায়) অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এ অর্থে ১৯৯৩ সাল থেকে গত বছরের শেষ সময় পর্যন্ত ১০,৭০০ নাগরিক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু খুব সাদামাটা বিয়েতেও এখন দু লাখ দিরহামের কম খরচ হয় না। সাধারণত বুধ ও বৃহস্পতিবার কনের বাড়িতে আনন্দ উৎসব হয়। শুক্রবারে বিয়ে। বিয়ের দিন ঢোল বাজানো হয়। যদিও ইসলামে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কোনো বৈধতা নেই, তথাপিও বিশেষ ধরনের ঢোল যাকে তারা ‘দফ’ বলে, সেটা বাজিয়ে নাচানাচি করা হয়।

আরব সমাজে বহু বিবাহ খুব বেশি। সম্ভবত এ কারণেই কবুল পড়ার আগে কনের হাতে মোহরানার সব অর্থ গুঁজে দিয়ে আগে থেকে দায়মুক্ত হয়ে যায়। তবে বহু বিবাহের ক্ষেত্রেও সবাই প্রথম বিবাহ আরবি কন্যাকেই করে থাকে। ইদানীং একটা চল চালু হয়েছে বিদেশ থেকে মেয়ে এনে বিয়ে করা কিংবা বিয়ে করে নিয়ে আসা। বিদেশি মেয়ে বিয়ে করার পেছনে প্রধান কারণ, আরব মহিলাদের মতো নগদ অর্থ এসব মহিলাদের দিতে হয় না। ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, মিশর, এসব জায়গার মহিলারা বেশির ভাগ মধ্যবয়স্ক আরবির বৈবাহিক শিকার হয়ে থাকেন। এমনটি বেশিই হয়ে থাকে যে, কাজের বুয়া হিসেবে বাসায় চাকরি করা মেয়েও একটা সময় তাদের স্ত্রী হয়ে যায়। তবে এসব মহিলাদের গর্ভস্থ সন্তান সামাজিকভাবে আরবীয়দের কাছে সমান মর্যাদা না পেলেও সম্পদের ভাগে হেরফের হয় না।
এই বিয়ের বাতিক অনেক প্রকট বর্তমান প্রেসিডেন্ট শেখ জায়িদের। তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা কতো এই হিসাব নাকি তার নিজের কাছেও পাওয়া যাবে না। এমন কথা অনেকে রসিকতা করে বলেন। এই বুড়ো বয়সেও কিছু দিন পরপর তিনি কিশোরী বিয়ে করেন এমন কথা শোনা যায়।
কিন্তু কখনোই একসাথে চারজনের বেশি স্ত্রীকে তিনি রাখেন না। এ নতুন বিয়ের সময় চারজনের মধ্যে প্রবীণতমাকে অনেক অর্থ সম্পদ দিয়ে তালাক দিয়ে দেন এবং পরবর্তীতে তার সাথে আর কোনো যোগাযোগ থাকে না। এমন কথা শোনা যায় যে, বর্তমান যুবরাজ খলিফার মাতা, শেখ জায়িদের প্রথমা স্ত্রীর সাথেও এখন তার কোনো দেখা সাক্ষাৎ নেই। যদিও শেখ জায়িদের প্রেসিডেন্ট হবার নেপথ্যে এই গুণবতী মহিলার অনেক অবদান রয়েছে।
শেখ জায়িদকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে আমিরাতের প্রতিটি মানুষ। এমন কথা শুনেছি অনেকের মুখে। আমিরাতের নাগরিক, অনাগরিক সবাই তাঁর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় মুগ্ধ। শেখ জায়িদ যখন চোখের অপারেশন করাতে গেলেন আমেরিকায়, তখন সমগ্র আমিরাতের মানুষের মনে ছিলো আশংকার ছায়া। সুস্থ হয়ে যখন ফিরে এলেন তখন আনন্দে নেচেছে সমগ্র আমিরাত। সরকার অবশ্য এর প্রতিদান স্বরূপ সকল সরকারি কর্মচারীর এক মাসের বেতন বোনাস হিসেবে দিয়েছেন শোকরানা স্বরূপ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে কোনো রাজনীতি নেই। দলাদলি নেই। নির্বাচনও নেই। হরতাল, ধর্মঘট এসব শব্দ ও দেশের মানুষ শোনেনি কখনো। কেবলমাত্র রাজনৈতিক দলাদলি নয়, কোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন করারও বৈধতা নেই সমস্ত সাম্রাজ্যের কোথাও। তবে বাঙালিরা ভেতরে ভেতরে দলাদলি করে আসছেন প্রকাশ্যে এবং গোপনেও। যদিও জামায়াতে ইসলামির কোনো স্বীকৃতি নেই আমিরাতে তবুও রফিক শিকদারকে সভাপতি এবং ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল লতিফকে সহ-সভাপতি করে আবুধাবিতে এর সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসেন সে সরকারের কয়েকটি সংগঠন একই শহরে এক সাথে গজিয়ে ওঠে। সরকারপ্রধান বা মন্ত্রী, মেয়র এসব অঞ্চলে সফরে গেলে তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যেও জন্ম হয়ে যায় একই নামে একাধিক সংগঠন। এসব ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার নামযুক্ত জনকল্যাণ সমিতিও আছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে। এসবের প্রকৃত কাজ কী তা জানা যায়নি, তবে সংগঠকদের দু-একজন হতাশার সাথে জানিয়েছেন—কেউ কাজ করে না, মিটিং ডাকলে আসে না, নামে মাত্র সংগঠন।
আল-গাতারার সুখ দুঃখ

আল-আইন শহরের একটু বাইরে আল-গাতারা একটি গ্রাম। গ্রাম বললে ভুল হবে, আসলে ওটি একটি প্রাচীন জনপদ। সারি সারি খেজুর বাগানের পাশে কতগুলো পুরোনো মাটির ঘরকে আমিরাত সরকারের প্রতœতত্ত¡ বিভাগ খুব যতœ করে সংরক্ষণ করা শুরু করেছে।
এই গাতারা গ্রামের ছোট্ট মসজিদের ইমাম অলিউর রহমান সিরাজি। সিরাজি আর আমি একই গ্রামে জন্মেছি, বড় হয়েছি। বয়সে সে আমার ৩-৪ বছরের ছোট হবে। গ্রামের আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষ করেই চলে এসেছে এই চাকরিতে। অবশ্য এর আগে তার বাবা ছিলেন এই মসজিদের ইমাম। ৪-৫ বছর হলো বাবাকে বদলি দিয়ে নিজেই ইমামতি করছে।
সিরাজি যে মসজিদে ইমামতি করে সেটিকে একটি পারিবারিক মসজিদ বলা যায়। আমিরাতে এরকম পারিবারিক মসজিদ বহু আছে। তার ভাষায়—নিজে নিয়মিত নামাজ না পড়লেও তারা মসজিদ বানায় অনেক। কেউ কেউ একাধিক মসজিদও বানায়। এই মসজিদের মালিক মোহাম্মদ রসুল খুরী। তিনি বিখ্যাত রোলেক্স ঘড়ি কোম্পানির একজন অংশীদার। নিজে অবশ্য নামাজের প্রতি তেমন আগ্রহী নন। কিছু কিছু পানের অভ্যাসও আছে। এরকম স্বভাব বেশির ভাগ আরবিরই। অবশ্য নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে মহিলারা বেশি পিছিয়ে।
সিরাজি বললো—ওরা খুব অলস। একটুও হাঁটতে চায় না। পঞ্চাশ গজের বেশি দূরে মসজিদ হলে নামাজ পড়তে যাবে না। এ কারণে পাড়ায় পাড়ায় কিছুদূর পরপর অনেক মসজিদ চোখে পড়ে।
আল-গাতারায় একটা ছোট টিলার উপর একটা মাটির ঘর দেখিয়ে সিরাজি বললো—এই মসজিদের নাম ‘মসজিদ কাদিম গাতারা’। এটি হচ্ছে এখন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সবচে পুরোনো মসজিদ।
সবচে পুরোনো এ মসজিদ দেখার জন্য আমার আগ্রহ বেড়ে গেলো। ধীরে ধীরে টিলার উপর উঠে দেখি জনমানবহীন এক লোকালয়ে একটি ছোট্ট মাটির ঘর। একটি আদর্শ মসজিদের প্রায় সব ক’টি উপাদানই এ মসজিদে আছে। সামনে মিহরাব, ভেতরের মূল ঘর, বাইরের বারান্দা, মসজিদের সামনে বড় ‘শান’ এবং এক কোণে একটা ছোট্ট ইঁদারা, যেখান থেকে বালতি দিয়ে পানি উঠিয়ে ওজু করা হতো। মসজিদের পাশে একটা পাইপের মাথায় দু দিকে দুটো মাইক স্পিকার লাগানো। প্রায় দু ফুট পুরু মাটির দেয়াল দিয়ে বানানো এ মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্বে দুটো ছোট্ট জানালা। ভেতরে অন্য মসজিদগুলোর মতো দেয়াল থেকে দেয়াল পর্যন্ত দামি কার্পেট নেই, আছে খেজুর পাতা দিয়ে তৈরি চাটাই।
দশ ফুট উঁচু এ মসজিদের প্যারাপেটের কাজও মাটি দিয়ে। পুর খিলান চতুর্দিকে। কোনার খিলানটি বাদ দিলে সবদিকে ৭টি করে ত্রিভুজাকৃতির খিলান। এই হচ্ছে আল-আইনের প্রাচীনতম মসজিদের নমুনা।
এই মসজিদ এখনও আমিরাত সরকারের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ বিভাগ তার হেফাজতে নেয়নি। যেমনটি ছিলো ঠিক সেভাবেই পড়ে আছে। মসজিদের চারপাশে একটু দূরে দূরে অনেক মসজিদ বানানো হয়েছে। আল-আইনে বসবাসকারীরা সেসব মসজিদেই নামাজ পড়েন। তবে এ মসজিদের ইমাম সাহেব এই মসজিদের মায়া ছাড়তে পারেননি। তাঁর বয়স হয়েছে প্রায় নব্বই বছর। জীবনের বৃহত্তম পরিসর তিনি এই মসজিদের ইমামতি করে কাটিয়েছেন। ছোটবেলায় শেখ জায়িদকেও তিনি এই মসজিদে নামাজ পড়িয়েছেন। মসজিদটির প্রতি তাঁর একটা হৃদ্যিক সম্পর্ক আছে। সময় পেলে এবং শরীর ভালো থাকলে তিনি মাঝে মাঝে এসে আজান দেন। নিজেই ইমামতি করেন এবং একা একা নামাজ পড়ে চলে যান। আমিরাত সরকার অবশ্য তাঁর এ কাজের পুরস্কার দিয়ে আসছে। মাসে মাসে তিনি সাড়ে চার হাজার দিরহাম বেতন পান সরকারের কাছ থেকে। কেউ নামাজ পড়–ক কিংবা না পড়–ক ইমাম সাহেবের তাতে কিছুই যায় আসে না।

আল-আইন শহরে এবং তার আশপাশ সাবিয়াতে প্রায় ১০-১২ জন বাংলাদেশি ইমাম আছেন। সিরাজি যে মসজিদের ইমাম, সেটি সরকারি মসজিদ নয়। সরকারি মসজিদগুলোর ইমামদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বেসরকারিগুলোর চেয়ে বেশি। তবুও মসজিদের সাথে দুই বেডরুমের একটা কোয়ার্টার আছে সিরাজির। তার ছোট ভাই, স্ত্রী ও পুত্র আব্দুলাহ্কে নিয়ে সে থাকে। বেতন প্রায় দেড় হাজার দিরহাম।
এই গাতারা গ্রাম ঘুরে দেখানোর কথা বলেছিলো সিরাজি অনেকদিন থেকে। গ্রামটির অতীত ঐতিহ্য আছে। সিরাজির সাথে আমাদের সঙ্গী ছিলেন ডা. মেসবাহ। অত্যন্ত অমায়িক ডাক্তার। অবশ্য এর আগে আমি তার সুনাম শুনেছি অন্য বাঙালিদের কাছে। প্রায় ১৪ বছর ধরে তিনি আছেন আল-আইন হাসপাতালে। চাকরির শুরুতে বছর দুই ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। তারপর সরাসরি এখানে চলে আসা।

ডাক্তার মেসবাহর আগ্রহ আছে পুরোনো জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার। সিরাজি যেহেতু এই গ্রামেই থাকে, সবকিছুই তার নখদর্পণে। আমরা খেঁজুরের কাঁটা ছড়ানো মেঠোপথ দিয়ে কয়েকশ গজ হেঁটে একটা পুরোনো বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। চারদিক মাটির দেয়াল। এর মধ্যে মাটির সিঁড়ি বেয়ে একটা দোতলা ঘর। লম্বাটে। প্রায় ৮ ফুট প্রস্থ, ৫০-৬০ ফুট দীর্ঘ। আগের দিনের তাদের সব বাড়ি অনেকটা এই ধাঁচেই হতো। নির্মাণগত কারণেই সম্ভবত ঘরগুলোর চওড়া বেশি হতে পারতো না। যেহেতু খেজুরগাছের ছানি দিয়ে তার উপর মাটি বিছিয়ে ছাদ বানাতে হতো, সেহেতু একটা নির্দিষ্ট আকারের বেশি স্লাব দেয়া সম্ভব হতো না। গরম রোদ ঠেকানোর জন্যে দেয়াল করতে হতো ২র্০র্ -২র্৪র্ পুরু। বাতাসেও যেহেতু শীতলতা নেই, তাই ছোট্ট ছিদ্রবৎ জানালা। এক দেড় ফুট চওড়া। এসব বাড়িতে আবার দুর্গ থাকতো বাড়ির চারকোণে। শত্র“দের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে সৈন্যদের বসিয়ে রাখা হতো দোতলার উপর তীর ধনুক শানিয়ে।
এমন ডিজাইনের বাড়ি এর আগেই আমার দেখা হয়ে গিয়েছিলো আল-আইন জাদুঘরে। জাদুঘর—কমপ্লেক্সের মধ্যেই একটা পুরোনো বাড়িকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে পর্যটকদের জন্যে। বাড়িটিতে একশ বছর আগে থাকতেন প্রেসিডেন্ট শেখ জায়িদের দাদা। পরবর্তীতে বাড়িটি ব্যবহৃত হয়েছে জেলখানা হিসেবে এবং সর্বশেষে প্রায় কুড়ি বছর ধরে বাড়িটি ব্যবহৃত হচ্ছে পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান হিসেবে। বাড়ির সামনে মূল প্রবেশ তোরণে দুটো জ্যান্ত কামান। ভেতরে শেখ জায়িদ পরিবারের ছবি। প্রথমে বৈঠকখানা, পরে খাবার ঘর, শোবার ঘর, রান্নাঘর। কোনো এটাচড বাথরুম নেই। এ বাড়িগুলোর আন্ডারগ্রাউন্ডেও একটা ঘর থাকে। প্রথমদিকে এ ঘরগুলোতে রাজা বাদশারা আত্মগোপন করার জন্য ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে যখন এ বাড়িটি জেলখানায় রূপ নিলো তখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আলো বাতাসহীন এসব কুঠরিতে থেকে প্রাক্মৃত্যু যন্ত্রণা উপভোগ করতেন আর শিরñেদের তারিখের প্রতীক্ষা করতেন।

শেখ জায়িদের তিন পুরুষ আগের বাড়িটির বিভিন্ন চত্বর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। আল-আইন জাদুঘরের রিসিপশনিস্ট। বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জে। ৩ বছর ধরে তিনি এই পদে চাকরি করছেন। অত্যন্ত অমায়িক যুবক। আরবি, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি ভালো বলেন। আমিরাত সফরে এসেছি একথা শুনে নিজের চেয়ারে অন্য একজনকে বসিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন আমাকে নিয়ে। মিউজিয়ামটি অবশ্য এখনো দেখার মতো তেমন পর্যায়ে যায়নি। মাত্র ১০ বছর ধরে শুরু হয়েছে তাদের ঐতিহ্য খোঁজার চেষ্টা। প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন এবং প্রাচীন আরবি জীবনযাত্রার চিত্র—এই হচ্ছে দু পর্বে আল-আইন মিউজিয়াম। তবে সবচে বেশি অভিভূত হয়েছি প্রথম চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে সংগ্রহ করে আনা চাঁদের মাটির একটি টুকরো দেখে। ছোট্ট, সম্ভবত র্২র্র্র্র্র্র্র্ দ্ধ২র্ র্ একটি ক্রিস্টালের ভেতর রাখা অর্ধ ইঞ্চি ব্যাসের এক টুকরা মাটি, যা অনেকটা আমাদের নদীর তীরে বালু ঘেরা মাটির মতো দেখতে। ১৯৭৩ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন এই মাটির টুকরো উপহার দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শেখ জায়িদকে। সেই সাথে ১৯৭২ সালের ১-১৯ ডিসেম্বরে এপোলো ১৭ মিশনের চন্দ্রপৃষ্ঠে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পতাকা অবতরণের আলোকচিত্র।

আল-আইন মিউজিয়ামে পুরোনো দিনের ছবিগুলোর পাশে হঠাৎ আঙ্গুল দিয়ে ছানু দেখালো একটা ছবি। আল-আইন শহরের মেইন স্ট্রিট, ১৯৬৮ সালের তোলা। সাদাকালো ছবি। বালির রাস্তা। দু পাশে একটা দুটো পাকা ঘর, কিছু মাটির ঘরও আছে। ছানু বললো—ওর বড় ভাই যে সময় এ শহরে প্রথম আসেন, তখনকার সময়ের এই ছবি। সে সময় এ শহরে কোনো পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ছিলো না। উন্মুক্ত শৌচাগার ছিলো ধু-ধু মরুভূমিতে। মাত্র দুই যুগের ব্যবধানে এ শহর পরিবর্তিত হয়েছে আমূল। দুই যুগের ব্যবধানে আগের শহরকে বিন্দুমাত্র নিজের বলে মনে হবার আর কোনো সুযোগ নেই। এ হচ্ছে তেল ও সোনার দেশ আমিরাতের পরিবর্তন।
কিন্তু এটাও সত্য যে তারা তাদের দীনহীন অতীতের স্মৃতি একেবারেই ভুলে যেতে চাচ্ছে না। গাতারা গ্রামটির পুরোনো বাড়িগুলো তারা যতেœর সাথে সংরক্ষণ করে চলেছে। গাতারায় একটা পুরোনো দুর্গের কাছাকাছি একটা নতুন দুর্গ বানানো হচ্ছে সেই পুরোনো কায়দা কানুনে, সেই পুরোনো নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে। ২০ জন অত্যন্ত দক্ষ মিস্ত্রিকে দিয়ে ৭ বছর ধরে বানানো হচ্ছে দুর্গটি। এখনও তার কাজ শেষ হয়নি।

এই গ্রামেই আছে একটি মার্কেট। ‘গাতারা সুক খাদেম’। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রাচীনতম মার্কেট। এখন মার্কেট শুধু নামে, কাজে এটি একটি দুই সারির মাটির ঘর। ঘরগুলোতে থাকেন সেসব নির্মাণ শ্রমিক, যারা পাশের মাটির দুর্গটি বানানোর কাজ করছেন। কিন্তু একটি ঘরে কেউ থাকে না। আছে কিছু সওদা। দোকানের সামনে এসে থাকেন ৬০ বছর বয়সি এক বৃদ্ধ। তাঁর নাম আলমাছ মোহাম্মদ বিন আহম্মদ জাহেরী। সিরাজি আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যায়। আরবিতে কী কী সব বলে। কিছুই বুঝি না। একবার সিরাজি নিজ হাতে দোকানের ফ্রিজ খুলে এক বোতল জুস আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। ইতস্তত করি। সিরাজি বলে—আপনাকে খেতে বলেছেন। এক ঢোকে খেয়ে পকেটে হাত দিই। আলমাছ চিৎকার করে উঠে। তার ভাষা কিছুই বুঝি না কিন্তু ভাব বুঝি। সে দাম নিবে না। আমি যে তার মেহমান।
সিরাজির মারফত আমি প্রশ্ন করি—এই পাড়াগাঁয়ে ছোট্ট মুদির দোকানটি থেকে আপনার কি কোনো আয় হয়? সিরাজি বুঝিয়ে বলে—এই মার্কেটের মালিক ছিলেন তার পূর্বপুরুষ কিন্তু সরকার সংরক্ষণ করার কথা বলে তাঁর কাছ থেকে এটা কিনে নিয়েছে। সে সময় সরকারকে একটি শর্ত দিয়েছিলেন আলমাছ। মার্কেট নিতে চাও নিয়ে যাও, কিন্তু আমাকে অন্তত একটা দোকান ঘর চালাতে দিতে হবে। সেই শর্ত সরকার মেনে নিয়েছেন। বিক্রি বাট্টা কিছু হোক না হোক তাতে তার কিছু যায় আসে না। পাকিস্তানি একজন সেলসম্যান ওসব দেখে। সময় কাটানোর জন্য তার একটা জায়গা দরকার। নিজের হাতে গড়া সারাজীবনের স্মৃতিমাখা এই মার্কেটে বসে থাকতে তাঁর খুব প্রশান্তি লাগে। তিনি আমৃত্যু এখানেই থাকতে চান। কোনো দৌলতের প্রয়োজন নেই তার।
বিশ-ত্রিশ বছরের ব্যবধানে এই আমিরাতে আলিশান শপিং কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। কিন্তু আলমাছ সাহেবের কোনো লোভ নেই সেখানে। তার মাটির বেড়া আর খেজুরপাতার ছাউনিই তাঁকে দেয় জীবনের পরম অর্জনের সুখ।