‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’ মেধাবী এক কিশোরের আখ্যান- মালেক ইমতিয়াজ।

অক্টোবর ২৯, শুক্রবার। দৈনিক খোলা কাগজে প্রকাশ।

‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮ ‘। বইটি পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে মন চাইবে না। বর্ণনাশৈলি সহজ সরল তবে হৃদয়গ্রাহী। পাঠককে একাগ্র করে রাখার জন্য লেখকের সততা উল্লেখযোগ্য। কোনরকম রাখঢাক ছাড়াই লেখকের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তাঁর পাঠককে বলে দিয়েছেন। সম্ভবত এই সততার কারণেই একজন জনপ্রিয় লেখকের প্রতি পাঠকের আস্হা বেড়ে ওঠে। স্পষ্টবাদিতার জন্য লেখককে জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে কোনও সিরিয়াস পাঠকের। আমার কাছে শাকুর মজিদকেও ঠিক এমনই একজন শক্তিশালী মানের লেখক মনে হয়েছে। স্মৃতিচারণ মূলক এই বইটি মূলত লেখকের কিশোর জীবনের একটি খণ্ডকালিন আখ্যান।বইটি ১৯৭৮ এর জুন থেকে ১৯৭৯’র জুন পর্যন্ত ব্যাপ্তি নিয়ে লেখা।কেমন করে জীবনের এ সময়টি লেখক অতিক্রম করেছিলেন তারই বর্ণনা।

ক্যাডেট কলেজের প্রথম একবছরের নান পরিস্হতিকে চমৎকার করে বর্ণনা করেছেন লেখক। বইটি শুরু হয়েছে গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন কিশোরের ক্যাডেট জীবনের নানা প্রতিকূলতার গল্প দিয়ে।শেষও হয়েছে কিভাবে কেটেছে এই কিশোরের একটি বছর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। গ্রাম ছেড়ে উঠে আসা একজন কিশোর শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে দেখতে পান সবকিছুই নিয়ম কানুনের আবর্তে পরিচালিত হচ্ছে।ধরাবাঁধা নিয়ম দিয়েই ক্যাডেটের যাত্রা শুরু। গ্রামীন জীবনে বেড়ে ওঠা লেখকের জীবনধারা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।ক্যাডেটের সবকিছুই তাঁর কাছে মনে হয়েছে অপরিচিত।যেন একটা বন্দি জীবন। সহপাঠীদের সাথে সামগ্রিক তুলনায়ও নিজেকে পিছিয়ে পড়া মনে হয়েছে। আঞ্চলিক টান ছিল কথাবার্তায়। বাংলা বর্ণ উচ্চারণে ছিল তাঁর সীমাহীন দুর্বলতা। সাধু ভাষায় কথা বলতেও অন্যের কাছে হাস্যকর হয়ে নিজেকে খুব অসহায় মনে করতেন কিশোর শাকুর মজিদ।

লেখাপড়ার পাশাপাশি কলেজের বিভিন্ন খেলাধুলা ও সৃজনশীল চর্চার বহুমুখি সুযোগ ছিল।কোথাও নিজেকে খাপ খাওয়াতে না-পারার বেদনা লেখককে পীড়া দিত। এমনই সব স্মৃতিচারণ ডায়েরির পাতা থেকে তুলে এনেছেন লেখক।বইটির মুখবন্ধে যা লিখেছেন– “রাতের ডিনার শেষে ক্লাস টুয়েলভের ভাইয়েরা নানারকম রসিকতা করল।আমাকে নিয়ে সবাই বেশ হাসাহাসি করল।আমি নাকি সাধু ভাষায় কথা বলি।আমাকে বলা হলো আশরাফ যেভাবে কথা বলে সেরকম কথা বলতে।আমি জানি না কীভাবে আশরাফের মতো কথা বলা যাবে।” অন্য জায়গায় লিখেছেন “আমার রুম প্রিফেক্ট ক্লাস নাইনের বাশার ভাই।বাশার ভাই আশরাফকে ডাকেন।বলেন,’তুমি শাকুরকে উচ্চারণ শিখাবা,ননসেন্সটা সিলেটি ছাড়া কথা বলতে পারে না, খেত একটা।’ আমি আশরাফের কাছে যাই।সে আমার সাথে কথা বলে।আমি তার কথা আবার তার সাথে উচ্চারণ করি।ওকার আর উকার নিয়ে আমার বড়ো ঝামেলা হয়।আশরাফ ছেলেটা আমার বয়সী।আমি তার কথা শুনি।আশরাফ আমার বন্ধু হয়ে যায়।” প্রথম ক্লাসের অভিজ্ঞতা ছিল লেখকের জন্য আরও অপমানজনক। “প্রথম ক্লাসেই শুরু হলো পরিচয়ের পালা।ফর্ম মাস্টার মিস্টার জামান প্রথমে নিজের পরিচয় দিলেন।তিনি জন্মেছেন সিলেটের শমসের নগর।বাহ! শুনেই প্রাণটা ভরে গেলো।আমার সিলেটি। একে একে আমাদেরও ডাক পড়ল।নিজের নাম,স্কুলের নাম,আর জেলার নাম বলতে হবে।আমার পালা এলে বললাম শাকুর,মাথিউরা দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়, সিলেট। হঠাৎ করে খেয়াল করলাম অন্যরা হেসে উঠল।হাসির কারণ আমি বুঝিনি।ফর্ম মাস্টার মিস্টার জামান ‘শাট আপ’ বলে চিৎকার করে উঠলে ছেলেরা হাসি থামাল বটে কিন্তু মুখ থেকে তাদের উল্লাসের চিহ্ন মুছে গেল না।আমি অপমানিত হই।কিন্তু আমি জানি আমার করার কিছু নাই।আমার কথা বলার মধ্যে সিলেটি টান আছে এটা একটা কারণ।আর তারচেয়েও বড় কারণ –আমার স্কুলের নাম।এমন নামওয়ালা স্কুল আসলে কোনোটি নেই।সেইন্ট প্লাসিডস,সেইন্ট জোসেফ, সেইন্ট গ্রেগরি,সেইন্ট মেরি না হলে শাহীন স্কুল,কলেজিয়েট স্কুল,ক্যান্টনমেন্ট স্কুল,জেলা স্কুল,রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল,ল্যাবরেটরি স্কুল এসব নামেই সবার স্কুল।কিন্তু আমারটা এমন নামের কেন? আর আমার স্কুলের এই নামই যদি হলো তবে এখানে হাসির কী আছে? আমি বুঝি না।” নিজেকে প্রশ্ন করেন কিশোর শাকুর মজিদ।নিজেকে খুব পিছিয়ে পড়া একটা সমাজের মানুষ বলে মনে হয় তার কাছে। এভাবেই বইটিতে উঠে এসেছে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাডেট কলেজের অনেক স্মৃতি। কলেজের কঠিন নিয়ম-কানুনের নানান কথা।তবে কোনও পরিস্হিতিতে লেখক হাল ছেড়ে দেননি।মনে হয়েছে নিজের সাথে নিজের চ্যালেঞ্জ নিয়েই উদ্যমী ছিলেন। সফলতার জন্য তাঁকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। সেদিনের সকল বাঁধা অতিক্রম করে ক্যাডেট কলেজের পাঠ শেষ করেন তিনি।পরবর্তীকালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন।সেখানকার পড়া শেষ করে শাকুর মজিদ আজ একজন সফল স্হপতি। নাট্যকার ও লেখক হিসেবেও সুনাম রয়েছে।ভ্রমণ কাহিনি লিখে ইতোমধ্যে শাকুর মজিদ বাংলা একাডেমিপুরস্কারসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক পেয়েছেন। কয়েকটি নাটকও পুরস্কৃত হয়েছে।

যে কিশোরের মুখে সাধু ভাষা একদিন অন্যদের হাসির খোরাক ছিল, পরিণত বয়সে তিনি একজন সফল লেখক হয়ে উঠেছেন। সমাজ সচেতনমূলক অনেক দর্শকপ্রিয় নাটকও লিখেছেন।বহুমুখি সাফল্যের জন্য ১৯৭৮ সালেই নিজের সাথে নিজের একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিশ্চয়। তেতাল্লিশ বছর পর ক্যাডেট কলেজের অনেক নিয়ম-কানুনের রদবদল হতে পারে।তবুও এই বইটি ক্যাডেট কলেজ সংক্রান্ত নানা রকম নিয়মনীতির ক্ষেত্রেও তথ্যনির্ভর। বইটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। প্রকাশনা উৎসবে দেশের অনেক খ্যাতিমান লেখক, পাঠক ও সুধীজনের কাছে বইটি সমাদৃত মনে হয়েছে।বইটি তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।অভিভাবকরাও উৎসাহিত হবেন।

মন্তব্য
Loading...