যাদবপুরের সঞ্জয় আর ক্যানিং এর সুন্দরবন

ভ্রমণের সময়, ৯ জানুয়ারী ২০২৩। লেখা ১১ জানুয়ারী ২০২৩।

কলকাতার সিলেট উৎসব শেষ হয়েছে গতকাল। আমি ঢাকা ফিরে যাবো আগামীকাল। আমার বিশেষ কাজের মধ্যে আছে কিছু  কলকাত্তীয় বন্ধুদের সাথে মোলাকাত। আজ সকালে যার সাথে দেখা হবার কথা ছিলো তিনি সময় বের করেছেন সন্ধ্যায়। দিনে আমার তেমন কোন কাজ নেই।

আমি আছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উল্টোদিকের এক অখ্যাত গেস্ট হাউজে । এখানে শুধু থাকার বন্দোবস্ত। খেতে হয় বাইরে গিয়ে। ঘর থেকে বেরিয়ে দু’কদম হাঁটলেই জমজমাট স্ট্রিটফুডের দোকান। আমার তাতে সমস্যা নেই, বরং আমোদ আরো বেশি। সঞ্জয়কে বললেই খাবার ঘরে এনে দিতে চায়। যদিও, আমি চাই খোলা রাস্থায় বসে মানুষের চলাচল দেখতে দেখতে লুচিভাজি, আলুরদম আর পনেরোটেকি গুড়ের চা দিয়ে নাস্তা খেতে।

সকাল বেলা নাস্তা সেরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটা চক্কর দিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়েছি। এমন সময় সঞ্জয় আমার রুমে আসার জন্য হালকা টোকা দেয়। সে এই গেস্ট হাউজের ম্যানেজার-কাম-বেয়ারা-কাম-রিসেপশনিস্ট-কাম-বেলবয়।

কাচুমাচু করে বলে, স্যার আপনার কিছু লাগবে ? এনে দিব?

আমি বলি- কী দিতে পারবা ?

যা বলেন স্যার। চা, কফি, ড্রিংক্স, যা বলবেন।

আমি বলি- তোমাদের গেস্ট হাউজে তো চুলা জ্বলে না, কফি চাইলে কী করে দিবা?

সমস্যা নেই স্যার। ফ্লাস্কে করে নিয়ে আসি ?

ঠিক আছে, দু কাপ নিয়ে আসো।

 

সঞ্জয়ের বয়স প্রায় ৪০। শ্যামলা রঙ, তাগড়া শরীর। জামা-জুতা পরলে তাকে সাহেব-সাহেব লাগে। কথাও বলে সুন্দর। বাংলা বললে শুদ্ধ প্রমিত বাংলা, ইংরেজি বললে ইংরেজি। এই গেস্ট হাউজে আমি তাকে বেলবয় থেকে শুরু করে, হাউজ কিপারের কাজ করতেও দেখেছি। আরেকজন মাত্র সহকারি নিয়ে তার দুইজনই ১০ কামরার এই গেস্ট হাউজ চালায়।

৪ তলা বাড়ির দোতালার এক চিলতে ডেস্কের উপর রাখা একটা কম্পিউটার। এটাই রিসেপশন ডেস্ক। এখানেই চেক-ইন চেক-আউটের কাজ করা হয়। তার পাশে, যেটা এই ফ্ল্যাটের লিভিংস্পেস ছিলো সেখানে ৩ জনের বসার একটি মাত্র সোফা আর একটা চৌকি বিছানো। চৌকির উপর দুটো বালিশ রাখা। রাতে একজন এই বিছানায় ঘুমায়, আরেকজন সোফায়।

এই দোতালারই রিসেপশনের সাথে লাগানো একটি কামরায় আমার জন্য একটা ঘর বরাদ্দ হয়েছিলো। দু রাত আমি এখানে ছিলাম।

এই কামরায় বাড়তি কোন চেয়ার রাখায় মতো জায়গা নাই বিধায় আমাকে একবার আরেকটা বড় ঘরে নিয়ে রাখা হলো। কিন্তু সেই ঘরের বাথরুমে শেভ করতে গিয়ে দেখি, একফুটি বেসিনের উপর কোন আয়নাও নাই।

আয়না ছাড়া কী করে বাথরুম হয় আর এটা অতিথিকে ভাড়া দেয়া হয় এটার ব্যাখা চেয়েছিলাম সঞ্জয়ের কাছে। সে কাচুমাচু করে কোন জবাব দিতে পারেনি। যা দিয়েছিলো তা যে আমার পছন্দ না, সেটাও সে বুঝেছিল।

আমার  ধারনা ছিলো – এই ঘটনার পর সে আমার উপর আরো ক্ষেপে যাবে। কিন্তু ঘটনা ঘটছে উলটো।

আমাকে আগের রুমে ফিরিয়ে এনে সুযোগ পেলেই আমাকে নানা ভাবে খুশি রাখতে চায়।

সম্ভবত এ কারণে এখন সে আমার কাছে এসেছে, কা-কফি খাওয়ানোর জন্য।

 

সঞ্জয় একটা ফ্লাস্কে করে কফি এনে রাখে। বলে – স্যার, ঢেলে দেবো? কাপ আনি।

আনো। দু’টো কাপ।

দুই কাপের কথা শুনে সে একটু দাঁড়ায়। তাকায় আমার দিকে, আমি আবার বলি – নিয়ে এসো, দুই কাপ।

সঞ্জয় একটি কাপে কফি ঢালে।

আমি বলি – ঐ কাপেও ঢালো।

আমি একটা কাপ নিজের দিকে নেই, আরেকটা সঞ্জয়ের দিকে বাড়িয়ে বলি- খাও।

ইতস্তত করে সঞ্জয়। এবং কয়েক সেকেন্ড পরে ধাতস্থ হয়ে আমাকে বলে- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। (ওদের উচ্চারনে স্যার টা ‘স্যের’ এর মতো শুনায়)

 

খাটের এক প্রান্তে দুইটা বালিশ উঁচা করে আমি পিঠ ঠেকিয়ে আধশোয়া আছি। খাটের অপর প্রান্তে  আমার পায়ের দিকে একটা খালি জায়গায় বসেছে সঞ্জয়। কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলে-  স্যার, আপনি তো খুব ভ্রমণপ্রিয় মানুষ, তাই না স্যার?

তুমি কী করে জান?

আপনাদের উতসবে আসা কয়েকজন আপনার কথা বলেছে। তারপর আপনার পাসপোর্ট দেখে আমি গুগল করেছি। আমি স্যার সব জানি আপনার সম্পর্কে।

বাহ। বেশ তো। এখন এজন্য কী করতে হবে আমার ?

স্যার, আমি আজ বাড়ি যাবো।

ভালো তো। আমিও কাল চলে যাব।

স্যার, আমার বাড়িটা খুব সুন্দর একটা গ্রামে। পাশেই নদী আছে, নৌকা আছে। আপনি তো এসব খুব পছন্দ করেন, আপনি যাবেন স্যার ?

কোথায় এটা ?

এই, সুন্দরবনের মুখে। এখান থেকে সবাই সুন্দরবন যায় ।

নাম কি জায়গাটার ?

ক্যানিং।

কী !

ক্যানিং স্যার, লর্ড ক্যানিং এর নাম শুনছেন না ? লাস্ট গভর্নর জেনারেল অব বৃটিশ ইন্ডিয়া এন্ড ফার্স্ট ভাইসরয়।

ক্যানিং এর নামে তো লন্ডন একটা জায়গা আছে। ইস্ট লন্ডনে ক্যানিং স্ট্রিট আছে।

এখানে একটা শহর আছে স্যার। সে-ই বানিয়েছিলো। এখানে পোর্ট করতে চেয়েছিল। তাঁর চিন্তা ছিলো বিশাল পোর্ট হবে এখানে, বিলেতে মালামাল নিতে সুবিধা হবে তাদের অনেক বেশি। সিঙ্গাপুরের সাথে টেক্কা দিবে এই পোর্ট। রেল লাইনও বানিয়েছিলো। এখনো সেই রেল লাইনেই ট্রেন চলে। মাত্র ১০ টাকা ভাড়া। ১ ঘন্টায় যাওয়া যায়। আপনি যাবেন স্যার? শুধু ‘হ্যা’ বলেন। আমি বাকিটা দেখছি।

আমার হাতে অনেক কাজ। কলকাতায় আমার স্থপতিবন্ধুদের সাথে আড্ডা আছে সন্ধ্যায়। ৭ টা থেকে রবীন্দ্রুসরোবরে কাছে একটা ক্লাবে আসর । হাতে আমার ৪/৫ ঘন্টা সময়। আমি বলি, যেতে আসতে কতক্ষণ লাগবে ?

সঞ্জয় বলে, স্যার যাওয়া-আসা দুই ঘন্টা। আর মাঝখানে আপনাকে নিয়ে নদীভ্রমণ দুই ঘন্টা। ছোট ছোট নৌকা আছে স্যার। হাতে বাওয়া নৌকা। কোন শব্দ নাই। শুধু পাখীর ডাক আর ঢেউয়ের হালকা শব্দ। আপনি তো এসব খুব পছন্দ করেন, যাবেন স্যার?

আমি বলি, তুমি তো বাড়ি থেকে যাবে। আমি ফিরতে পারবো তো !

স্যার, আমার গ্রামে দোতলা বাড়ি আছে। মাটির বাড়ি। আমার ছেলে দুইটা খুব ভালো গান করে। আপনি যদি থাকতে চান, আমার বাড়িতে রাতে থাকবেন। কাকড়া কি পছন্দ স্যার? আপনাকে রাতে সরু চালের ভাতের সাথে মাতলা নদীর বড় বড় কাকড়া খাওয়াবো।

বাহ!

আর ঘুম থেকে উঠেন কখন স্যার?

আট টায়।

আমি স্যার ছ’টায় বেরিয়ে যাব। তাজা খেজুরের রস নিয়ে আসবো। সকাল আটটায় আপনার দরোজায় কড়া নাড়বো। আপনি উঠে খেজুরের রস খাবেন। খেজুরের রস কি পছন্দ স্যার?

হ্যা, খাই তো

পাটালি গুড় ? আমাদের বাড়িতে নিজের হাতে বানালো। আমার মা বানায়। আপনাকে কিছু দিয়ে দিলে দেশে নিয়ে যাবেন। বৌদি খুব পছন্দ করবে।  কি করবেন স্যার। যাবেন ?

আমি হঠাত বলে বসলাম, চলো ।

স্যার, দু মিনিট সময় দেন। আমি চানটা করেই আসছি। ঠিক দু মিনিট স্যার। আমি আসছি। আপনি রেডি হয়ে যান।

 

আমার হ্যাভারসেক কাঁধে ঝুলিয়ে সঞ্জয় বেরিয়ে পড়ে আমাকে নিয়ে

দু’মিনিটের খানিক বেশি লাগে আমার রেডি হতে। আমি আমার হ্যাভারসেকের ভেতর আমার গ্যাজেটগুলো ঢুকিয়ে ফেলি। গ্যাজেটের মধ্যে আছে ফোনের চার্জার, পাওয়ার ব্যাঙ্ক, ছোট ছোট দুইটা ট্রাইপড, সেলফি স্টিক, অজমো পকেট-এর সরঞ্জাম, ব্লু-টুথ স্পিকার, এসব হাবিজাবি আর আছে একখানা কাশ্মীরী চাঁদর। কিছুদিন আগে এটা উপহার পেয়েছিলাম করিমগঞ্জের মুজিব স্বদেশীর কাছ থেকে। খুব আরাম এই চাঁদরে। ছোটখাট শৈতপ্রবাহে সাংঘাতিক প্রতিরোধী।

সঞ্জয় ঘরে এসেই আমার হ্যাভারসেক তাঁর কাধে তুলে নেয়। সে নিজেও দেখি একটু অন্য রকমের পোষাকে এসেছে। খানিক আগে যা দেখেছিলাম তা নয়। জিন্সের প্যান্ট, সাদা ক্যাডস, একটা হাফ হাতা সাদা রঙের টি শার্ট, তার উপর লাল রঙের সুয়েটার।

আমাকে বলে, স্যার চলেন।

আমি বলি, যাবো কী করে ?

সঞ্জয় বলে, স্যার একটু সামনে গিয়ে রিকশা ধরবো, এই রিকশা কুড়ি টাকায় আমাদের নিয়ে নামাবে যাদবপুর স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেন।

ট্রেন কখন ?

সমস্যা নেই স্যার, আধা ঘন্টা পরপর ট্রেন আসে এখানে। সীট খালি। আরামে বসে যেতে পারবেন। মাত্র দশ টাকা টিকেট।

দশ টাকা ! এটা কী থার্ড ক্লাসের কামরা ?

স্যার, এই ট্রেনে কোন ক্লাস নাই। সবাই এক ক্লাস। দশ টাকার টিকেট কেটে আপনি দিনের মধ্যে যে কোন ট্রেনে ক্যানিং পর্যন্ত যেতে পারেন। এটা শিয়ালদহ থেকে ছাড়ে। প্রচুর মানুষ সকালের ট্রেন ধরে কলকাতা আসে, আপিস শেষ করে সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়ি যায়। আরাম করে নিজের বাড়িতে ঘুমায়। আবার সকাল বেলা কাজে এসে পড়ে এখানে।

 

সঞ্জয়ের কথায় কী মনে করে যে রাজী হয়ে গেলাম বুঝতে পারি না।

গেস্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে টানা শ খানেক গজ পায়ে হাঁটার পর সঞ্জয় আমাকে নিয়ে একটা রিকশায় উঠে। এই রিকশা যাদবপুরের এইট-বি বাস স্ট্যান্ডকে ফেলে বামে মোড় নেয় এক বড় গলির ভেতর। ছোটছোট দোকানপাটে ঠাসা দু’ধার। ফুটপাথেও উঠে এসেছে দোকানের পসরা। ডানে-বায়ে তাকিয়ে দেখি, বড় বাজারের সবকিছুই এখানে আছে।

যাদবপুরের স্টেশন রোড। এখানেও আছে ব্রাজিল -আর্জেন্টিনা

সঞ্জয় বলে, স্যার, এটা স্টেশন রোড। এই মার্কেটে জিনিসপত্রের দাম অনেক কম। বড় বড় শপিং মলে যা থাকে তার আদ্দেক। এজন্য ভিড় একটু বেশি। বেচাকেনাও ভালো। আপনি কিছু কিনতে চাইলে কাল সকালে এখানে নিয়ে আসব আপনাকে।

আমি বলি, কেনাকাটায় আমার আগ্রহ নাই। দেখো না, ছোট যে ব্যাগ নিয়ে এসেছি তার অর্ধেকটুকু আমার এই সব গ্যাজেট আর গিয়ার। দুইটা প্যান্ট দুইটা জামা নিয়ে আমি আরাম করে ছয় সাত দিনের ট্যুর দিতে পারি। কেনা কাটায় আমি নাই। আমাদের স্টেশন কদ্দুর?

এই যে স্যার। এই তো সামনেই। এসে পড়েছি। আপনি নামেন, আমি ভাড়া দেই।

তুমি আবার কিসের ভাড়া দিবা মিয়া।

না না স্যার। আপনি আমার গেস্ট। আপনি মানিব্যাগ পকেটে রাখুন।

সঞ্জয় তাঁর মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ২০ টাকা রিকশাওয়ালাকে দিল।

নেমেই দেখি লেখা- যাদবপুর রেলস্টেশন। ১৮৬২ সালে এখানে প্রথম রেল স্টেশন হয়েছিলো কলকাতা মেট্রোপলিটনের মধ্যে আন্ত-যোগাযোগ তৈরি করতে। কলকাতা তখন সর্বভারতের রাজধানী। লর্ড ক্যানিং তখন গভর্নর। সুন্দরবনের উপকূল পর্যন্ত ট্রেন লাইনের চিন্তা তখনই হয়েছিলো । ১৯৬৫ সালের দিকে শিয়ালহহ থেকে সোনারপুর পর্যন্ত বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করা হয় এই স্টেশনে।

আমরা যখন যাদবপুর স্টেশনে পৌছি তখন বেলা পৌনে দুইটা। সঞ্জয় বলে ১টা ৫৩ তে আমাদের ট্রেন এসে পৌঁছাবে, ১ মিনিট থাকবে, তারপর চলে যাবে। আমাদের হাতে সময় কম। চলেন টিকেট কাটি।

টিকেট কাটার একটা কাউন্টার আছে বটে, কিন্তু সেই কাউন্টারে কেউ নাই। বাইরে একটা কম্পিউটার টাচ স্ক্রিন। কিছুদিন আগে জাপানে যেমন দেখে এসেছি, অনেকটা সে রকম। কিন্তু এই কম্পিউটারের পর্দায় টোকাটুকি দিয়ে নিজেই টিকেট কেটে ফেলতে পারে যে কেউ। কিন্তু দেখি যে কেউই নিজে এ কাজ করছে না। সামনেই একটা টুলের উপর বসে আছেন একজন। তিনি  খুব দ্রুত আঙ্গুল চালাতে জানেন। শুধু স্টেশনের নাম আর কতজনের টিকেট হবে এটুকু জানালেই হলো। তিনি টাকা নিচ্ছেন আর টিকেটের প্রিন্ট আউট দিচ্ছেন। এবং তুফান গতিতে আঙ্গুল চালাচ্ছেন।

 আমাদের টিকেট কুড়ি টাকার। এই সুযোগে ৫শ টাকার একটা নোট ভাঙাতে চাইলাম। নোটটা সঞ্জয়ের হাতে দিতেই সে এটা টিকেট সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। এটিএম বুথে যেমন টাকা আসে, টিকেট এলো এক জানালায়, আরেক জানালা দিয়ে বেরোলো ৪ শ ৮০ টাকার খুচরো।

সঞ্জয়কে বলি, এগুলো তোমার কাছে থাক, আমি পরে নেবো।

টাকা থাকলো সঞ্জয়ের কাছে। আমরা প্লাটফর্ম মাড়িয়ে ফুটওভার ব্রিজ পার হয়ে ওপারে গিয়ে অপেক্ষা করি।

১টা ৫৩ বাজতে আরো ৩ মিনিট বাকি। আমি দেখি এই রেল স্টেশন।

অনেক দিন হলো বাংলাদেশে আমার তেমন রেল চড়া হয়না। আমাদের রেল লাইন এই বৃটিশদের আমলে যা ছিলো এখনো সেরকমই। এখানে দেখি এর সাথে নতুন কিছু যোগ হয়েছে।

রেল স্টেশনের যে সকল উপকরণ আমরা আগে দেখেছি, এখানেও তা। সে রকমই ফলের দোকান, খাবার দোকান, সারিসারি। তবে যেটুকু জায়গা ফাঁকা রাখা আছে যাত্রী চলাচলের জন্য সেখানে কেউ কোন পশরা সাজিয়ে রাখেনি। এক ফলবিক্রেতা মহিলা আরাম করে বসে পান চিবাচ্ছেন। সামনে কমলা, আপেল, আনারের সারি। দূরে মাইক বাজছে, ‘হরে কৃষ্ণ হরে নাম’ বলে। আমাদের এখানে যেমন মাইকে ওয়াজ থাকে, বা কোরান তেলাওয়াত – এমন।

সঞ্জয় আমাকে সাবধান করে, স্যার প্ল্যাটফর্মে কিন্তু স্মোকিং এলাউড না। সাথে সাথে ফাইন করে দিবে। মাফ নাই।

আমি বলি এটা তো ওপেন টু স্কাই।

এটাও প্ল্যাটফর্ম। এখানে করা যাবে না। সিভিল ড্রেসে পুলিশ আছে, আপনি টের পাবেন না।

আমি পাশের একটা কাঁচা বাজারের মাছের খালি পাটাতনের উপর বসে ঘড়ি দেখি, ১ টা ৫২। কিন্তু ট্রেনের আওয়াজ পাই না। ট্রেন নিশ্চয়ই লেট হচ্ছে আজ।

এটুকু ভেবে আমি যখন পাটাতনের দিকে মুখ বাড়ালাম, দেখি এক বড় অজগরের মতো হেলতে হেলতে ট্রেন এসে পড়েছে কোন ভেঁপু না বাজিয়ে।

আমাদের এখানে ট্রেন কি ভেঁপু না বাজিয়ে কোন স্টেশনে ঢুকে ? মনে হয় না।

ট্রেন থামার আগে দেখি সারি সারি লোক দাঁড়িয়ে আছে। যদিও ঠিক জাপানের মতো না, কিন্তু নিজের মতো এমন ভাবে দাড়ালো যে কেউ কাউকে ধাক্কা দিচ্ছে না, কেউ কারো আগে ওঠার জন্য তাড়া দিচ্ছে না।

ট্রেন থেমে যাবার পর ১ মিনিট স্থির থাকবে। এই ৬০ সেকন্ডের মধ্যেই নামবে এবং উঠবে। নামা ওঠার জন্য এই ৬০ সেকেন্ডকে খুব কম সময় মনে হলো বটে, কিন্তু যেভাবে সুর সুর করে লোকেরা নামলো আর লাইন ধরে ধরে ট্রেনে উঠে গেলো তারপরও ১০-১৫ সেকন্ড সময় দেখি হাতে রয়ে গেছে। ৬০ সেকেন্ড পুরো হলে ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো।

ট্রেনের ভেতরের দাঁড়িয়ে থেকে যা দেখলাম, এই দৃশ্য আমার বহু চেনা। ভারতে এর আগে দেখিনি। বাংলাদেশে দেখেছি। এর আগে আমি দু’বার মাত্র ট্রেন সফর করেছি ভারতে। একবার হাওড়া-দিল্লী, রাজধানী এক্সপ্রেসে ১৯৯৭ সালে, আরেকবার হাওড়া-বোলপুর ২০০৪ সালে। এই শেষ। ওগুলো ছিলো দূরপাল্লার ট্রেন। এটা লোকাল। লোকাল ট্রেন হলেও এর মধ্যে কী যেন অতিরিক্ত আছে। ঠাসাঠাসি করে মানুষ যেমন বসে আছে , ছাদের সাথে লাগোয়া হাতল চেপেও অনেকে দাঁড়িয়ে। উন্নত দেশে শহরের মধ্যে চলাচলকারি ট্রেনগুলোতে যেমন থাকে তেমনই।

আমিও একটা হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি।

সঞ্জয় বলে, স্যার, পরের স্টেশনে ফাঁকা হয়ে যাবে।

আমি কোন কথা বলি না। হাত নেড়ে বুঝাই, আমি ঠিক আছি।

এর মধ্যে, আমার সামনের সীটের শাড়ি পরা, সিঁদুর আঁটা শ্যামলা বর্ণের এক তরুনী হঠাত দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে বলে, আপনি বসুন।

এই তরুনী আমার জন্য সীট ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন

আমি তাঁকে যতোই বুঝাতে চাই যে আমি দাঁড়িয়ে ঠিক আছি, সে আমার কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে সীট ছেড়ে একটা হাতল ধরে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলো। এই সীট ফাঁকা হয়ে আছে, আর কেউ বসে পড়বে এই বিবেচনায় সঞ্জয় এসে আমকে প্রায় জোর করে বসিয়ে দিলো।

বসে বসে আমি অজমো পকেট অন করে ফেলি। মানুষের মুখ, দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনযাত্রীর ছবি তুলি। বিকেলের হেলানো রোদ খোলা জানালা দিয়ে এসে পড়ে মানুষের মুখে । নানা জাতের ফেরিওয়ালা নানা সুরে তাঁদের পণ্যের গুণকীর্তন করতে আসে। কেউ আসে আমলকি খাওয়াতে। সাথে সাথে এর উপকারিতার গুনাগুন বর্ননা করে। একজন এলো ১০ টাকায় ৪০টি সেফটি পিনের বান্ডিল বিক্রি করতে। ভিড় বাট্টার মধ্যে বেচা বিক্রিও দেখি ভালো। আমি এক প্যাকেট শনপাপড়ি কিনলাম। দেড় ইঞ্চির ৪ টা কিউব এক প্যাকেটে। দাম ৪০ টাকা।

মিনিট কুড়ি পরে ট্রেন সোনারপুর জংশনে এলে দেখি সঞ্জীবের কথা পুরাপুরি ফলে গেলো। ট্রেন প্রায় ফাঁকা। কেউ দাঁড়িয়ে তো নেইই অনেকগুলো বেঞ্চেও কোন যাত্রী নাই।

শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং ৪৫ কিলোমিটারের পথ। ২-৩ কিলোমিটার পর পর স্টেশন। মোট ১৯ টি স্টেশন ছোঁয় এই ট্রেন। যাদবপুর থেকে ক্যানিং এর দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার। ১ ঘণ্টার মতো লাগার কথা সেখানে পৌঁছাতে। দিনে ১২টা ট্রেন আসা যাওয়া করে। সঞ্জয় বলে, দিনে দু’ লাখের মতো লোক এই ট্রেন চড়ে।

আমি বলি, এর মানে দু’লাখ লোককে কলকাতায় বসবাস না করেও কর্সংস্থান দেয়া যাচ্ছে, তাই তো ? তোমাদের নগরের জনঘনত্ব কমাতে এটা কিন্তু অনেক কাজ হচ্ছে।

সঞ্জয় বলে, স্যার, আপনার শহরে ট্রেন নাই?

আছে ।

আপনাদের এ রকম ট্রেন নাই ?

না ।

কেন ?

বৃটিশরা যা দিয়ে গিয়েছিলো, এরপর আমরা আর ট্রেনের কিছু করি নাই। আমরা টাউনবাস করেছি, ইন্টার-ডিস্ট্রিক্ট বাস করেছি, বাসের ব্যবসা ভালো। ট্রেন ভালো করলে আমাদের বাসের ব্যবসায়ীরা পথে বসে যাবে। এ জন্য বাসের ব্যবসা চাঙ্গা রাখছি। ট্রেন মাইনাস।

বলেন কী স্যার ! পাবলিক কি বাসে করে ১০ টাকায় ৩৫ কিলোমিটার যেতে পারে আপনার শহরে ?

আমি আর কথা বাড়াই না।

 

ট্রেন থেকে দেখা দৃশ্য

আমাদের ট্রেন ধীরে ধীরে ক্যানিং এর কাছে আসতে থাকে। এর মধ্যে প্রায় সবগুলো জানালার ধার ফাঁকা হয়ে গেছে। সীটে বসে বাইরের যে রূপ দেখি সেটা এই বাংলার মতোই। সেই ধান ক্ষেত, পুকুর, মাঠ, খেজুর গাছ, ইত্যাদি।

ক্যানিং স্ট্রেশনের একটু আগে আরেকটা প্ল্যাটফর্ম বানানো হচ্ছে

ট্রেন এসে থেমে যায় ক্যানিং স্টেশনে। আমরা ধীরে ধীরে নামি। স্টেশনটি যথেষ্ট দীর্ঘ। মূল ছাউনির অনেকটা দূরে আমরা নেমেছি। প্রশস্থ প্ল্যাটফর্ম। মাঝখানে খাবার দোকান, দু পাশে মানুষের চলাচলের পথ।

এখন বেলা তিনটা। দুপুরের খাবারের সময়। ডিম-পরোটা ভাজা হচ্ছে। মাত্র ৪০ টাকায় লাঞ্চের প্যাকেজ। ডাকাডাকি করছে দোকানীরা। ঠান্ডা জলের সরবত খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত অনেকে। এসব পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা মূল গেটের কাছে চলে আসি। প্রায় দেড়শো বছর আগে সুন্দরবনের সাথে সংযোগ করার জন্য এখানে এই রেলপথ আর স্টেশন বানানো হয়েছিল। পুরনো প্ল্যাটফর্মটি নিশ্চয়ই সংস্কার হয়েছে একাধিকবার। এখন দেখি গেটের উপরে টাইলস এর টুকরা দিয়ে সুন্দরবনের মুরাল বানানো হয়েছে। আছে বাঘের ছবিও।

সঞ্জয় বলে, স্যার , আমরা এখন কোথায় যাব ?

তাতো জানি না। কী আছে এখানে দেখার।

ঐ যে স্যার, বলেছিলাম না, নদী আছে, সুন্দরবনের মুখ। আর আছে ক্যানিং সাহেবের বাড়ি।

ঐ বাড়ির কী অবস্থা এখন ?

অবস্থা কেরোসিন স্যার। গেলে দেখবেন ভাঙ্গাচোরা দোতালা ইটের দালান একটা। কেউ থাকেনা এখানে। সাপখোপ থাকে। ১৮৬২ সালে ক্যানিং মারা যান। তার আগে তিনি এখানে এসে মাঝে মাঝে থাকতেন। তার বৌ মশার কামড় খেয়ে ম্যালেরিয়া বাধিয়ে মারা গিয়েছিলো সে সময়। ক্যানিং চলে যাবার পর তার কেয়ারটেকার এই বাড়ি কিনে নিয়েছিল। ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট আবার এটা ফেরত এনেছে। কিন্তু এর কোন সংস্কার নাই। মনে হয় গভর্নমেন্ট চায় না এঁদের কিছু তরতাজা থাকুক, সে কারণে এই জরাজীর্ন অবস্থা । এখন কিছু ট্যুরিস্ট যায়। ভাঙা দালানের ছবি তুলে । অনেক ব্লগারকে দেখা যায় এখানে। আপনি চাইলে ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন। নাকি  যাবেন স্যার? মাত্র এক কিলোমিটার দূরে, ওটোতে উঠলে ১০-১২ মিনিটে নিয়ে যাবে। যাবেন ?

আমি বলি, ক্যানিং সাহেব বাদ। ওগুলো আমার অনেক দেখা আছে।

ঠিক আছে বাদ।

এটা ছাড়া আর কী আছে দেখার?

এখানে ১৯২৬ সালে একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন। তিনি ২ রাত ছিলেন। যে বাড়িটাতে ছিলেন, ওটা আছে। ওই রাস্থার নাম রবীন্দ্রনাথের নামে। যাবেন স্যার?

ওতা কতদূর। বেশী দূরে না। কিন্তু নদীর ঘাটের উলটা দিকে।

না থাক। আমরা নদীর ঘাটে যাই।

 

কথা বলতে বলতে আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়ি। বেরোতে বেরোতে দেখি কতগুলো সাইনবোর্ড। কোথাও বড় কোন সাংস্কৃতিক আয়োজন, কোথাও স্বাস্থ্যসেবার খবর।

আমি সঞ্জয়কে বলি, এ অঞ্চলে যাত্রাপালা কি হয়?

হয় স্যার। যাবেন ? আশে পাশে খোজ নিলে পাওয়া যাবে। মেলা আছে একটা এখানে সেখানেও এসব থাকে। সন্ধ্যার পরে স্যার নিয়ে যাব আপনাকে। এখন কোথায় আগে যাব স্যার।

নৌকার ঘাটে চলো।

আমরা একটা অটোতে উঠে পড়ি। কুড়ি টাকা ভাড়ায় দুজন কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা জায়গায় এসে নামি। এখানে কতগুলো ছোট ছোট টং দোকান আছে। চা-বিস্কিট-বাদাম-চানাচুর-চিপ্স আর নানা রকমের কোলন্ড ড্রিংক পাওয়া যায়। দোকানগুলোর সামনে খোলা জায়গায় বাঁশের মাচা দেয়া । আমাকে এখানে বসিয়ে সঞ্জয় চলে গেলো মাঝির খোঁজে এবং একটা সিগারেট শেষ করার আগেই সে এক মাঝিকে নিয়ে এলো। বলে,- স্যার চলেন। আমরা এক ঘন্টার জন্য নৌকা ভাড়া করলাম। ৩০০ টাকা ঘন্টা। যদি দরকার হয় আমরা সময় বাড়িয়ে নিতে পারবো। চলেন স্যার। আমরা সুন্দরবন যাই।

মাতলা নদীর এই মাঝির নাম বেজি। তার নামটা এমন যে একবার কেউ শুনলে আর ভুলতে পারে না। প্রথম আলাপেই বলে- ঘাটে এসে আমার নাম বুলবেন স্যার, সব্বাই আমাকে চেনে। বেজি মাঝিরে চেনে না এমন কেউ নাই এই অঞ্চলে। ছাব্বিশ বছর ধরে এই ঘাটেই নৌকা চালায়। আগে অনেক বেশি রোজগার হতো, যখন মাতলার উপর ঐ ব্রিজটি ছিলো না।

আমরা তাকাই, আমাদের ডান পাশের এক লম্বা ব্রিজের দিকে। আধা কিলোমিটারের বেশি হবে এটা লম্বায়। এই ব্রিজটা এখানে হয়েছে ১২ বছর আগে, ২০১১ সালে, মুখ্যমন্ত্রি তখন বুদ্ধদেব বাবু। সঞ্জয় বলে- ক্যানিং আর বাসন্তীকে যুক্ত করেছে এই ব্রিজ। এটা পার হয়ে সুন্দরবনের ভেতর ঢুকে যাওয়া যায় অনেক পথ । তবে সুন্দরবন যাওয়া হয় এই পথ দিয়েও, নৌকা করে।

আমরা যখন নৌকায় এসে বসি তখন সূর্য অনেকটুকু হেলে গেছে। শীতকাল বলে একটু শীত শীত হাওয়া আছে এই মধ্য জানুয়ারিতেও । বর্ষার মওশুমে এ রকম নৌকা বাওয়া এখানে চলে না। মাঝে মাঝে দুই পাড় উপচে পানি চলে আসে।

আমাদের নৌকাটির একপাশ ছই ঘেরা, আরেকপাশ উদোম পাটাতনের। রোদ-বৃস্টি ঠেকাতে ছইয়ের তলায় আশ্রয়ের সুযোগ আছে বটে , তবে হাওয়া খেতে যারা নৌকায় বসেন তাঁরা পাটাতনই পছন্দ করেন। আমাদের সুনামগঞ্জের নৌকাগুলোর চেয়ে এগুলো একটু আলাদা।

মাতলা নদীর তীর যেখানে, সেখানে বিস্তীর্ণ পলি জমেছে। তার পাড় থেকে একটা বড় খাল ঢুকে গেছে ভেতরে। এই খালগুলো আসলে কতগুলো ছোট ছোট দ্বীপে ভাগ করে দিয়েছে পুরো সুন্দরবন। ১১৯টি ছোট বড দ্বীপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন । সেখানে বাঘ আছে, হরিণ আছে, শ্বাসমূল আছে, গোলপাতা আছে। সবই আছে বাংলাদেশের সুন্দরবনে যা আছে তার মত। কিন্তু ভারতের অংশে এই সুন্দরবন অনেক ছোট।

আমার দুই সুন্দরবই আগে দেখা। বাংলাদেশের সুন্দরবনে গিয়েছি মোটে তিনবার। প্রতিবারেই ৫ রাতের সফর ছিলো সদরঘাট থেকে জাহাজে করে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে একবার, ২০১৭ সালের মে মাসে । জয়পুর থেকে ফেরার পথে আমাদের কলকাতার স্থপতি বন্ধুরা আয়োজন করেছিলো এই সফরের। আমরা একরাত এক রিসোর্টে থেকে পরদিন একটা ছোট্ট ট্রলার নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম সুন্দরবনের বড় বড় খাল দিয়ে। একসময় সাজনেখালিতে বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রমে আমরা গেলাম। অনেক গোছানো আয়োজন ছিলো নানা রকমের পশুপাখী দেখার জন্য। সেখানে একটা মন্দির আছে। ‘মা বনবিবি’র মন্দির। সেখানে বাঘদেবতার পূজা করা হয়। আমরা একটা ৫ তলার সমান উঁচু টাওয়ারে উঠেছিলাম, বাঘ দেখার জন্য। বাঘ দেখা যায়নি, কিন্তু বাঘের গল্প শুনিয়েছিলো এক শিকারি। যিনি নিজে মৌচাক থেকে মধু আহরনের সময় বাঘের পাল্লায় পড়েছিলেন একাধিক বার। সুন্দরবনের মাঝি বা জেলেরা বাঘকে খুব একটা ডরায় না। বরং নানা চাতুরি করে বাঘকে ভয় পাইয়ে দেবার অনেক কৌশলও তাঁদের জানা।

এমভি মনিদীপায় চড়ে পলিঘেরা খালের পাড় আর দূরের সুন্দরী গাছের রূপ দেখতে দেখতে আমরা অনেক রোমাঞ্চকর গল্প শুনেছিলাম। শুনেছি, বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে অনেক কম হলেও বেশি বাঘ নাকি ভারতের সুন্দরবনে আছে।

বাংলাদেশের সুন্দরবন আমাকে টানেনি। জাহাজযাত্রাটা ভালো লাগে মাত্র। আর সামান্য ভেতরে যতটুকু নিয়ে যায় তা দেখতে আমাদের ছোটবেলার গ্রামের মত। বনবাদাড়ের ভেতর নৌকা বেয়ে বেয়ে কেটেছে আমার শৈশব। সুতরাং এসব আমাকে খুব রোমাঞ্চিত করে না।

আজ এই ক্যানিং এর মালতা নদীর থেকে ভেতর দিকে যাওয়া একটা খাল পার হতে হতে আমাদের পরবর্তি সুন্দরবন ট্যুরের পরিকল্পনা হয়ে যায়।

আমাদের মাঝি বেজি এতক্ষণে আমাদের ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। পাতার বিড়ি ফেলে সে এখন বেনসন খাচ্ছে একটার পর একটা। কোক জাতীয় পানীয় তার জন্যও বরাদ্দ এক বোতল। সুতরাং তাঁর খুশি অনেক।

সঞ্জয় বেজিকে বলে- এই, তুমি এই স্যারকে নিয়া রবীন্দ্রনাথের ‘পদ্মা’ বোটের মত একটা নৌকা নিয়া ৩/৪ দিন ঘুরতে পারবা ? স্যার নতুন করে কিছু ‘ছিন্নপত্র’ লিখবে।

মাঝির কাছ থেকে জবাব আসার আগে আমি সঞ্জয়ের দিকে তাকাই। সঞ্জয় কী করে ‘পদ্মা’ বা ‘ছিন্নপত্র’র কথা জানলো !

আমি প্রশ্ন করি, তোমার পড়াশুনা কোন বিষয়?

স্যার, বাংলা ?

বাংলা!

জ্বী স্যার ।

কোন কলেজ?

ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি স্যার।

তুমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার স্নাতক ?

স্যার, আমি মাস্টার্স করেছি ২০০৭ এ। কোথাও চাকরিবাকরি পাই না। অনেক জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছিলাম। রিটেনে টিকি, মাঠপরীক্ষায় আর পাশ হয় না। তাই এই গেস্ট হাউজে চাকরি পেলাম। ১৪ হাজার টাকা মাইনে পাই। আমার পুরাটাই থেকে যায়। এই টাকা বাড়িতে দিয়ে দেই।

বাড়িতে কে আছে?

বাবা, মা, বৌ, দুই ছেলে।

বাবা কী করেন ?

এখন কিছু করেন না। আমার ছেলে দুইটা খুব ভালো গান গায় স্যার। আপনাকে শুনাবে আজ।

 

এক ঘন্টার জন্য আমাদের নৌকা ভাড়া হয়েছিলো। এখন দেড় ঘন্টার উপর চলছে। আমরা বা আমাদের মাঝি কেউই তাড়া দিচ্ছে না তীরে ফিরতে।

সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। আমাদের নৌকা ঘুরাতে হবে। তাঁর আগে সঞ্জয় আরেকটা বাক পেরুতে বলে। ওখানে হাজার হাজার পাখী এসে বসে সন্ধ্যা বেলা। এটা আমাকে দেখাবেই। আমরা কাছে যাই। এ সময় কিছু পাখী একসাথে লাফ দিয়ে উঠে।

আমার সেলফোনের ক্যামেরা বা অজমো পকেটের অটোফোকাস ক্যামেরা কোনটাই এই দৃশ্য ঠিক মতো ধরার উপযোগী না। আমি ক্যামেরা বাদ দিয়ে চোখে দেখি।

সঞ্জয় বলে, স্যার, আমি নিশ্চিত ছিলাম, বাংলার এই রূপ, রস আর গন্ধ আপনি উপভোগ করবেন। ঠিক না স্যার?

আমি মাথা নাড়ি।

বেজির সাথে ঠিক হয়ে যায়, ৪ রাতের জন্য আমরা মাত্র কুড়িহাজার রুপীতে একটা ‘পদ্মা’ মার্কা বোটে করে সুন্দরবনের ভেতর ঘুরে আসবো, নৌকা থেকে নামবো না। আর ঐ নৌকা বেজিই চালাবে তাঁর বৈঠা দিয়ে। তাঁর একজন সহকারি থাকবে শুধু। আমাদের ৬ থেকে ৮ জন ঘুমাতে পারবে একসাথে, নৌকায় বাথরুম থাকবে, রান্না করার চুলাও থাকবে। নদীতে ঘুরতে ঘুরতে আমরা জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনবো। সেই মাছ গরমগরম ভেজে দেবে বেজির সহকারি। গরম ভাত আর মাছভাজা, সাথে চাটনি আর সামান্য সবজির ব্যঞ্জন। এই আমাদের ফুড মেনু।

সূর্য ডুবে যাবার পর হঠাত করে অন্ধকার ছেয়ে আসে। আমরা আবার ফেরত আসি ঘাটে।

দূরে বাদ্য বাজছে। সঞ্জীব বলে স্যার, সুন্দরবন মেলা আছে ওখানে। যাবেন?

আমি বলি, চলো।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য
Loading...